শিরোনাম
বৃহঃ. ডিসে ৪, ২০২৫

কবি ও কথাসাহিত্যিক তমিজ উদ্দীন লোদী’র সাথে এক অনন্য বৈকালিক বৈঠক

।। কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ।।

আশির দশকের ব্যতিক্রমী ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কবি ও কথাসাহিত্যিক তমিজ উদ্দীন লোদী। তাঁকে চিনতাম বহু আগেই, সেই তারুণ্য তথা লেখালেখির সূচনালগ্নে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে দেখা হলো অনেক পরে, প্রায় ২৫/৩০ বছরের ব্যবধানে, তাও লণ্ডনে বেড়াতে এসেছিলেন বলে। প্রথম দর্শনেই স্মিথ হেসে জড়িয়ে নিলেন। দীর্ঘক্ষণ কথা হলো সাহিত্যের নানা বিষয় ও বাঁকবদল সম্পর্কে। স্মৃতিচারণ করলেন তাঁর সাহিত্যচর্চার নানা পর্ব ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। তুলে ধরলেন বিভিন্ন সাহিত্য কর্মকাণ্ড এবং বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সাহচর্য ও স্নেহ-ভালোবাসা প্রাপ্তির সুখকর মুহূর্ত।

গত ২৫ আগস্ট, সোমবার, ব্রিটিশ ব্যাংক হলিডে‘র ছুটি এবং সামারের শেষ পর্যায়ের সানশাইনের সাথে আরামদায়ক বাতাস বহে চলা দিনে সাক্ষাৎ ঘটলো এই কবি ও কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে। বর্তমানে সপরিবারে আমেরিকাবাসী লেখক লণ্ডনে বেড়াতে আসা তাঁর সমন্দির ঘরে আমাদের (সাপ্তাহিক সুরমা পরিবার) আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা বলতে বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট, সাপ্তাহিক সুরমা’র প্রধান সম্পাদক ক‌বি ফরীদ আহমদ রেজা, মরমী চিন্তক কবি আহমদ ময়েজ এবং সুরমা’র নির্বাহী সম্পাদক হাসনাত আরিয়ান খান। মূলতঃ কবি ফরীদ আহমদ রেজার সাথে কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর ঘনিষ্ট সম্পর্কের সুবাদে আমরা বাকী ত্রয়ীর সাক্ষাৎ এবং দীর্ঘ আলাপচারিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ তৎকালীন এমসি কলেজের একই হোস্টেলে (ছাত্রাবাস) থাকতেন তমিজ উদ্দীন লোদী ও ফরীদ আহমদ রেজা। বয়সের দিক থেকে কিছুটা সিনিয়র জুনিয়র হলেও লেখালেখির সুবাদে সেই থেকে তাদের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা। তাদের দু‘জনের ঘনিষ্ঠতার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করে তমিজ উদ্দীন লোদী বললেন, “রেজা ভাই খুবই স্যোশাল ছিলেন। হোস্টেলের কক্ষে কক্ষে গিয়ে সবার খোঁজ খবর নিতেন। এছাড়া লেখালেখি এবং ছাত্ররাজনীতি করার কারণেতো সবাই তাঁকে চিনতো।” ফরীদ আহমদ রেজাও তমিজ উদ্দীন লোদীর মূল্যায়নপূর্বক বললেন, পেশাগত ভিন্নতা ও ব্যস্ততা সত্ত্বেও তমিজ উদ্দীন লোদী লেখালেখিতে ছিলেন সরব ও সক্রিয়। তিনি কবিতা কিংবা গল্পের সেসব শব্দচয়ন করেন তা খুব মেপেজো‌কে ও চিন্তাভাবনা করে করেন। এজন্য তিনি অনেকের মধ্যে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়। তবে কখনো কখনো মান্নান সৈয়দের প্রভাব কিছুটা রয়েছে বলেও মনে হয়। তমিজ উদ্দীন লোদী তাকে নিয়ে ফরীদ আহমদ রেজার মূল্যায়নকে সহাস্যে স্নেহের প্রকাশ বলে সানন্দে গ্রহণ করেন।

আমাদের ইচ্ছে ছিলো তাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার। কিন্তু লণ্ডনে তাঁর বৃহৎ পারিবারিক সংশ্লিষ্টতা এবং ঘনিষ্ঠ স্বজনদের বিয়ে-শাদীসহ নানা ব্যস্ততায় তিনি আনুষ্ঠানিক আয়োজনের সুযোগ না দিতে পেরে আমাদেরকেই তাঁর সাথে একান্তে ডাকলেন। আমরা যখন তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য রওয়ানা দেই তখন প্রায় শেষ বিকেল, দিনের কড়া রোদ্দুর তখন অনেকটা মোলায়েম ও মিটে হয়ে এসেছে। দিনটি ছিলো সামারের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলোর একটি। ঘরের সামনে ছোট্ট আপেল গাছে অসংখ্য কড়া গোলাপি রঙের আপেল এবং সেখানে সবুজ টিয়া পাখির ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে আমরা প্রবেশ করলাম অপেক্ষমান কবির আত্মীয়ের সিটিং রুমে। পারস্পরিক সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর শুরু হলো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিষয়ে মুক্ত আলোচনা। তমিজ উদ্দীন লোদী আমাদের নানা জিজ্ঞাসার জবাবে বাংলাদেশে থাকাকালিন সাহিত্য চর্চা এবং তা করতে গিয়ে বিভিন্ন সারপ্রাইজ মুহূর্তের স্মৃতিচারণসহ অতীত ও এসময়কার সাহিত্য চর্চার সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলেন।

অন্য অনেক লেখক-সাহিত্যিকের মতো তমিজ উদ্দীন লোদীও প্রচণ্ড রাজনৈতিক সচেতন একজন লেখক। কিন্তু তিনি কোনভাবেই দলান্ধ নন এবং তেমনটি কখনো হতে চান না। এসময়ে স্যোশাল মিডিয়ায় বাংলাদেশ কিংবা প্রবাসের অনেক লেখক-সাহিত্যিকের দলান্ধ হয়ে অশালিন শব্দচয়নে বেফাঁস বিভিন্ন মন্তব্য বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, কোনো সাহিত্যিক ও সুশীল ব্যক্তির কাছ থেকে এমন আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়। বলেন, তিনিও এসব দেখে যারপর নাই বিস্মিত এবং এমন লোকদের এড়িয়ে চলেন।

আমরা ২/১ বার ওঠার কথা বললেও তিনিই আরেকটু বসতে বললেন। সেই সুবাদে কথার পরিবেশ হলো আরো অন্তরঙ্গ। জানা হলো আরো অজানা অনেককিছু। কারণ, আশির দশকে সাহিত্যে উত্থান ঘটা এই লেখকের লেখালেখির বয়স ইতোমধ্যে বেশ প্রলম্বিত ও প্রাজ্ঞতায় উপনীত। তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিলো সেই সময়কার প্রথম সারির কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্য লাভের।

রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকাকালে একবার তাঁর খোঁজে রেলওয়ের ডিজির ফোনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, একদিন তাঁর অধঃস্তন এক কলিগ বললেন, ডিজি স্যার তাকে ফোন করেছেন। পরে তিনি কল ব্যাক করলে এডিশনাল ডিজি ফোন ধরে বললেন, ডিজি স্যার তাকে ঢাকায় সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন। শোনে তিনি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন যে, তিনি কাজে কি কোনো সমস্যা করেছেন যার কারণে ডিজি তাকে দেখা করতে বললেন। তবে ক‌ম্পিত ব‌ক্ষে দেখা করতে গিয়ে যা পেলেন তা চমৎকৃত হওয়ার মতো। ডিজি তাকে চা-বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়িত করার পর বললেন, আপনার কথা কবি আল মাহমুদের মুখে শুনেছি, তিনি আপনার লেখার প্রশংসা করেছেন। আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি যে কারণে তা হলো আমরা কিছু সিলেক্টেড কবিদের নিয়ে একটি কবিতা পাঠের আসর করি, সেটিতে আপনিও আমন্ত্রিত। আপনার নামে কার্ড রেডি থাকবে আপনি চলে আসবেন। অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেন সেখানে কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদসহ নামজাদা সব কবিদের মিলনমেলা। এক সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদও চলে আসলেন। দেশের প্রেসিডেন্টের আগমনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এরশাদ বললেন, আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসিনি, আপনাদেরই একজন হিসেবে আপনাদের সান্নিধ্য পেতে এসেছি। এসময় হাসনাত আরিয়ান খান প্রশ্ন করে বসলেন, এরশাদ সাহেবের কবিতা সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন, নাকি অন্য কেউ লিখে দিতেন? কবি আহমদ ময়েজ বললেন, এরশাদের বক্তৃতার ধরণ ও শব্দচয়নে বোঝা যায় তিনি কবিতা লিখতে পারতেন। তখন তমিজ উদ্দীন লোদী বিস্তারিত তুলে ধরে বললেন, কবি শামসুর রাহমান বিচিত্রায় “শামসুর রাহমান মনোনীত কবিতা” শিরোনামে এরশাদের কবিতা ছাপিয়েছেন। তবে তিনি লিখলেও কেউ হয়তো এডিট করে দিতেন। এছাড়া অনেকে এরশাদের কবিতার বিভিন্ন শব্দচয়ন থেকে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন লিখে বা এডিট করে দিতেন বলে ধারণা করা হ‌তো। এ সময় ক‌বি আহমদ ম‌য়েজ ব‌লেন, ত‌বে সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, এডিট করা কো‌নো দো‌ষের কিছু নয়।

তমিজ উদ্দীন লোদীর কবিতা, গল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়াতেও সমাদৃত হয়েছে। কলকাতার দেশ ও চতুরঙ্গ-এ তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে। সেই কবিতা ছাপার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, একবার তিনি দুটি কবিতা কলকাতার দেশ পত্রিকায় পোস্ট করে দিয়ে ভাবছিলেন তা ছাপা-টাপা হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ছাপা হয়েছিলো। তবে তিনি প্রথমে তা জানতে পারেননি। পত্রিকার পক্ষ থেকে পত্র মারফত যোগাযোগ করা হলেও তার চাকুরিজনিত রদবদলের কারণে সেই সংবাদবাহী পত্র আর তাঁর হস্তগত হয়নি। তবে একদিন কোথাও যাবার প্রাক্কালে রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষমান অবস্থায় এক পরিচিতজনের কাছে তিনি শুনতে পান সেই সুসংবাদ। অতঃপর একদিন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে গেলে তাঁর কবিবন্ধু মুকুল চৌধুরী (এ বছর তিনি ইন্তেকাল করেছেন) তাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, এই তুমি কই? তোমার কবিতাতো দেশ-এ ছাপা হয়েছে। তখন সেখানে মুকুল চৌধুরীর সাথে আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আরো একজন বিশিষ্ট কবি কী যেন দেখছিলেন, বিষয়টি শুনে তারা উভয়ে ঘুরে তমিজ উদ্দীন লোদীর দিকে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন।

দীর্ঘ আড্ডায় দেশের প্রায় সুখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিকদের নাম আলোচনায় ওঠে আসে। সমালোচনা সাহিত্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ’র অনন্য অবদান স্মরণ করে ফরীদ আহমদ রেজা বলেন, সেক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন “নিঃসঙ্গ শেরপা”। তমিজ উদ্দীন লোদী তাতে যোগ করে বলেন, একসময় সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও সমৃদ্ধ সমোলোচনা করতেন। আজীবন মফস্বলে কাটিয়ে দেয়া দুই কবি দিলওয়ার ও ওমর আলীর কথাও স্মরণ করেন তমিজ উদ্দীন লোদী। একই সাথে স্মরণ করেন কবি আফজাল চৌধুরী ও কথাসাহিত্যিক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের কথা। বিশেষ করে কবি দিলওয়ারের স্নেহাশীষ প্রাপ্তি এবং দেশে ও আমেরিকায় সাক্ষাতের স্মৃতিচারণটি ছিলো বেশ আবেগ ঘন। যেটিকে তিনি ‘মাটির ঘ্রাণযুক্ত মায়া’ বলে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশে কবিতা চর্চার দশক ওয়ারি পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জবাবে এই কবি বলেন, ৫০/৬০ এর দশকের পর বাংলাাদেশের কবিতার তেমন বাঁকবদল ঘ‌টে‌নি। তখনকার কবিদের মতো কবিতায় আলাদা আদল বা নিজস্ব ছাপ রাখার মতো কবির কিংবা কবিতার সৃষ্টি হয়নি। এরপর থেকে সবাই যেন একই কবিতা লিখে যাচ্ছেন। বিশ্ব সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে বলতে গি‌য়ে তিনি বলেন, বিশ্বের খ্যাতিমান বেশীরভাগ লেখকই তাদের মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছেন। এমনকি যারা সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন তাদের বেশীরভাগের মূল লেখাটি ছিলো তাদের মাতৃভাষায় লেখা।

কবি তমিজ উদ্দীন লোদী বিলেতে বেড়াতে এসে আত্মীয়-স্বজনের সাথে ব্যস্ত সময় পার করার পাশাপাশি সুযোগ পেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এই ঘুরে বেড়ানো এবং স্বজন-বন্ধুদের সাথে ব্যস্ততার মধ্যেও থেমে নাই তাঁর কবিতা চর্চা তথা লেখাজোখা। ঐতিহাসিক আইকনিক স্থাপত্য টাওয়ার ব্রিজ অবলোকনে লিখে ফেললেন “টেমস, জল ও টাওয়ার ব্রিজ” শিরোনামে একটি চমৎকার কবিতা এবং আমাদের অনুরোধে তা পড়েও শোনালেন। কবি আহমদ ময়েজ শুনতে চেয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কোনো কবিতা বা পছন্দের কবিতার লাইন। সবচেয়ে প্রিয় কিংবা পছন্দের লাইন নির্বাচনের অপারগতা প্রকাশ করলেও তাঁর ফেইসবুক ঘেঁটে স্বরচিত “মানুষের মুখ” শীর্ষক চমৎকার একটি কবিতা পড়ে শোনালেন। যেটিতে মানুষের জটিলতা, কুটিলতা ও অপার রহস্য ফোটে ওঠেছে রূপক শব্দচয়ন ও উপমা ব্যবহারের ব্যতিক্রমী মুনসিয়ানায়। কবিতাটির এক পর্যায়ে কবি বলছেন—
“মুখ আঁকতে গিয়ে দেখি মুখের আড়ালে আরো আরো মুখে আছে
যেন একটি দুরধিগম্য টানেল
অপার অন্ধকার ছাড়া যার সামনে আর কিছুই নেই।
মানুষের মুখ আঁকতে গিয়ে অবশেষে
আমি প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই আঁকতে পারিনি।”

যতক্ষণ কথা হচ্ছিল ততক্ষণই তিনি ছিলেন ধীরস্থির, নম্র এবং অনেকটা মৃদু কণ্ঠ তবে সাবলিল ও সপ্রতিভ। বাংলাদেশে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ শোনার পাশাপাশি একজন বহুল কাঙ্ক্ষিত সাহিত্যব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে একটি উপভোগ্য বিকেল উপহার পাওয়াটা আমার নিজের জন্যেও ছিলো অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। তিনি যখন কথা বলে যাচ্ছিলেন তখন আমার মানসপটে ভিড় জমাচ্ছিলো তাঁর গল্প ও কবিতার চিত্রকল্প ও চিন্তাচেতনার প্রায়োগিক প্যাটার্ন, প্রক্ষেপন। এতোদিনে যে তিনি একজন প্রশান্তচিত্ত সাহিত্যিক হিসেবে আমার মনোলোকে স্থান করে নিয়েছিলেন বাস্তবে সেই শৈল্পিক সত্ত্বারই যেন দেখা মিলল সরাসরি সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতার সুযোগ লাভের মাধ্যমে। তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান করার সুযোগ না পাওয়ায় প্রথমে খারাপই লাগছিলো। কিন্তু তাঁর সাথে একান্তে আলাচরিতার পর খুশিই হলাম বেশী। কারণ, অনুষ্ঠানটি করতে পারলে তা আনুষ্ঠানিকতায়ই সীমাবদ্ধ থাকতো, এরকম অন্তরঙ্গ আলোচনার সুযোগ হতো না।

আহমদ ম‌য়েজ ক‌বির সমকা‌লিন ক‌বি কিশওয়ার ও ফজলুল হ‌কের কথা উত্থাপন ক‌রেন। ক‌বি লোদী তা‌দের মূল্যায়ন ও ব্যক্তিমানস তু‌লে ধ‌রে ক‌বি অত্যন্ত আন্ত‌রিকতার স‌ঙ্গে স্মরণ ক‌রেন তার সম‌য়ের অন্যতম দুই ক‌বি‌কে। ক‌বি কিশওয়ার ইব‌নে দিলওয়ার ও ক‌বি ফজলুল হক। এই দুই ক‌বির অকাল প্রয়া‌নে ক‌বি‌কে অত্যন্ত ব্যথিত ক‌রে।

জনাব তমিজ উদ্দীন লোদীকে দেখা তথা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের সাথে পরিচয়ের সূচনা ঘটে একসময়ের সমৃদ্ধ সাহিত্য সন্দর্ভ, নজরকাড়া ইলাসট্রেশন আঁকা ঈদ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ ও পড়ার সুবাদে। বলা যায়, লেখালেখি শুরুর কম সময়ের মধ্যেই জাতীয় খ্যাতিমান লেখকদের পাশে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। ঈদের বিশেষ সংখ্যাগুলোতে দেখতাম, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ হক কিংবা রাহাত খানদের প্রায় পাশাপাশি তমিজ উদ্দীন লোদী স্থান করে নিয়েছেন। মূলতঃ এসব বিশেষ সংখ্যাগুলোর মাধ্যমেই কবি ও কথাসাহিত্যিক তমিজ উদ্দীন লোদীর সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচয়ের সূচনা। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে তাঁর অনেকগুলো কবি ও গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠক মহলেও সমাদৃত হয়েছে। একই সাথে বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলোতেও তাঁর প্রায় নিয়মিত উপস্থিতির কারণে তিনি পাঠক হৃদয়ে অবিচ্ছেদ্য আসন গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশে দেখা যায়, বিশিষ্ট লেখকদের প্রায়ই পেশাগতভাবেই লেখক, সাংবাদিক কিংবা শিক্ষক। কিন্তু তমিজ উদ্দীন লোদী সেক্ষেত্রে বলা যায় ব্যতিক্রম। তিনি সরকারি চাকুরি ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার ব্যস্ততার মধ্যেও পাশাপাশি সাহিত্য সাধনার কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজটি করে গেছেন নিয়মিত এবং তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। যার কারণে জাতীয় পর্যায়ের লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর নামটি উচ্চারিত হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে আশা করা যায়।

উল্লেখ্য, আশির দশকে যারা বাংলাদেশে কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তমিজ উদ্দীন লোদী তাদের অন্যতম। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা গ্রামে জন্ম নেয়া এই কবি বর্তমানে আমেরিকার নিউইয়র্কের বাসিন্দা। তিনি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক এবং টাইম টিভি থেকে প্রচারিত ‘শিল্প ও সাহিত্য’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে কর্মরত। গল্প দিয়ে লেখালেখির সূচনা হলেও আশির দশকে কবিতার দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তবে পরবর্তীতে কবিতার পাশাপাশি গল্প ও উপন্যাসও লিখছেন সমানভাবে। ইতোমধ্যে নির্বাচিত কবিতা এবং নির্বাচিত গল্প গ্রন্থসহ অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক: ক‌বি ও সাপ্তাহিক সুরমা’র বার্তা সম্পাদক, যুক্তরাজ্য।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *