ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়েছে। আর দুর্যোগের সময় দুর্নীতিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
করোনা নিয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনার ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর সোমবার (১৫ জুন) এক কনফারেন্সে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দু’টি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সরকারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে একদিকে যেমন দলীয় বিবেচনায় তালিকা হয়েছে, তেমনি চুরি, আত্মসাৎ ও প্রতারণা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে রাজনীতিতে যারা প্রভাবশালী তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৯০ জন জনপ্রতিনিধিকে নামমাত্র সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। এদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া এন-৯৫ মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ক্রয়ের নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি হারে ক্রয়মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি। এই দুর্নীতিতে আমলাদের একটা অংশ জড়িত। মূলত ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিতে প্রভাবশালীরা মিলে ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে কাউকে বদলি বা বরখাস্ত করে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। দুর্যোগের সময় যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের তো জনপ্রতিনিত্ব করার অধিকার স্থায়ীভাবে হরণ করা উচিত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তবেই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন- করোনা মহামারির সময় দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, সেখানে এই দুর্নীতির অর্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনাকে অবমাননা করা। এই অবমাননাকারীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও করোনাকালীন দুর্নীতিতে জড়িতরা পার পেয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন ওঠেছে তারা কি প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী।
মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার পেছনে বেসরকারি উদ্যোগকে দায়ী করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সবচেয়ে প্রথম যে প্রণোদনা দেওয়া হলো, সেটা পেলেন ব্যাবসায়ীরা। তারা বললেন, বেতন দিতে পারবেন না শ্রমিকদের। তারপর শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে আবার ঢাকায় আনা হলো। প্রফিটের প্রতি প্রাধান্য দেওয়ার সময় এটি নয়। ব্যববসায়ী করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে। মানুষ যখন মানসিকভাবে সামাজিক দূরত্ব মানতে প্রস্তুত, তখনই গার্মেন্ট খুলে দেওয়া হলো। বিজনেস লবির চাপে সরকারও সেটা মেনে নিল। তাই বেসরকারি খাতের দায় রয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এখনো সময় আছে সমন্বয় করে কাজ করার। আমলা নির্ভর সিদ্ধান্ত না নিয়ে নাগরিক সমাজের মতামত নিয়েও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই সামনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তিনি আরও বলেন, করোনাকালে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা অ্যাক্টের অধীনে মামলা, হয়রানি করা হয়েছে। ডাক্তাররা অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য প্রকাশ করায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা যে প্রকট, এই করোনাকালে তা স্পষ্টটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এই মহামারি মোকাবিলায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বিব্রতকর ঘাটতি ছিল।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে করোনা পরীক্ষাগারের ঘাটতি আছে। এছাড়া সারাদেশের ৫৬টি পরীক্ষাগারের মধ্যে ঢাকাতে ৩৪টি, যা রোগী শনাক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে পরীক্ষার হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন এবং সারা পৃথিবীর মধ্যে ১৪৯ তম।
অন্যদিকে এ কয়মাসে মেডিক্যাল বর্জ্য হয়েছে ১৪ হাজার ৫শ টন, যা সঠিকভাবে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেই।
হাসপাতালগুলোর দৈন্যদশাও তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার তুলনায় আইসিইউ আছে শূন্য দশমিক সাত শতাংশ, যেখানে নেপালে আছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। রয়েছে ভ্যান্টিলেটরের সংকটও।
এছাড়াও জনবল সংকট বিশেষ করে পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান নেই, যন্ত্রপাতি নেই, ডাক্তারদের সুরক্ষাসামগ্রী অপ্রতুল ইত্যাদি বিষয়ও উঠে এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।