করোনাভাইরাস মহামারীকালে কর্মহীন মানুষকে পুনর্বাসনে ১০ দফা সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। আটটি সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণও দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিন পৃষ্ঠার গোয়েন্দা প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার জমা দেয়া প্রতিবেদনটির একটি কপি যুগান্তরের হাতে এসেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় প্রতিনিয়ত শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। এ ছাড়া চাকরি হারিয়ে অনেক প্রবাসীকর্মী দেশে অবস্থান করছেন। দেশে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাসহ ত্রাণের আওতায় চাকরিচ্যুতদের আনা না হলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িয়ে পড়তে পারে।
কর্মী ছাঁটাই ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী চক্র বা সরকারবিরোধী মহলও গুজব বা প্রপাগান্ডা সৃষ্টি করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালাতে পারে। তাই কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা ও কর্পোরেট অফিসে প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে সেটির ভয়াবহতা শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়েছে। করোনা সংক্রমণের শুরুতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অনেক শ্রমজীবী কর্মহীন হয়ে পড়ে। দেশে ১৯৬টি কারখানার ২৩ হাজার ১১০ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়।
পরে বেশিরভাগ শ্রমিক কাজে ফিরলেও একটা বড় অংশ বেকার রয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দেশীয় ও বহুজাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানায় ব্যয় সংকোচন করা হয়। কর্মীদের বেতন কর্তন, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তাদের ছাঁটাই করা হয়। এতে নিু আয়ের মানুষ বেশি দুর্ভোগে পড়েন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন খাতে করোনার নেতিবাচক ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউরোপসহ অন্য সব দেশের আগের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এতে অনেক শিপমেন্ট বাতিল হয়।
আবার নতুন করে কোনো অর্ডারও আসেনি। এ কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় মারাত্মক প্রভাব পড়ে। পর্যাপ্ত কাজ না থাকায় এবং কারখানাগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে না পারায় অনেক শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়ম-নীতি না মেনেই কর্মী ছাঁটাই করে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে বেসরকারি, বীমা ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন শর্তে (যেমন: এফডিআর, ডিপিএস প্রভৃতি লক্ষ্য পূরণ) কর্মীদের কাজে বহাল রেখেছে। এ অবস্থায় লক্ষ্য পূরণ করতে না পারায় কর্মীদের বেতন কর্তন, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা খর্ব এবং চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে।
করোনায় প্রবাসী কর্মীদের অনেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। তাদের অনেকে কাজের উদ্দেশ্যে ফের বিদেশে গেলেও আগের কাজে বহাল হতে পারেনি। গোয়েন্দা সংস্থার অভিমত, করোনা-পরবর্তী বিশ্ববাজারে দেশের শ্রমশক্তি ও পোশাক শিল্পকে শক্ত অবস্থানে তুলে ধরতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এ জন্য শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং জনশক্তি রফতানিতে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির কর্মকৌশল তৈরি করা প্রয়োজন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- কর্মী ছাঁটাই রোধে দেশের সব কলকারখানা, বেসরকারি ব্যাংক-বীমা, কর্পোরেট অফিস-প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাসহ সরকারের তদারকি ও নজরদারি বাড়ানো। শ্রম মন্ত্রণালয়, কারখানা, অধিদফতর, গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা। সংকটাপন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাই না করে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের খাত পুনঃসমন্বয় করা।
এ ক্ষেত্রে যাদের বেতন ২০ হাজার টাকা বা তার বেশি, তাদের বেতন ১০ ভাগ কমিয়ে দেয়া। বিদেশ ফেরত কর্মহীন কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বল্প খরচে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। অন্য দেশ থেকে নতুন ক্রয়াদেশ পেতে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইসহ কারখানা মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। সরকার ঘোষিত শিল্পঋণের প্রণোদনা প্যাকেজ মালিকরা যাতে যথাযথভাবে ব্যবহার করে এবং নিজ স্বার্থে তা ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা।
করোনার প্রভাবে কর্মহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে তাদের ত্রাণের আওতায় আনা। ছাঁটাই শ্রমিকদের মধ্যে যারা গ্রামে অবস্থান করছে তাদের স্থানীয় কৃষি প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
কোনো শ্রমিক সংগঠন, এনজিও নেতা ও কর্মীরা যাতে শ্রমিকদের বা ছাঁটাই শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেদিকে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখা। ব্যাংক-বীমা, বড় বড় কর্পোরেট অফিসসহ অন্য সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারানোদের ক্রমান্বয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে স্বপদে বহাল করতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।