আল আমিন: আমরা যারা একটু বেড়াতে পছন্দ করি বা থ্রীল-প্রিয় মানুষ, তারা শুনলেই একবারে লাফ দিয়ে উঠবেন সেখানে যাবেন বলে। এমনই একটি জায়গা আছে বঙ্গোপসাগরে। আর সেটা একটা দ্বীপ। দারুণ না? কিন্তু শুনতে যতটা দারুণ লাগছে, বিষয়টা আসলেই অতটা দারুণ নয়। কারণ, এই সুন্দর জায়গাটি আপনার জন্য নয়। আর আপনি আমি কেউ চাইলেই সেই জায়গাটিতে যেতে পারব না। নিশ্চয় এতক্ষণে মনে প্রশ্ন জেগেছে কোথায় সেটি, কী তার নাম? হ্যাঁ, সেটি একটি নিষিদ্ধ দ্বীপ। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে সাগরের তলদেশ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত প্রায় সবখানেই বিজ্ঞানের জয়জয়কার। সেই যুগে এসে এখনো বঙ্গোপসাগরের মতো জায়াগায় একটি দ্বীপ, যা এখনো অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে বলতে হবে। কারণ, এতদিনে এই দ্বীপের সন্ধান পাওয়া গেলেও, দ্বীপটি সম্পর্কে জানা যায়নি উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো তথ্য। দ্বীপটির নাম, সেন্টিনেল দ্বীপ। এটি বঙ্গপোসাগরের বুকেই অবস্থিত। নৃতাত্বিকদের মতে, দ্বীপটির বয়স প্রায় ৬০ হাজার বছর। আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার। যদিও ভৌগলিক অবস্থান হিসেবে এবং কাগজে কলমে দ্বীপটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটির উপর ভারতের আদৌ কোনো কর্তৃত্ব নেই। কারণ অনেকবার চেষ্টা করেও দ্বীপটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি ভারত সরকার। এমনকি বহুবার চেষ্টা করেও তারা এ দ্বীপটিতে ঢুকতে ব্যার্থ হয়েছে। কেউ ঢুকতে গেলেই তারা সেখানকার অধিবাসিদের হিংস্রতার শিকার হয়। ভুল করে কেউ সেখানে প্রবেশ করলেও তাদেরকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। এমনকি হেলিকপ্টারও সেখানে ল্যাণ্ড করতে পারে না।
জানা যায়, ২০০৬ সালে সেন্টিনেল তীরন্দাজরা তাঁদের দ্বীপে অনুপ্রবেশকারী দুই জন জেলেকে তীর মেরে হত্যা করে। পরবর্তীতে সেন্টিনেল তীরন্দাজরা মরদেহ উদ্ধারে আসা হেলিকপ্টারটিকেও তীর মেরে হটিয়ে দেয়। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ঐ জেলেদের মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। যদিও উদ্ধার অভিযানে আসা হেলিকপ্টার থেকে তাঁদের মরদেহ দেখা গিয়েছিলো। কারণ উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারের পাখার ঘূর্ণনে সৃষ্ট প্রবল বাতাদের তোড়ে সেন্টিনেলদের অল্পগভীর কবরের মাটি সরে গিয়ে ঐ দুজন জেলের মৃতদেহ দেখা যায়।
অনিবার্য কারণেই এই দ্বীপের জনসংখ্যা সম্পর্কে নির্ভুল কোনো হিসেবেও পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। সরকারীভাবে যদিও ২০০১ সালে দ্বীপটির ব্যাপারে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্ত সে চেষ্টা অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। অসম্পূর্ণ সেই পরিসংখ্যানে ৩৯ জন বাসিন্দার উল্লেখ পাওয়া যায় দ্বীপটিতে। এরা এতটাই রক্ষণশীল যে, সভ্যতার আলো থেকে সর্বদা দূরেই থাকতে চায়। তাই আধুনিকতার ছোঁইয়া তাদের বিন্দুমাত্রও নাগাল পায় নি। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রথম ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা শুরু করে দ্বীপের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে। আর এই চেষ্টা শুরু হয় ভারতের ট্রাইবাল ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক টিএন পন্ডিতের নেতৃত্বে। যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে দ্বীপটির তীরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপহার যেমন , খাবার, পোশাক ইত্যাদি রেখে আসা হত। কিন্ত তাতে তাদের হিংস্র মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি। দ্বীপের কাছে কোন নৌকা বা উপরে কোন হেলিকপ্টার দেখলেই তীর, পাথর বা বর্শা জাতীয় অস্ত্র ছুড়ে মারত। ১৯৯০ সালের দিকে মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত এরকমই একটি জনগোষ্ঠী “জারওয়া”দের সাথে এক সংঘর্ষে বহিরাগত কিছু মানুষ প্রাণ হারায়।
এই অবস্থায় ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সেন্টিনেল দ্বীপের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা বন্ধ করে দিতে। এবং এছাড়াও আশেপাশের তিন মাইল এলাকার মধ্যে বাইরের পৃথিবীর মানুষের প্রবেশের ব্যাপারেও কড়াকড়ি আরোপ করে দিয়েছে ভারতীয় সরকার। ১৮৮০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলেও দ্বীপটির বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। সেবার দ্বীপের ৬ জন বাসিন্দাকে তুলে আনা হয়। এর মধ্যে চারজন শিশু। প্রাপ্তবয়স্ক দুজনকে দ্বীপ থেকে আনার পরপরই মারা যায়। বাকি বাসিন্দাদের কিছুদিন রাখার পর কোন তথ্য না পেয়ে তাদের ঐ দ্বীপে রেখে আসা হয়। ২০০৪ সালের সুনামিতে দ্বীপটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই বাসিন্দারা সুনামির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে। সুনামির কিছুদিন পরে এক হেলিকপ্টার থেকে দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক কাজে ব্যাস্ত দেখা যায়।
জাতিতে এরা সেন্টিনেলী। অর্থাৎ এদেরকে সেন্টিনেলী জনগোষ্ঠীই বলা হয়। আন্দামানি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে এই সেন্টিনেলী জনগোষ্ঠী। বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই জাতি দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। গ্রেট আন্দামান উত্তর সেন্টিনেলী দ্বীপপুঞ্জে এই জনগোষ্ঠীর বাস। বহিরাগতদের ওপর আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্য তারা বিশেষভাবে পরিচিত। সেন্টিনেলী জাতি মূলত একটি শিকারী-নির্ভর জাতি। তারা তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ শিকার, মাছ ধরা, এবং বন্য লতাপাতার মাধ্যমে সংগ্রহ করে। এখন পর্যন্ত তাদের মাঝে কৃষিকাজ করা বা আগুন ব্যবহারে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
জনসংখ্যায় এরা আনুমানিক ২৫০ জন। যদিও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে সেন্টিনেলীদের জনসংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ধারণা অনুযায়ী এদের জনসংখ্যা সর্বনিম্ন ৩৯ থেকে ২৫০-এর মধ্যে, এবং সর্বোচ্চ ৫০০ পর্যন্ত। ২০০১ সালে পরিচালি ভারতের জনপরিসংখ্যানে ৩৯ জন পৃথক ব্যক্তির উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়, যাদের মাঝে ২১ জন পুরুষ ও ১৮ জন নারী। নিরপত্তাজনিত কারণে এই জরিপটি প্রয়োজনের চেয়েও বেশি দূর থেকে পরিচালনা করা হয়েছিলো এবং এটি সুনিশ্চিতভাবেই ৭২ বর্গকিলোমিটার (১৮,০০০ একর) আয়তনে দ্বীপটির সঠিক জনসংখ্যা নির্দেশ করে না। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সংঘটিত ভূকম্পন ও সংশ্লিষ্ট সুনামির ফলে সেন্টিনেলীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ওপর সৃষ্ট কোনো মধ্যম বা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কথা জানা যায় না। শুধু এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা এই দুর্যোগের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে।
এটি মূলত ভারতের উত্তর সেন্টিনেলী দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত। এদের ভাষার নাম সেন্টিনেলী ভাষা। ধারণা করা হয়, এটি আন্দামানি ভাষাগুলোর একটি। সেন্টিনেলীদের ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না। তাদের সংশ্লিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কেও রয়ে গেছে অজানা, তবে সাধারণত ধারণা করা হয়, এটি অন্যান্য আন্দামানি আদিবাসীদের সাথে সংশ্লিষ্ট, যেমন: ওঙ্গে। সেন্টিনেলদের বাসস্থল এই দ্বীপটি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি অংশ হিসেবে শাসিত হয়, কিন্তু বাস্তবে সেন্টিনেলটা তাঁদের অঞ্চলে, তাঁদের সকল বিষয়ে সর্বপ্রকার স্বাধীনতা ভোগ করে। ভারত সরকারের সম্পৃক্ততার মধ্যে রয়েছে অনিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে দ্বীপটিতে পরিদর্শন অভিযান পরিচালনা করা, এবং সাধারণ জনগণকে দ্বীপটিতে যেতে নিরুৎসাহিত করা। আগেই বলেছি, এটি কাগজে-কলমে ভারত সরকারের অধীনস্থ অঞ্চল হলেও, বাস্তবে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর তাই বর্তমানে দ্বীপটি ভারত সরকারের অধীনে থাকলেও, দ্বীপের অধীবাসীদের জীবনযাত্রায় বহির্জগতের প্রভাবমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্বীপটিতে যেতে বাধা না দেয়া হলেও, ভারত সরকার বিশেষভাবে সতর্ক করে আসছে দ্বীপটিতে প্রবেশের ব্যাপারে।