- গাজার বালিতে আটকে পড়েছে ইসরাইলি বাহিনী: হামাস
- ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল
লণ্ডন, ২২ এপ্রিল: সম্প্রতি গাজা উপত্যকা খান ইউনিসের ফিলিস্তিনি ভিডিও সাংবাদিক মুতাসিম মর্তুজা ইসরাইলি বাহিনী সরে যাওয়ার পর নাসের হাসপাতালে আবিষ্কৃত গণকবরগুলো নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। সেখানে ইতোমধ্যেই তিন শতাধিক লাশ পাওয়া গেছে। সোমবার (২২ এপ্রিল) তিনি এক নারীর ভিডিও প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, সন্তানের লাশ ধরে আছেন এক ফিলিস্তিনি মা। তার এই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি এখানে ঘটনাস্থলের বর্ণনা করেছেন।
খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে আসছেন শত শত মা। তারা তাদের সন্তানদের খুঁজছেন, এক লাশ থেকে আরেক লাশের দিকে ছুটে যাচ্ছেন, প্রতিটি লাশ তারা তন্ন তন্ন করে দেখছেন। তারা তাদের চোখ আর হাত দিয়ে লাশগুলো খতিয়ে দেখছেন। লাশের পরা জামা, ট্রাউজার, জুতাও তারা পরীক্ষা করে দেখছেন, যদি সন্তানের এসব সামগ্রীর সাথে মিলে যায়! গণকবর থেকে উদ্ধার হওয়া তিন শতাধিক লাশের মধ্যে প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। মায়েদের প্রয়োজন একেবারেই সহজ কোনো প্রমাণ। তাদের সন্তানদের চেনার জন্য কোনো প্রমাণ। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। লাশের বেশির ভাগ পরিচিতিই হারিয়ে গেছে। বেশিভাগ লাশই গলে গেছে, চেনার উপায় নেই।
ইসরাইল তিন মাসের জন্য খান ইউনিস অবরোধ করেছিল। গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দক্ষিণ এলাকার চিকিৎসা পরিষেবার ‘মেরুদণ্ড’ এই নাসের হাসপাতাল। এখানে হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিল। ইসরাইলি বাহিনী জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিতে ঘন ঘন হাসপাতালে অভিযান চালায়, পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেয়, স্টাফদের গ্রেফতার করে, হাজার হাজার গৃহহীন লোককে তাড়িয়ে দেয়। চলতি মাসের শুরুর দিকে ইসরাইলি সৈন্যরা সেখান থেকে সরে যায। তারপরই লাশ খোঁজার কাজ শুরু হয়। হাসপাতাল চৌহদ্দির মধ্যে শত শত লাশ পাওয়া যায়। গণকবরগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার প্রথম দিনে ৭০টি লাশ পাওয়া যায়। পরের দিন পাওয়া যায় আরো ৭০ লাশ। মৃত ফিলিস্তিনিদের আন্ডারগ্রাউন্ডে চাপা দেয়া হয়েছিল। অনেককে গাছের নিচে ফেলে রাখা হয়েছিল, কাউকে কাউকে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে রেখে গিয়েছিল তারা। মঙ্গলবার উদ্ধারকারীরা আরো কয়েক ডজন লাশ পায়। ফলে লাশের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩১০।
মৃতের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। তারা যতই খুঁড়ছে, ততই লাশ বের হয়ে আসছে। এমন অনেক জায়গা থেকে লাশ পাওয়া যাচ্ছে, যা কল্পনাও করা হয়নি। অনেক সময় উদ্ধারকারীরা লাশের অংশবিশেষ পাচ্ছে। কিংবা লাশটি এমনভাবে পচে গেছে যে শনাক্ত করার আর কোনো উপায় নেই। গাজা সরকারের মিডিয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, অনেক লাশ শিরোচ্ছেদ অবস্থায় পাওয়া গেছে। অনেকের চামড়া এবং অঙ্গপ্রত্যক্ষ তুলে নেয়া হয়েছে। মৃতদের মধ্যে রয়েছে শিশু, বয়স্কা নারী, তরুণ- সবাই।
উদ্ধারকারী কর্মীরা জানান, তারা তারা এমন লাশও পেয়েছেন, যাদের হাত দুটি তাদের পেছনে বাঁধা ছিল। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার অফিস বলছে, এগুলো ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবতা আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন।’
নাসের হাসপাতালে অনেকে কান্না করছে, অনেকের যন্ত্রণাদগ্ধ হচ্ছে। এমন দৃশ্য প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। কারো তাদের স্বজনের লাশ পাওয়ার অনুভূতি অবর্ণনীয়। মায়েরা যেভাবে তাদের মৃত সন্তানদের চাদরে ঢাকেন, কবর পর্যন্ত সঙ্গী হন, তা প্রকাশ করা যায় না। আমরা সাংবাদিক হিসেবে প্রতিটি দৃশ্য একেবারে নীরবতার সাথে ধরে রাখছি। আমরা কথা বলি না। ছবি তোলার সময় আমাদের কান্নায় রক্ত ঝরে। আমাদের হাতগুলো এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে আমাদের ক্যামেরাগুলো ফোকাস হারিয়ে ফেলে। তবে আমরা আবার শুরু করে, তারপর আবার করি।
গাজার বালিতে আটকে পড়েছে ইসরাইলি বাহিনী : হামাস
গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু ওবায়দা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২০০ দিন ধরে গাজায় হামলা চালিয়ে মৃত্যু আর ধ্বংস ছাড়া ‘শত্রুরা আর কিছুই হাসিল’ করতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, ইসরাইল এখনো ‘তার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার আর পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ গাজা যুদ্ধের ২০০ দিন উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার টেলিভিশনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তিনি এই মন্তব্য করেন।
আবু ওবায়দা ইসরাইল প্রসঙ্গে বলেন, ‘শত্রু গাজার বালিতে আটকে গেছে। লজ্জা আর পরাজয় ছাড়া তারা আর কিছুই অর্জন করতে পারবে না। ২০০ দিন চলছে। আর গাজায় আমাদের প্রতিরোধ ফিলিস্তিন পর্বতের মতোই অটল রয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূমিতে যতক্ষণ দখলদারের আগ্রাসন থাকবে, আমাদের আঘাত আর প্রতিরোধ আমরা অবশ্যই অব্যাহত রাখব। দখলদার বাহিনী বিশ্বকে বোঝাতে চাচ্ছে যে তারা সকল প্রতিরোধ গ্রুপকে নির্মূল করেছে। এটা একটি ভয়াবহ মিথ্যা।’
ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল
ফিলিস্তিনপন্থী এবং ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করে সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, তাতে এখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও অংশ নিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, এমআইট, টাফটস ইউনিভার্সিটি, ইমারসন কলেজসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভকারীরা তাঁবু টাঙ্গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। কোনও কোনও ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে ‘নদী থেকে সাগর পর্যন্ত’ সাইনও দেখা যায়। উল্লেখ্য, এ দিয়ে ফিলিস্তিনিরা জর্ডান নদী থেকে সাগর পর্যন্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বুঝিয়ে থাকে। এমআইটিতে বিক্ষোভকারীরা গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতার সমালোচনা করে। তারা ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সাথে এমআইটির সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিও জানায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে এবং লস অ্যাঞ্জেলসের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁবু খাঁটিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।
সবচেয়ে তীব্র বিক্ষোভ হচ্ছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বানার্ড কলেজের সাথে সম্পর্কিত প্রখ্যাত রাব্বি ইলি বুচলার ‘চরম সেমিটিজম বিরোধিতার’ কারণে ইহুদি শিক্ষার্থীদেরকে বাড়িতে অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সোমবার ভার্চুয়াল ক্লাসে অংশ নিয়েছেন। এভাবে গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভের পর নিউইয়র্ক সিটি ক্যাম্পাসে উত্তেজনা প্রশমনের আশা করছে কর্তৃপক্ষ। সোমবার এক বিবৃতিতে কলম্বিয়া প্রেসিডেন্ট নেমাত মিনুচে শফিক বলেন, সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া ইহুদিবিদ্বেষী ভাষা, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানিমূলক আচরণের নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে ক্লাস বাতিল করছে। শফিক বলেন, “এসব উত্তেজনা কলাম্বিয়ার সাথে যুক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে এবং যারা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা পূরণ করতে ক্যাম্পাসে এসেছেন তাদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে।” গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের একটি শিবির খালি করার জন্য শফিক নিউইয়র্ক পুলিশকে অনুমতি দেওয়ার পরে বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়।