- আইনজীবী ও সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া।
- প্রতিনিধি নিয়োগে যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন।
লন্ডন, ১৯ মার্চ: গত ১২ মার্চ, বুধবার দৈনিক মানবজমিন এ ‘অবশেষে বৃটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পেলেন আলোচিত শামীমা বেগম’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, “অবশেষে বৃটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছেন আলোচিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে তার নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ১২ মার্চ, বুধবার বৃটিশ মানবাধিকার সংগঠন ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এন ৩ ও জেডএ বনাম যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (২০২৫) ইউকেএসসি-৬ মামলার শুনানির পর আদালত এই রায় দেন। এর ফলে শামীমা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে আবারও বৃটিশ নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন।”
দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক ইনকিলাব, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক কালের কন্ঠসহ দেশের প্রায় প্রতিটি কাগজে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি পূর্ব লন্ডন থেকে প্রকাশিত স্থানীয় সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা ‘ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পেলেন সেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা’ শিরোনামে সংবাদটিকে লিড নিউজ হিসেবে প্রকাশ করেছে। সংবাদে বলা হয়েছে, “অবশেষে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম। দুই ব্রিটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার মামলার আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট শামীমা ও অন্য আবেদনকারীর পক্ষে রায় দেন। ব্রিটিশ মানবাধিকার সংগঠন ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ এক বিবৃতিতে বিষয়টি জানিয়েছে। এন-৩ ও জেডএ বনাম যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (২০২৫) ইউকেএসসি-৬ মামলায় শামীমার পক্ষে রায় দেন আদালত। এ মামলা ছিল মূলত জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় এ দুই ব্রিটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল সম্পর্কিত আদেশ নিয়ে। বিবাদীপক্ষ যুক্তি দিয়েছিল যে এই সিদ্ধান্ত (নাগরিকত্ব বাতিল) তাদের রাষ্ট্রহীন করে তুলবে না। কারণ তারা ব্রিটিশ ও বাংলাদেশি দ্বৈত নাগরিকত্বধারী। এ মামলায় পরে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে, এ আদেশ প্রত্যাহারের ফলে আপিলকারীদের পুরো সময়জুড়ে ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই গণ্য করতে হবে। অর্থাৎ শামীমা অতীতে ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন, এখনো আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন।”
অর্থাৎ, প্রতিটি কাগজ সংবাদের সূত্র হিসেবে বৃটিশ মানবাধিকার সংগঠন ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ এর বিবৃতি’র কথা উল্লেখ করেছে। এবিষয়ে সাপ্তাহিক সুরমা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ কোন মানবাধিকার সংগঠন না। তারা এরকম কোন বিবৃতি দেয়নি। তারা এমন কোন বিষয়ে কোন বিবৃতি দেয় না। এটা কোন বিষয়ে বিবৃতি দেয়ার ওয়েবসাইট না। এটি একটি ব্যাক্তিগত ব্লগ সাইট। এই ব্লগ সাইটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রচারণা চালানো নয়, বরং এখানকার ব্লগাররা প্রায়শই অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়গুলিতে যুক্তির নিরিখে উভয় পক্ষকে উপস্থাপন করেন। ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ মানবাধিকার থেকে শুরু করে জনসাধারণ, চিকিৎসা এবং পরিবেশগত আইন পর্যন্ত বিভিন্ন আইনি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট করে থাকে।
বাংলা কাগজগুলি তাদের সংবাদে যে কেইস রেফারেন্সের কথা উল্লেখ করেছে ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ এ ‘Supreme Court rules Appellants were British all along’ শিরোনামে শাহীন রহমানের এই লেখাটা ছিলো তেমনই একটি পোস্ট। যেখানে তিনি ‘N3 & ZA v Secretary of State for the Home Department [2025] UKSC 6’ মামলার পর্যালোচনা করতে গিয়ে শামীমা বেগমের মামলায় একজন পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। উক্ত মামলার ‘Judgment’ এর একটি কপি সাপ্তাহিক সুরমা’র হাতে এসেছে। ‘Judgment’ এ আপিলকারীদের নাম উল্লেখ করা না হলেও, এমনটি মামলাটি অনেকটা শামীমা বেগমের মামলার মত হলেও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এটি আসলে শামীমা বেগমের মামলা নয়। এই মামলাটি ছিল মূলত শামীমা বেগমের মত জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দুই বৃটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়ে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে শামীমা বেগমের মত উক্ত দুই বৃটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। এরপর সুপ্রিম কোর্টে “N3 এবং ZA বনাম Secretary of State for the Home Department (2025) UKSC6” চূড়ান্ত আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে একটি যুগান্তকারী রায় আসে, যেখানে বলা হয়, উক্ত দুই বৃটিশ নাগরিক নাগরিকত্ব কখনো হারাননি এবং তাঁরা এখনও বৃটিশ নাগরিক।
গত ১৯ নভেম্বর ২০২৪, দুই বৃটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার মামলার চূড়ান্ত আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এই মামলার দীর্ঘ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিন মাস পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, বুধবার বৃটিশ সুপ্রিম কোর্ট উক্ত রায়ে দুই নাগরিকের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ উক্ত রায়ের মাধ্যমে আপিল আবেদনকারী উক্ত দুই বৃটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের ফলে তার বৃটিশ নাগরিকত্ব পুরো সময়ের জন্য কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে, এই প্রত্যাহারের ফলে আপিলকারীদের সারা জীবন ধরে বৃটিশ নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে।
সাপ্তাহিক সুরমা’র পক্ষ থেকে উক্ত মামলা ও পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে মতামত জানতে দু’জন বৃটিশ বাংলাদেশি বিজ্ঞ আইনজীবী ও দু’জন বৃটিশ বাংলাদেশি বিজ্ঞ সাংবাদিকের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হয়েছিলো। ‘Judgment’ এর কপি ও ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ এ শাহীন রহমানের লেখা পড়ে ‘লিংকন্স চ্যাম্বারস সলিসিটরস’ এর প্রিন্সিপাল ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ বলেছেন, “বৃটেনের সর্বোচ্চ আদালতের সাড়া জাগানো এই রায়ের ফলে শামীমা বেগমের বৃটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পাবার পথ সুগম হলো। এই রায়ের ফলে স্বয়ংক্রীয়ভাবে তিনি পেয়ে যাবেন এমনটি বলা যাবে না। তাকে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব যে প্রক্রিয়ায় বাতিল করা হয়েছে সেটা যথাযথ হয়নি। শামীমা বেগম অপরাধ করলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। কিন্তু যেনতেনভাবে নাগরিকত্ব বাতিল গ্রহণযোগ্য ও আইনসিদ্ধ নয়। আইনগতভাবে বৃটিশ সরকার তার বৃটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে না যদি এই বাতিলের কারণে ঐ নাগরিক রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। স্টেটলেস কনভেনশনও তাই বলে যার দস্তখতি রাষ্ট্র হচ্ছে বৃটেন। দস্তখতি রাষ্ট্র হিসেবে বৃটিশ সরকার এই কনভেনশন মানতে বাধ্য। শামীমা বেগম কোনদিন বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন না, কোনদিন আবেদনও করেননি, ভবিষ্যতে করবেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ সরকারও তখনই জানিয়ে দিয়েছিল যে আবেদন করলেও শামিমা বেগমকে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। এমন অবস্থায় শামীমা বেগমের বৃটিশ নাগরিকত্ব বাতিল ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ, কেননা তাতে তিনি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েন। শামীমা বেগমের প্রতি বৈষম্য ও অন্যায় করা হয়েছে। শামীমা বেগম যদি মুসলিম না হয়ে অন্য ধর্মের অনুসারী হতেন অথবা সাদা চামড়ার ব্যক্তিত্ব হতেন তাহলে তার প্রতি এমন বৈষম্য ও অন্যায় করা হতো না বলে আমার বিশ্বাস।”
‘Judgment’ এর কপি ও ‘ইউকে হিউম্যান রাইটস ব্লগ’ এ শাহীন রহমানের লেখা পড়ে ‘এমএইচ ব্যারিস্টারস’ এর প্রিন্সিপাল ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসাইন বলেছেন, “Supreme Court refused Begum’s final attempt for permission to appeal on 7 August 2024. At the present time she was trying to go to ECHR. So, I can’t match the decision of the SC provided by the link you provided to the facts of Shamima.” অর্থাৎ, তিনি বলেছেন, “৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট শামীমা বেগমের চূড়ান্ত আপিলের অনুমতির প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করেছে। বর্তমানে তিনি মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরোপীয় কনভেনশন (ইসিএইচআর) এ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই, শামীমার তথ্যের জন্য আপনার দেওয়া লিঙ্কটি দিয়ে আমি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছি না।”
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’ সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেছেন, “যারা এই নিউজটি করেছেন তারা হয়তো বুঝতে ভুল করেছেন। আমরা সাংবাদিকরা আইন-আদালতসহ বিভিন্ন সেক্টরের খবর সংগ্রহ করি। যেসব বিষয়ে আমরা ভালো না জানি বা না বুঝি সেসব বিষয়ে যেনো অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করি। সংবাদের জন্য আমরা অনেক সময়ই দেশের কাগজের ওপর নির্ভর করি। কিন্তু স্থানীয় সংবাদের জন্য আমরা যেনো একটু পরিশ্রম করি এবং যথাযথ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করি।”
‘সাপ্তাহিক সুরমা’ সম্পাদক শামসুল আলম লিটন বলেছেন, “সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সূত্র এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে শুধুমাত্র সূত্রের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে খবর তৈরি করার ফলে অনেকেরই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরিনামে সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে পতিত হতে পারে। শামীমার ক্ষেত্রে তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে যেভাবে খবর করা হয়েছে তা রীতিমতো গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহ ও পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে। অনেক দেশেই এভাবে তথ্য প্রবাহের কারণে এই বিভ্রান্তিগুলো এখন ব্যক্তি ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে জন্য সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে এবং দায়িত্বশীল হতে হবে গণমাধ্যম এবং তার গেট কিপারদের।”
প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে ঢাকার কয়েকটি কাগজের সাথে যোগাযোগ করলে তারা দু:খ প্রকাশ করে বলেছেন, “নিউজটি তাদের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধিরা পাঠিয়েছেন।” ফলে গণমাধ্যমে শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার সংবাদে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরী হওয়ার প্রেক্ষিতে পত্রিকার প্রতিনিধি নিয়োগে যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন ওঠেছে।