গ্যাসের জরাজীর্ণ লাইন, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগের কারণে ঘটছে একের পর এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা; ঝরছে জীবন। অথচ তিতাসসহ অন্যান্য গ্যাস কোম্পানির স্থাপিত ২৪ হাজার ২৮৭ কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে ১৭ হাজার কিলোমিটারের মেয়াদ অন্তত ২০ বছর আগেই পেরিয়ে গেছে। যা পরিবর্তন অতি জরুরি হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। এছাড়া অবৈধ সংযোগ ও লাইন স্থাপনে গ্যাসলাইন নেটওয়ার্ক ভীষণভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও সেদিকে কারও নজর নেই।
ফলে ঝুঁকিপূর্ণ লাইন থেকে গ্যাস লিকেজ হয়ে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। তিতাস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে গ্যাসলাইন বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে ৯৫৩টি। এসব দুর্ঘটনায় মৃতু্য হয় ২০ জনের। ২০১৯ সালে প্রায় এক হাজার দুর্ঘটনায় ৩৫ জন মারা যান। আর চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৬০টি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ১৮ জনের। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ মসজিদে গ্যাস বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২২ জন মারা গেছেন।
সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর আবাসিকসহ সব ধরনের পুরানো গ্যাস পাইপলাইন সরিয়ে নতুন করে পাইপ স্থাপন, গ্যাস নেটওয়ার্কের ত্রম্নটি সংশোধন এবং নেটওয়ার্ক ডিজিটাল জিআইএস নকশা পরিবর্তন করতে গত বছরের প্রথমভাগে ১ হাজার ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস)। প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর সার্বিক কার্যক্রম আশানুরূপভাবে এগোয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ শুরুর আগেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। অথচ তিতাস এ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরপরই এর ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। বিশেষ করে টেন্ডারের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষকে না দিয়ে তিতাসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ ভালোভাবে গ্রহণ করেননি কেউই। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তাদের দিয়ে না করে সেফটি ও সিকিউরিটি মেইনটেনেন্স করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে যোগ্য কোম্পানিকে তা দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ তাদের সে পরামর্শে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
তিতাসের এত বড় কাজ করার সক্ষমতা নেই দাবি করে এ সময় জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেছিলেন, তিতাসের সাত হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে পাঁচ হাজার পুরানো হয়ে গেছে। একের পর এক লিকেজের ঘটনা ঘটছে, বিস্ফোরণ এবং আগুনের ঘটনা ঘটছে। তাদের সে সক্ষমতা থাকলে তারা এ ব্যাপারে আগেই উদ্যোগ গ্রহণ করত।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পর তারা কাজ শুরু করেছে। অর্থাৎ এতদিন তারা বসেছিল। এত বড় কাজের দায়িত্ব সক্ষমতা আছে এমন তৃতীয় পক্ষকে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখা দরকার। তারা এতকাল যেসব কাজ করেছে তার অর্থ দাঁড়ায় সেগুলো তারা অপচয় করেছে। তারা এতদিন যেসব মেরামতের কাজ করেছে এখন তাদের খরচের হিসাব দিতে হবে। তাদের কাজের কোনো স্বচ্ছতা নাই।’ তিনি বলেন, এতদিনের পুরানো পাইপলাইন থেকে নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
এদিকে, শুধু তিতাসেরই নয়, অন্যান্য গ্যাস কোম্পানির দীর্ঘ সরবরাহ লাইনও জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। যা দীর্ঘদিন ধরে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। গ্যাস লাইনের লিকেজসহ অন্যান্য ত্রম্নটি থেকে অগ্নিকান্ড বা বিস্ফোরণে প্রাণহানি এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পর সাময়িক কিছু উদ্যাগ নেওয়া হলেও কদিন না যেতেই সে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে পাইপলাইনের সাহায্যে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়। বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ শুরু ১৯৬৭ সালের দিকে ঢাকায়। এরপর দেশজুড়ে গ্যাসের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাদেশে বর্তমানে গ্যাস নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার ২৮৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে বিতরণ ও সার্ভিস লাইন প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার। এই লাইনের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ হাজার কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা, কুমিলস্না ও চট্টগ্রামের পাইপলাইনের অবস্থা শোচনীয়। ঢাকা বিভাগে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তিতাস গ্যাসের ১২ হাজার ২৫৩ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে সাত হাজার কিলোমিটার। যার ৬৫ শতাংশ অতিঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ২০ বছর থেকে শুরু করে ৪০ বছরের পুরানো বিতরণ লাইনও রয়েছে। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লাইন পাল্টানো হলেও লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম তেমন নেই। ঢাকা ছাড়াও নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং কিশোরগঞ্জে তিতাসের পাইপলাইন আছে। এর মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমাণ বেশি। মূল লাইন থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে সাধারণ পাইপে বাসাবাড়ি ও কারখানায় গ্যাস নেওয়া হয়। এসব অনিরাপদ সংযোগ থেকে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন সময় রাস্তা সংস্কারের কারণে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
বিষয়টি স্বীকার করে বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ঢাকার গ্যাস পাইপলাইনের বেশির ভাগ ৩৫-৪০ বছরের পুরানো। সবগুলোই প্রায় জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। এ শহরে ৫০ বছরের পুরানো পাইপলাইনও রয়েছে।
পেট্রোবাংলার সাবেক একজন চেয়ারম্যান বলেন, তিতাসের ৭০ শতাংশ পাইপলাইনই ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর অধিকাংশের মেয়াদ পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চট্টগ্রাম ও কুমিলস্নার বিতরণ ব্যবস্থার অবস্থাও নাজুক। তিনি বলেন, গ্যাস পাইপলাইনের তেমন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। বিতরণ কোম্পানিগুলো তাকিয়ে থাকে প্রজেক্টের দিকে। এছাড়া ২০১০ সাল থেকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় বেড়েছে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা। সরকারও বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগকে নিরুৎসাহিত করছে। এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিতরণ নেটওয়ার্কের দিকে নজর কম। ফলে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা জানান, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়, যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়া যায়। এই কার্যক্রম এখন বন্ধ রয়েছে। ফলে লিকেজ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়লেও কেউই তা জানতে পারছে না। পাইপ লাইনে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো থাকলে নারায়ণগঞ্জ মসজিদে এ দুর্ঘটনা ঘটতো না বলে মনে করেন তারা।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির ডিজিএম প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া জানান, কোথাও লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে এসে যদি কোনো বদ্ধ জায়গায় জমা হতে হতে তার পরিমাণ বাতাসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হয়, তাহলে আগুন ধরার পরিবর্তে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরিমাণ ২০ শতাংশ পেরোলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জ মসজিদে হয়তো প্রথম কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
তিতাসের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঢাকায় চাইলেও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসলাইন পুরোপুরি পাল্টানো খুবই দুরূহ কাজ। কারণ এত দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সিস্টেম একবারে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আবার অনেক এলাকায় স্থাপিত লাইনের ওপর রাস্তা কয়েকগুণ উঁচু হয়েছে। আর এই বিপুল পরিমাণ লাইন প্রতিস্থাপন অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক নয়। তাই হয়তো এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে না।
তিতাস গ্যাসের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের জিএম ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার বলেন, ঢাকা ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কে যে গ্যাসলাইন বসানো হয়েছে তার বয়স প্রায় ৬০ বছর। রাস্তা সরু হওয়ার কারণে অন্য ইউটিলিটি সার্ভিসগুলো একই জায়গায় চলে এসেছে। এতে গ্যাস লাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বাসাবাড়ির সামনে এক ইঞ্চি যে লাইন থাকে সেগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, মানহীন চোরাই গ্যাসলাইন থেকেও বিপদ বাড়ছে স্বীকার করে তিতাসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, রাতের আঁধারে চোরাই লাইন নেওয়ার সময় কেউ পাইপের মান নিয়ে মাথা ঘামায় না। ফলে তা থেকে দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। চোরাই লাইন সরিয়ে না ফেললে গ্যাস লিকেজ থেকে অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রধান বিস্ফোরণ পরিদর্শক মো. সামসুল আলম বলেন, মাটির নিচ দিয়ে বা মাটির ওপর দিয়ে যে পাইপলাইনগুলো যাচ্ছে সেগুলো ওয়েল্ডিং করা হয়। ওয়েল্ডিংয়ের জায়গায় কোনো লিকেজ হয়েছে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করা জরুরি।
তবে, দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য স্থাপনার মালিক ও ব্যবহারকারীকেই সতর্ক থাকতে বলছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। অন্যদিকে, বাসাবাড়ির দুর্ঘটনার দায় নিতে চায়না তিতাস। এ প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার বলেন, বাসার চুলা থেকে গ্যাস লিক হচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব বাড়ির মালিক বা ইউজারের। যিনি রান্না ঘরের মালিক তিনি দেখবেন বাড়ির গ্যাসের লাইন লিক হচ্ছে কি না। উৎসঃ যায়যায়দিন