আজ ১১ জানুয়ারি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ও ঘটনাবহুল একটি দিন। ঠিক ১৩ বছর আগে ২০০৭ সালের এই দিনে দেশের রাজনীতির এক সন্ধিক্ষণে কথিত ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের আবির্ভাব ঘটেছিল। যার জের ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ও হানাহানি শুরু হয়। এ অবস্থার অবসান ঘটে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। একইসঙ্গে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দিয়ে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। এই সরকার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে ২ বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন দেয়। এরমধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের অবসান ঘটে।
১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল আসে। জরুরি ক্ষমতার আওতায় দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। শুরুতে মানুষ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করলেও এক সময় তাতে ভাটা পড়েগ এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জোরালো হতে থাকে।
গোটা দেশে যখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তখন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বিকেলে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কানাডীয় হাইকমিশনারের বাসভবনে বৈঠকে বসেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপিয় কমিশন ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা। সেখানেই প্রতিনিধিরা বিএনপি নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
একইদিন ওই বৈঠকের আগে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা সেই বৈঠকে অংশ নেন। এরপর বঙ্গভবনে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন।
বঙ্গভবনে ওই বৈঠক শেষে বিমান বাহিনী প্রধান, নৌ বাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাব, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)’সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সেনাসদরে বৈঠক করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ।
ওইদিনই সন্ধ্যার পর উপদেষ্টাদের বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি। এরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। সঙ্গে অন্য উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেন।
সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির স্বার্থে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই জরুরি অবস্থা কার্যকর হয়। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরী ও জেলা শহরে কারফিউ ঘোষণা করা হয়।
ওইদিন গভীর রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর পরদিন ১২ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ফখরুদ্দীন আহমদ।
দেশের শীষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তখন ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের এই পটপরিবর্তনে তুমুল অস্বস্তির জন্ম দেয়। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই দুই বছর রাজনৈতিক দলে অনেক ‘ভাঙা-গড়া’ দেখে দেশের মানুষ।
ওই সময়ে দুর্নীতির মামলায় দেশের বহু রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। এক পর্যায়ে দেশের দুই শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও গ্রেফতার হন। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের পায়তারা শুরু হয়। যদিও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের মুক্তির মধ্য দিয়েই দেশের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে এগোয় ফখরুদ্দীন সরকার।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেইসব কঠিন দিনগুলোতে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে দেশের ছাত্রসমাজ। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে সেনা সদস্য কর্তৃক ছাত্র লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশজুড়ে ছাত্রবিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
ওই ঘটনায় তখন ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের সাজা হলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।
শুরুর দিকে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকলেও পরবর্তীকালে সেই অবস্থান থেকে দলটি ফিরে আসে। অপরদিকে বিএনপি শুরু থেকেই মনে করে, তাদের দলকে ধ্বংস করার জন্যই এই ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের আবির্ভাব।
ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার প্রায় ২ বছর পর দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে জনমনে তখন আশার সঞ্চার হয়েছিল, দেশের রাজনীতিতে হয়তো গুণগত পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। উল্টো দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের প্রতি একটা ‘অসহনীয় অবস্থান’ তৈরি হলো।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর গত প্রায় এক যুগ ধরে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ সরকার। ইতোমধ্যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে শেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অপরদিকে গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখতে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। গত ১২ বছর ধরেই ১১ জানুয়ারি দিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে বিএনপি।





