শফিকুল ইসলাম কাজল: আসামের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও গায়ক জুবিন গার্গের মৃত্যুকে ঘিরে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা একাধিক কড়া এবং বিতর্কিত মন্তব্য করে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন। সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমি যদি আজ ইস্তফা দিই, তাহলে ৫০% বিক্ষোভ বন্ধ হয়ে যাবে। আর গৌরব গগৈ মুখ্যমন্ত্রী হলে বাকি ৫০% আন্দোলনও শেষ হয়ে যাবে।” মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
বিক্ষোভের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য জুবিনকে ন্যায়বিচার দেওয়া নয়।” মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এই আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক প্ররোচনা রয়েছে, এবং এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাঁর কথায়, “জুবিনকে যারা সত্যি ভালোবাসতেন, তারা তাঁর জীবদ্দশায় পাশে ছিলেন। কিন্তু এখন এমন একটা অংশ রাস্তায় নেমেছে যারা একসময় তাঁর কাজ নিয়েই সমালোচনা করত। এই ভণ্ডামি মেনে নেওয়া যায় না।”
সম্প্রতি বাকসা জেলায় ঘটেছে একাধিক সহিংস ঘটনা, যার সঙ্গে জুবিন গার্গের মৃত্যু-পরবর্তী আন্দোলনের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, পরিস্থিতির কারণে অনেক স্থানীয় যুবক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, “যদি তারা স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে এসে নিজেদের বক্তব্য দেয়, তবে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেবে না।”
এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, “কিছু নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যম অতিরঞ্জিত ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করছে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।” তিনি জনগণকে আহ্বান জানান যেন তারা শুধুমাত্র প্রমাণভিত্তিক খবরেই বিশ্বাস রাখেন।
পরিবেশ সংক্রান্ত একটি বিতর্কের উত্তর দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, জুবিন গার্গ যে অঞ্চলে গাছ কাটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে কোনও গাছ কাটা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি নিজে জুবিনকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে একটি গাছও কাটা হবে না। এখনও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “গাছ কাটা সংক্রান্ত খবর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
জুবিন গার্গের শিল্প ও সাংস্কৃতিক অবদানকে সম্মান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “সরকার তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলি শেষ করবে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে একটি করে সংগীত বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। পাশাপাশি, রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জুবিন গার্গের মূর্তি বসানো হবে।” সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বহু সংস্কৃতিকর্মী ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন।
আইনগত দিক থেকেও মুখ্যমন্ত্রী জনগণকে আশ্বস্ত করেন যে, এই মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চলেছে। তিনি বলেন, “সরকার যদি কোথাও ভুল করে, আদালত তা সংশোধন করবে। উচ্চ আদালত ইতিমধ্যে তদন্ত গ্রহণ করেছে। শীঘ্রই পুলিশের রিপোর্টও আদালতে জমা পড়বে।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, এই মামলাটি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দ্রুত শুনানির জন্য পাঠানো হয়েছে। তিনি আসামবাসীকে আহ্বান জানান, “ধৈর্য ধরুন ও ভারতের বিচার ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস রাখুন।”
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার এই মন্তব্য ও অবস্থান স্পষ্টতই রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। তাঁর বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে যে সরকার জুবিন গার্গের মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টি হওয়া আবেগকে রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবে দেখছে এবং তা মোকাবিলায় প্রস্তুত। তবে, মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য—বিশেষ করে ইস্তফা ও গৌরব গগৈ সম্পর্কিত মন্তব্য—রাজনৈতিক মহলে নতুন করে উত্তাপ সৃষ্টি করেছে।
রাজ্যের সংস্কৃতি জগতের অন্যতম আইকন জুবিন গার্গের মৃত্যু তদন্তের যথাযথ ও বিশ্বাসযোগ্য সমাধান যদি না আসে, তবে এই উত্তেজনা আগামী দিনে আরও ব্যাপক আন্দোলনে রূপ নিতে পারে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।