শিরোনাম
বুধ. ডিসে ১০, ২০২৫

জুলাইয়ের হাওয়া বইছে একুশে বইমেলায়!

ঢাকা অফিস- স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত বইমেলা প্রাঙ্গন। এপাশ থেকে একজন বলছেন, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’ তো অন্যপাশ থেকে এক মা বলে উঠছেন, ‘হামার বেটাকে মারলু ক্যানে?’ আক্ষরিক অর্থে বইমেলায় এসব স্লোগান বা আন্দোলন কিছুই হচ্ছে না, তবে মেলার সর্বত্রই যেন বয়ে চলেছে জুলাই আন্দোলনের হাওয়া!

একুশে বইমেলা মানেই ১৯৫২ সাল, ভাষা আন্দোলন, আর ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদরা। তবে এবার একটু ব্যতিক্রম। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, সাথে জায়গা করে নিয়েছে ‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থান! সজ্জাতেও সে ছাপ একেবারে স্পষ্ট। ব্যানার, ফেস্টুন, গ্রাফিতিসহ নানা রকম আয়োজনে তুলে ধরা হয়েছে জুলাই আন্দোলনকে। যেমন:

‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়

বুক পেতেছি গুলি কর’

অথবা

‘আপস না সংগ্রাম?

সংগ্রাম, সংগ্রাম’

প্রবেশমুখেই এমন সব স্লোগানের পোস্টার, শহীদদের ছবি, দাবি ও অধিকার আদায়ের ফেস্টুন এবং স্বৈরাচারবিরোধী গ্রাফিতি সহজেই নজর কাড়ে যে-কারও। পুরো মেলাজুড়ে যেন জুলাইয়ের আবহ। শুধু তা-ই নয়, স্টলগুলোর থিম এবং ‘জুলাই চত্বর’ স্থাপন করে অভ্যুত্থানের চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে নান্দনিকভাবে। আর এসব সজ্জায় রং হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লাল, কালো ও সাদা।

এমন রং বাছাইয়ের গল্পটাই বা কী? উত্তরটা জানালেন বাংলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. সরকার আমিন স্বয়ং। তিনি মেলার আয়োজক কমিটির সদস্য সচিবও। বললেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা প্রধানত তিনটি রংকে প্রাধান্য দিয়েছি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই রংগুলোই থাকছে যত সব ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন বা গ্রাফিতিতে। যেমন, লাল রং হলো বিপ্লব, কালো শোক ও সাদা শান্তির প্রতীক। তাছাড়া আমরা চেয়েছি জুলাইয়ে যারা আহত বা শহীদ হয়েছেন, তাদের কথাও যেন সজ্জায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে।’

বইমেলা নিয়ে আলাদা করে পরিচালনা কমিটি আছে বাংলা একাডেমির। সেখানেই সবার পরামর্শে ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ থিমে সজ্জার প্রস্তাব পাশ হয়। মেলার এমন সজ্জা মানুষের কাছে এত ইতিবাচক হয়ে ধরা দেবে সেটি হয়তো তারাও কল্পনা করেননি। কথায় কথায় জনসাধারণের কাছে সজ্জার জনপ্রিয়তার কথা তুলে ধরলেন ড. আমিনও। মানুষের ইতিবাচক সাড়ার মাঝে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য না আসার কথাও জানা গেল তার মুখে।

বইয়ে বইয়ে জুলাই

জুলাই অভ্যুত্থান থিমে সজ্জিত বইমেলা। সেখানে প্রকাশক বা লেখকরাও পিছিয়ে থাকবেন কেন! স্টলে স্টলে অভ্যুত্থান সম্পর্কিত বই ও সামগ্রীও তাই মেলার অনন্য সংযোজন। আবার ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে কিনছেন সেসব।

কেমন চলছে জুলাই বিপ্লবের বই? উত্তর জানতে কথা হয় ঐতিহ্য প্রকাশনীর এক বিক্রেতার সঙ্গে। জানালেন, অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জুলাই অভ্যুত্থান-কেন্দ্রিক বই কেনাবেচা। এমনকি দিনের বেস্টসেলিং বইয়ের তালিকায়ও নাম লেখাচ্ছে এসব বই। আবার কিনছেন যারা, তাদের বেশিরভাগই তরুণ। ভিন্ন ভিন্ন স্টলে ভিন্ন ভিন্ন জুলাই অভ্যুত্থান-কেন্দ্রিক বই। প্রথমার কথাই ধরা যাক। এই প্রকাশনীতে জুলাই নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তিনটি বই। ‘জুলাই’, ‘ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান’ এবং আসিফ নজরুলের লেখা ‘শেখ হাসিনার পতনকাল’। স্টলের এক নারী বিক্রেতা জানালেন, তিনটি বইয়ের মধ্যে ‘শেখ হাসিনার পতনকাল’-এর বিক্রি সর্বাধিক। তাছাড়া অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এসব বইয়ের অধিক বিক্রির ব্যাপার তো আছেই৷  ঐতিহ্য প্রকাশনীও জুলাই আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ করেছে একাধিক বই। এর মধ্যে ফারজানা মাহবুবার লেখা ‘হ্যাশট্যাগ জুলাই’ এবং সাব্বির জাদিদের লেখা ‘একটি গোলাপের জন্য’ এখন পর্যন্ত বেস্টসেলার। অন্য বইগুলোও হয়েছে জনপ্রিয়।

আবার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ ও ’36 Days of July’ শিরোনামের বই দুইটি প্রকাশিত হয়েছে স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনী থেকে। এর মধ্যে ’36 Days of July’ বইটি জুলাই-কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ সংকলন। কাজী জহিরুল ইসলাম ও মুক্তি জহিরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বইটি। এই বইয়ের বিক্রিও তুঙ্গে বলে জানান স্টলে কর্মরত এক নারী বিক্রেতা।  তাছাড়া আগামী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা ‘জুলাই ক্যালাইডোস্কোপ’ বইটিও আছে পাঠকদের পছন্দের তালিকায়।

ডাস্টবিনে স্বৈরাচারের মুখ। মানুষ ঘৃণাভরে ময়লা ফেলছে তাতে। এই দৃশ্যের দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে একুশে বইমেলার বাংলা একাডেমি অংশে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্টলের পাশে দুটি ডাস্টবিন বেশ আলোড়ন তুলেছে। স্টলটিও প্রশংসিত হচ্ছে বেশ।

বইয়ে আর সজ্জায় স্টলটি সম্পূর্ণ জুলাইকেই ধারণ করেছে—এমনটি বললে বোধহয় ভুল হবে না। ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ অঙ্কিত এ স্টলেই পাওয়া যাচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা বইয়ের অধিকাংশ। স্টলের সার্বিক ব্যবস্থাপক রাকিবুল হাসান রাজ জানালেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো শহীদ পরিবারের সদস্যরা আসেন। তারা এখানে সময় কাটান, বই কিনেন। আবার দেখবেন জুলাইয়ের স্মৃতি ডায়েরিতে অনেকেই লিখে রাখছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথাও!’

রাজ আরও জানালেন, মেলার শুরুতে জুলাইভিত্তিক বইগুলো আহ্বান করেছিলেন তারা। তাতে সাড়া দিয়ে অসংখ্য লেখক তাদের বই, সাময়িকী, সাহিত্য পত্রিকা দিয়ে গেছেন। এখনও প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বই । বিক্রিও বেশ ভালো। আবার আলাদা করে উল্লেখ করলেন কিছু বইয়ের নামও। ‘ছাব্বিশের গণঅভ্যুত্থান’, ‘রক্তাক্ত জুলাই’, ‘জুলাইয়ের গল্প’ নামক বইগুলোই বিক্রি হচ্ছে অধিক।

আবার মেলার এ অংশেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একটি স্টলে পাওয়া যাচ্ছে গণঅভ্যুত্থানভিত্তিক পোস্টার। মূলত আন্দোলনের সময় শিল্পী ও লেখক দেবাশীস চক্রবর্তীর আঁকা বিভিন্ন পোস্টার নিয়েই শিল্পকলা একাডেমির এই উদ্যোগ। দুটো সাইজে পাওয়া যাবে সেসব—ছোট এবং বড়। এখানে বড় আকারের পোস্টারের দাম ২০০ টাকা, ছোট ছোট পোস্টারের একটি প্যাকেজ রয়েছে, যার দাম ৩০০ টাকা। এছাড়া বিনামূল্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থানের নানা ঘটনা দেখার সুবন্দোবস্তও রয়েছে এই স্টলে।

৩৬ জুলাই ফটো বুথ

এখানেই শেষ নয়। সাধারণের জন্য জুলাইয়ের স্মৃতিকে আরও একবার স্মরণ করার সুযোগও করে দিয়েছে মেলা কর্তৃপক্ষ। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে বইয়ের স্টল। তবে কাছে এলে বোঝা যাবে, রঙিন স্লোগান অঙ্কিত স্টলটি আসলে একটি ফটো বুথ। জুলাই অভ্যুত্থানকে ছবিতে ধরে রাখতেই এমন উদ্যোগ। বুথটির নামও তাই ‘৩৬ জুলাই’।

ফটো বুথের ভেতরে অঙ্কন করা হয়েছে দুহাত প্রসারিত আবু সাঈদের ছবি৷ সামনে ও দুপাশে আন্দোলনের সময়কার নানান ঘটনা অঙ্কিত রয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি, পুলিশি নির্যাতন, ছাত্রলীগ কর্তৃক নিগ্রহের মতো ঘটনাও স্থান পেয়েছে চিত্রে। ওপরের দিকটায় জুলাই অভ্যুত্থানে ব্যবহৃত নানা স্লোগান আর আর লেখা হয়েছে আন্দোলনকালীন জনপ্রিয় কিছু শব্দবন্ধ।

একটি করে ছবি ফ্রেমবন্দী করে নিচ্ছেন। তবে নির্দিষ্ট করে আমাদের নজর কাড়লেন মোহাম্মদ সালাম নামের এক দর্শনার্থী। সালাম এসেছিলেন স্ত্রী আর ছোট কন্যাকে নিয়ে। ছবি তুলে দারুণ উচ্ছ্বসিত তিনি। বললেন, ‘আমার মেয়ের জন্ম আগস্টের ৪ তারিখ। আর অভ্যুত্থান সফল হয়েছে ৫ তারিখ। সে হিসেবে আমার মেয়ে ৩৫ শে জুলাই, আর আমরা ছবি তুলছি ৩৬ জুলাইয়ের সাথে। বড় হলে আমার মেয়েকে এই গল্প শোনাব আমি।’

ছবি তোলার জন্য আরও একটি জায়গায় ভিড় করছেন অনেকে। বইমেলার পুথিনিলয় প্রকাশনীর সামনেই চারদিক ঘুরিয়ে ফেস্টুন লাগিয়েছে মেলার আয়োজক কমিটি। তাতেও আন্দোলনের সময়কার নানা ঘটনার ছবি স্থান পেয়েছে। আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ আন্দোলনে শহীদদের ছবি যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও আন্দোলনের সময় গুলি ছুড়তে থাকা এক সন্ত্রাসীর মুখ আঁকা হয়েছে নেকড়ের মতো করে। যেন বীভৎস হত্যাযজ্ঞ আর হিংস্রতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় দর্শনার্থীদের। সবাই একবার করে হলেও দাঁড়িয়ে দেখছেন এসব পোস্টার। কেউ কেউ আবার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করছিলেন এসব সজ্জা। বলা যায়, জুলাই যেন এবারের মেলার প্রাণ!

একুশে বইমেলা কেবল বই কেনাবেচার জায়গা নয়, এটি ইতিহাসের, সংস্কৃতির, আন্দোলনের চেতনার প্রতিচ্ছবি। এবারের বইমেলায় সেই চেতনা মিশে গেছে একুশের সঙ্গে জুলাইয়ের। হাজার হাজার মানুষ আসছেন, বই কিনছেন, ছবি তুলছে্ন, আন্দোলনের ইতিহাস জানছেন, আর হয়তো প্রতিজ্ঞাও করছেন—’আপস নয়, সংগ্রাম!’

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *