ডিজিটাল ভূমি সেবা চালু হওয়ায় সময় ও অর্থের অপচয় কমেছে। কমেছে ভোগান্তিও। তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি উৎকোচ লেনদেন। অনলাইনের এ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেকেই কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা দালালের দ্বারস্থ হন। অনলাইনে আবেদন করিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তখন সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার ঘটনা ঘটে। কাজ ভেদে পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
জমি সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে চলে যায় দুই-তিন পুরুষ। এর কারণ জটিল ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭৫ শতাংশ মামলাই হয় জমির মালিকানা বিরোধকে কেন্দ্র করে। এ অবস্থার পরিবর্তনে চালু হয় ‘ডিজিটাল ভূমি সেবা’। এতে হ্রাস পেয়েছে ভূমি অফিসে সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি। ভূমি অফিসে সশরীরে যাওয়ার প্রয়োজনও কমেছে। আগের মতো ঘাটে ঘাটে ঘুষ দেওয়ার ঘটনাও কমেছে। বাড়ছে সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টি।
ভূমি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ই-নামজারি, অনলাইন মৌজা ম্যাপ, অনলাইন আরএস খতিয়ান, মোবাইল ফোন ও অনলাইনে ফি পরিশোধের সুবিধা, ভূমি সেবার হট লাইন (১৬১২২) চালু, ভূমি সেবার অ্যাপস চালু করেছে। সর্বশেষ জমি রেজিস্ট্রেশন ও নামজারি কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জমি দলিলের সর্বোচ্চ আট দিনের মধ্যে হবে নামজারি। নামজারির জন্য আলাদা আবেদন করা লাগবে না। এসব উদ্যোগকে ইতিবাচক বলছেন সেবাপ্রার্থীরা।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের কৃষক আলতাব মিয়া। করোনাকালে আর্থিক সংকটে জমি বিক্রি করবেন। কিন্তু নিজের নামে নামজারি ছিল না। নামজারির জন্য তিনি অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদনের ৯ দিনের মধ্যে মোবাইল ফোনে বার্তা আসে ভূমি অফিসে যাওয়ার জন্য। কোনো রকম হয়রানি ছাড়াই ২৭ কর্মদিবসের মধ্যে নামজারি হয়। আলতাব মিয়া বলেন, পাঁচ বছর আগেও ভূমি অফিসের কাজ এত দ্রুত শেষ হতো না। তার বড় ভাই মারা যাওয়ায় পর সম্পত্তি ভাতিজাদের নামে নামজারির জন্য তাকে যেতে হয়েছিল ভূমি অফিসে। সপ্তাহে দুই-তিন দিন উপজেলায় গেলে প্রতিবার কিছু খরচাপাতিও দিতে হতো। প্রায় চার বছর ঘুরে তার আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছিল।
ফরিদগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন আক্তার বলেন, ডিজিটাল ভূমি সেবার কারণে প্রার্থীদের অফিসে যাতায়াত কমেছে। নামজারির জন্য যদি কাগজপত্র ঠিক থাকে ২৮ দিনের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি হয়। প্রান্তিক জনগণ অনলাইন সেবা সম্পর্কে সচেতন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ অবগত। বাকিরা নিজের প্রয়োজনে খোঁজ করতে করতে জেনে নেন।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে একজন সেবাপ্রার্থী মোস্তফা মিয়াজি জানান, ভূমি অফিসের একজনকে দিয়ে তিনি অনলাইনে আবেদন করিয়েছিলেন। এজন্য তাকে কিছু টাকা দিতে হয়েছে। অনলাইনে নামজারি এখন অনেক সহজ, আগের চেয়ে সময়ও কম লাগছে, ভোগান্তি নেই। তিনি বলেন, অনেকে অনলাইন প্রক্রিয়াটি জানেন না বলে দালাল ধরেন। সে ক্ষেত্রে টাকা খরচ করতে হয়।
সাভারের ভূমি কার্যালয়ের একজন সেবাগ্রহীতা জানান, অনলাইনে সেবা হলেও এখনো ঘুষ বন্ধ হয়নি। ভূমি কার্যালয়ের একজনকে দিয়ে আবেদন করিয়েছেন তিনি। এজন্য তাকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তবে উৎকোচ দিতে হলেও খুব কম সময়ে ও ঝামেলামুক্তভাবে নামজারি করতে পেরেছেন বলে জানান তিনি।
সাভারের আশুলিয়া রাজস্ব সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স বলেন, ই-নামজারি এবং মোবাইল ফোন ও অনলাইনে ফি পরিশোধের সুবিধার কারণে এখন দ্রুত সেবা নিতে পারছেন প্রার্থীরা। আবেদন প্রাপ্তির পর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে তাদের মোবাইল ফোনে বার্তা দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে শুনানি শেষে নামজারি করা হয়। কেউ যথাযথ কাগজপত্র না দিয়ে আবেদন করলে তার আবেদন নিষ্পত্তি হতেও সময় লাগবে। এজন্য হয়তো অনেক ভূমি অফিসের লোকজনকে দিয়ে আবেদন করিয়ে নেন।
ভূমি সংস্কার ও অধিকার নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এলআরডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ডিজিটাল ভূমি সেবা ভালো, সন্দেহ নেই। তবে সরকারি কর্মচারীদের ‘সেবাদাতা’ হিসেবে মানসিকতা তৈরি; প্রযুক্তি পরিচালনায় দক্ষতা; প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তিবান্ধব অবকাঠামো স্থাপন এবং সেবাগ্রহীতাদের সচেতন করা গেলে আরও সুফল আসবে।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, ডিজিটাল ভূমি সেবার ফলে ভূমি কার্যালয়ে সাধারণ মানুষের যাওয়ার হার কমছে। সেবার মানও উন্নত করা হচ্ছে। ডিজিটাইজেশনের ফলে ভূমি খাতে দুর্নীতিও কমবে। তিনি বলেন, সার্ভার সমস্যার কারণে অনেক সময় অনলাইন সেবা ব্যাহত হয়। এ ছাড়া নতুন এই পদ্ধতির সঙ্গে সবার পরিচিত হতেও একটু সময় লাগবে। প্রান্তিক পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন ব্রডব্যান্ড চালু না হলে পুরোপুরি ই-নামজারির সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করতে সৌর বিদ্যুত সংযোগের কথা চিন্তা করছি।
সারাদেশে ১০ লাখের বেশি নামজারি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে অনলাইনে। প্রতিবছর প্রায় ৪২ লাখ ভূমি নিবন্ধন হয় এবং উত্তরাধিকারসূত্রে আরও ২০-২৫ লাখ নামজারির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু মালিকানা হালনাগাদ হয় বছরে ৩০-৩৫ লাখ। প্রায় ৩০ লাখ ভূমি হস্তান্তর নামজারি/রেকর্ড হালনাগাদের বাইরে থেকে যায়।





