বইঃ অরিজিন (সাই-ফাই থ্রীলার), লেখকঃ ড্যান ব্রাউন, প্রচ্ছদঃ হেনরি স্টিডম্যান
ভূমিকাঃ বিজ্ঞান কি ধর্মকে অসার করে দেবে? এমন একটা প্রশ্নে বিজ্ঞান আর ধর্ম দুটোর মধ্যে একধরণের প্যারাডক্স তৈরি করে ড্যান ব্রাউনের সাইন্স ফিকশান থ্রীলার উপন্যাস অরিজিন রচিত হয়েছে। রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের আগের চারটার মতো এই বইটিতেও ড্যান ব্রাউনের অতি প্রিয় ফর্মুলা – সিমবোলজিকে কেন্দ্র করে রহস্যের সৃষ্টি, সমাধানের জন্য চেষ্টা, ধর্মকে বিতর্কিত করা এবং অদৃশ্য/অজানা শত্রুর হাতে একের পর এক মানুষ মারা পড়তে থাকার মধ্যে ইঁদুর বেড়াল দৌঁড়ে গল্পের নায়ক রবার্ট ল্যাংডনের পালাতে থাকা, আর সাথে অতি আবশ্যকীয় একজন অতি সুন্দরী সঙ্গিনী, (এটা সম্ভবতঃ বইটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হবে, এমন আশাতেই জুড়ে দেয়া হয়!) যার সাথে তার শুধুমাত্র প্ল্যাটোনিক সম্পর্কই থাকে, প্রেমের পর্যায়ে কখনোই গড়ায় না।
কাহিনী সংক্ষেপঃ গল্পটা শুরু হয় এভাবে। অ্যাডমন্ড কারশ্চ নামের একজন নাস্তিক বিলিয়নিয়ার কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও ভবিষ্যৎবক্তা এমন একটা বিষয় আবিষ্কার করেছেন, যেটা প্রকাশ করা হলে পুরো পৃথিবীর সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাসে এক বিশাল আঘাত হানবে, তার আবিষ্কার প্রমাণ করে দেবে যে বিজ্ঞানের সূত্রগুলি ধরেই প্রকৃতি থেকে আপনাতেই জীবনের সৃষ্টি হয় এবং তার বিবর্তন ঘটতে থাকে, এর জন্য কোন ইশ্বর ধরণের অলীক কিছুর প্রয়োজন হয় না। তিনি তার এই ঐতিহাসিক ঘোষনাটি দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ নাটকীয়তা সৃষ্টি করেন, কারণ তার একটাই উদ্দেশ্য, স্পেনের বিলবাও এ অবস্থিত বিশাল গুগেনহেইম মিউজিয়ামে কয়েক হাজার বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত অতিথির সামনেই শুধু নয়, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যেন এই অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখতে পান।
তার অবিস্মরণীয় এই ঘোষণাটি দুইটা প্রশ্নের উত্তর হিসাবে আসবেঃ একঃ আমরা কোথা থেকে এসেছি, দুইঃ আমরা কোথায় যাচ্ছি। তবে তার ঘোষনাটা দেয়ার পূর্ব মুহুর্তে বিজ্ঞানী কারশ্চ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানেও আততায়ীর গুলিতে মারা যান। কারশ্চ এর শিক্ষক এবং বন্ধু গল্পের নায়ক হার্ভার্ডের সিমবোলজির প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন তার বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে দর্শকদের মাঝেই ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, এবং তার চোখের সামনেই তার অতি প্রিয় ছাত্র ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারা যায়।
কী ছিল কারশ্চের আবিষ্কার? কারা এবং কেন এটা প্রকাশ হতে বাধা দিচ্ছে। ল্যাংডন আর তার সঙ্গীনি সেই মিউজিয়ামের ডাইরেক্টর আমব্রা ভিদাল, যিনি আবার স্পেনের সম্রাটের পুত্র জুলিয়ানের বাগদত্তা, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, তার বন্ধু ও ছাত্র যেটা পৃথিবীকে দেখাতে চেয়েছিল, তারা সেটা অবশ্যই সারা বিশ্বের মানুষের সামনে লাইভ প্রচার করার ব্যবস্থা নেবেন। এবং তাদেরকে এ কাজে পূর্ণ সহায়তা করে অ্যাডমন্ডের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর, তার এক অনবদ্য সৃষ্টি, এক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) সম্পন্ন কম্পিউটার, যার নাম উইনস্টোন। একের পর এক রহস্য ভেদ করে, মৃত্যুকে এড়িয়ে অবশেষে তারা এসে হাজির হন বার্সেলোনায় কারশ্চের সেই বিখ্যাত সুপার কম্পিউটার উইনস্টোনের কাছে, যেখান থেকে সেই ভিডিওটা প্রচার করা যাবে। এবং অনেক বাধা সত্বেও তারা সফলভাবে সেটা সারা বিশ্বের সামনে প্রচার করতে সক্ষম হন।
কারশ্চের লাইভ বক্তৃতার সময় যখন সারা বিশ্বে দর্শকের সংখ্যা দুই মিলিয়নের মতো ছিল, কিন্তু কারশ্চের হঠাৎ মৃত্যু এবং তৎপরবর্তি ঘটনার অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে মানুষের আগ্রহ অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ফলে সেটা একসময় পাঁচশত মিলিয়নে গিয়ে পৌঁছে, ঠিক যে রকমটা কারশ্চ চেয়েছিলেন! তাহলে তার মৃত্যুটা কি তার নিজের ইচ্ছাতেই হয়েছিল, যাতে এত বিশাল সংখ্যক একটা দর্শকের উপস্থিতিতে তার বৈজ্ঞানিক ঘোষণাটা আসতে পারে?
তাহলে তাকে কে হত্যা করেছে? সন্দেহের তালিকায় সম্রাটপুত্র জুলিয়ান, রাজ পরিবারের পুরোহিত ভালদিসপিনো, ক্যাথলিকদের সংগঠন, পালম্যারিয়ান (ক্যাথোলিক বিরোধী) চার্চ, গার্ডিয়া রিয়ালের কমান্ডার গারজা কিংবা অন্য কেউ? কী ই বা ছিল কারশ্চের অভূতপূর্ব সেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যা পুরো পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষের ভীত নাড়িয়ে দেবে?
প্রতিক্রিয়াঃ ড্যান ব্রাউনের গল্পগুলো আমার বরাবরই বেশ ভালো লাগে। দ্য ভিঞ্চি কোডের পর সর্বশেষ ইনফার্নো আর আগের ডিসেপশান পয়েন্ট, আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলির কয়েকটি। তাই অরিজিনের জন্য বিশ্বের অনেক ড্যান ব্রাউন ভক্তের মতোই আমিও প্রবল আগ্রহ নিয়ে এটা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ০৩ অক্টোবর প্রকাশিত হওয়ার পর সেদিনই জনৈক বন্ধুর মাধ্যমে পেয়ে, বেশ ব্যস্ততার মাঝেও সেদিনই পড়া শুরু করেছিলাম। উনি লিখলেই তার বই বেস্ট সেলার হয়ে যায়, তাই তার ২০০ মিলিয়ন বই এ যাবৎ বিক্রি হয়েছে এবং এবার ৪৫টা ভাষায় দুই মিলিয়ন কপি অরিজিন বাজারে এসেছে। এটাও আগেরগুলোর মতোই “নার্ভ র্যাকিং” কিছু একটা হবে, এমনটা আশা নিয়েই অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু অরিজিন পড়ে আমি কেন যেন ড্যান ব্রাউন কিংবা রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে পেলাম না! সম্ভবতঃ সিরিজের একের পর এক শ্বাসরুদ্ধকর পর্বগুলো পড়ার পর প্রত্যাশার পারদটা পরবর্তি লেভেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু সেখানে যেতে পারেনি।
আসলে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু বেশ সীমিত। প্রথম দিকে আততায়ীর হাতে মারা যাওয়ায় কারশ্চ তার যুগান্তকারী আবিষ্কারটা কী, সেটা বলতে না পারায় পাঠকের মনে সেটা জানার জন্য একটা বিপুল আগ্রহ সৃষ্টিতে ড্যান ব্রাউন সফল। কিন্তু প্রায় শেষ দিকে এসে যখন ল্যাংডন আর সুন্দরী আমব্রা সেটা (সাত চ্যাপ্টার ধরে সেটার বর্ণনা রয়েছে) প্রকাশ করলেন, পাঠক হতাশা নিয়ে ভাববেন “এটা?” এটা কীভাবে “পৃথিবীকে উল্টে দেয়ার মতো” খবর হলো? এসবতো ম্যাট্রিক্স ছবিতে কিংবা তারও অনেক আগে আইজ্যাক আসিমভের গল্পে আমরা পড়েছি! এটাতো আজকালকার যুগের আধুনিক ছেলেপুলে সবাইই জানে, এটা কীভাবে এমন যুগান্তকারী একটা আবিষ্কার হলো? আমরা কোথা থেকে এসেছি আর কোথায় যাবো, এই উত্তরটা ৭৬৯ পাতার বই লিখে বিখ্যাত এক ফিউচারিস্ট বৈজ্ঞানিকের মাধ্যমে ড্যান ব্রাউনের জানানোর দরকার ছিল না!
যে কোন পাঠকই মনে মনে এমন কিছু একটা আবিষ্কারের ঘোষণা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকবেন, যেটা আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি। আমিতো ভেবে নিয়েছিলাম, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন কিছু একটা হওয়ার কারণে, শেষ পর্যন্ত হয়তো ওটা পাঠক/দর্শকের কাছে প্রকাশই করা হবে না, “ল্যাংডন আর আমব্রা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল” ধরণের কিছু একটা দিয়ে শেষ করে দেয়া হবে।
ড্যান ব্রাউন যে সত্যিই চার বছর ধরে এই বইটি নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, দুই বছর স্পেনের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে বিলবাও, বার্সিলোনা আর মাদ্রিদের পথে পথে অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেটা তার বিখ্যাত সব স্থাপনা এবং নান্দনিক প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনায় পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। এসব পড়ে একজন পাঠক সে সব জায়গা নিজ চোখে দেখার জন্য আকুলতা অনুভব করবেন, যেমনটা আমি নিজেও করেছি।
তবে বিলবাও এর গুগেনহেইম যাদুঘর, বার্সিলোনার সাগ্রাদা ফ্যামেলিয়া ও এল এস্কোরেইল গির্জা কিংবা এন্টোনি গাউডির কাসা মিলা যাদুঘর ও পার্ক গুয়েল এর সৌন্দর্যের যেমন কয়েক পাতা ধরে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, কিংবা কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র ও সংগঠনেরও একই ধরণের ব্যবচ্ছেদ করেছেন, যেমন স্প্যানিশ ডিক্টেটর জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, জার্মানির দার্শনিক নিয়েতযশে, আর্কিটেক্ট গাউডি, কবি/শিল্পী উইলিয়াম ব্লেক, পালম্যারিয়ান চার্চ (ক্যাথলিক বিরোধী) গোষ্ঠি ইত্যাদি। কোন ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলে এসব জায়গা কিংবা মানুষের বিবরণ অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। মনে হতে পারে যে তিনি এসবের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ানো বা উপন্যাসের পরিসর বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই করেছেন!
এছাড়া উপন্যাসটির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো উইনস্টোন নামের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) সম্পন্ন একটা ফিউচারিস্টিক সুপার কম্পিউটার, অ্যাডমন্ডের এক অনবদ্য সৃষ্টি, যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ল্যাংডন আর তার সঙ্গিনী আমব্রাকে পদে পদে সাহায্য করে কারশ্চের আবিষ্কারকে জনসমক্ষে প্রচার করতে সহায়তা করে। তবে এরাই আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে (২০৫০ সালে) মানুষকে সরিয়ে জায়গা করে নেবে বলে কারশ্চের ভবিষ্যতবাণীতে বলা হয়েছে। ড্যান ব্রাউন অরিজিনে কিছু নতুন হাইটেক জিনিসের ব্যবহার করেছেন, যা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, মুগ্ধ করবে। এসব তিনি যথেষ্ঠ গবেষণা করে, সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে যারা এক্সপার্ট তাদের উপদেশ বা মতামত নিয়েই লিখেছেন, তাই এসব অসম্ভব মনে হলেও অবিশ্বাস্য মনে হয় না।
আগের প্রতিটি বইতে যে পরিমাণ সাসপেন্স ছিল, এটাতে তার বেশ অভাব পরিলক্ষিত হয়, এমনকি অন্যান্য ড্যান ব্রাউনের উপন্যাসে যেমন সাসপেন্সটা শেষ দৃশ্য অবধি থাকে, এটাতে হত্যা ও ঘটনার জন্য অনেককেই দায়ী করা হলেও বইটির অর্ধেক পড়ার আগেই অনেকে ধারনা করে নিতে পারবেন, আসলে সবকিছু কে করাচ্ছে।
রবার্ট ল্যাংডনকে নিয়ে পাঁচটা বই লেখা হয়েছে, সবগুলোর ফর্মুলা একই। আমার মনে হয় ড্যান ব্রাউনের এই সিরিজ লেখা বাদ দেয়ার সময় হয়েছে। বরঞ্চ তার স্ট্যান্ড এলোন থ্রীলার ডিসেপশান পয়েন্ট এবং ডিজিটাল ফোর্ট্রেস অনেক থ্রীলিং ছিল। কিংবা, নতুন কোন “ফর্মুলা” নিয়ে অন্য আরেকটা সিরিজ শুরু করতে পারেন।
দ্য ভিঞ্চি কোড বা ইনফার্নোর বেস্ট সেলার হওয়ার যথেষ্ঠ যোগ্যতা ছিল, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হলো, এই বইটি সম্ভবতঃ পাঠকের সেই তৃষ্ণা মেটাতে পারবে না, বিশেষ করে উল্লেখিত দুইটি মাস্টারপিসের তুলনায়, এবং তার কাছে চাওয়ার পরিমানটা যখন আরো উর্ধমূখী।
তবে কিছু বলাও যায় না। আমেরিকানরা এক আজব জাতি আর ড্যান ব্রাউন সাতটা বই লিখেই পৃথিবীর ১২তম ধনবান লেখক আর এতো বিশাল এক সেলিব্রিটি হয়ে গেছেন যে, কে জানে “ধারে না কাটলেও ভারে কাটতেও পারে!”
ডিসক্লেইমারঃ এখানে লিখিত সকল কিছু একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। তাই আমার রিভিউ পড়ে সিদ্ধান্ত নেবেন না। নিজে পড়ুন, যাচাই করুন। হয়তো পড়ার পর আপনার এতোই ভালো লাগবে যে, আমার উপরে বিরক্ত হবেন। তাই আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সবার জন্য অনেক শুভকামনা এবং হ্যাপি রিডিং।
লেখক: বদরুল মিল্লাত (লেখক ও অনুবাদক)