এক সময় ক্রিকেটীয় আবেগ ভেসে বেড়াত, সে মাঠগুলো জুড়ে। কত স্মৃতি, জয়ের কিংবা পরাজয়ের। কোনো টেস্ট ক্রিকেটারের আবেগের এক সেঞ্চুরির স্মৃতি হয়তো মিশে আছে সে মাঠে, কিংবা কোনো বোলারের ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্বের নস্টালজিয়া। কিংবা নিছক ভিন্ন কোনো ক্রিকেট–মুহূর্ত। কিন্তু সময়ের ফেরে সেই মাঠগুলো থেকে ক্রিকেট এখন নির্বাসিত। ব্যবহার হয় অন্য কোনো কাজে কিংবা, খেলার জন্য। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন অনেক মাঠই আছে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় এই পাঁচটিই। যেখানে ক্রিকেট এখন কেবলই অতীতের ঘটনা
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকা, বাংলাদেশ
বাংলাদেশ এই মাঠে খেলেছে তাদের প্রথম টেস্ট। সে ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম। একটা সময় এই স্টেডিয়ামেই টেস্ট খেলেছে পাকিস্তান। হানিফ মোহাম্মদের আছে জোড়া সেঞ্চুরি। এই মাঠেই তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার বাসিল ডি’অলিভিয়েরা, নিউজিল্যান্ডের গ্লেন টার্নার। এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন পাকিস্তানের ইজাজ আহমেদ ও ইনজামাম–উল–হক। ক্রিকেটের কত স্মৃতি এ মাঠ জুড়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পথ চলা শুরু তো এই মাঠের আঙিনাতেই। ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটের জমাটি লড়াই এই বঙ্গবন্ধুতেই দেখেছে হাজার হাজার মানুষ। ১৯৯৮ সালে এ মাঠেই ‘মিনি বিশ্বকাপে’ খেলেছেন সে সময়ের সব টেস্ট খেলুড়ে দেশ। ক্রিকেট রোমান্টিকদের প্রিয় এই মাঠে এখন আর ক্রিকেট হয় না। এ মাঠ নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট আর ফুটবলের দ্বন্দ্ব স্থায়ীভাবে সমাধান করতেই ২০০৭ থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন ঠিকানা মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। আর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এখন কেবলই ফুটবলের। তবে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন এ মাঠের ক্রিকেটীয় স্মৃতিটাকেই নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ মাঠে প্রথম টেস্ট ও প্রথম ওয়ানডে দুটিই খেলেছে পাকিস্তান। ১৯৫৫ সালে ভারত–পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া এই মাঠে ১৯৮৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে পাকিস্তান খেলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। বাংলাদেশ অবশ্য এ মাঠে প্রথম ওয়ানডে খেলেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে। এ মাঠে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই শেষ টেস্ট ও ওয়ানডে খেলে বাংলাদেশ।
এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেছিল এ মাঠেই—১৯৮৮ সালের ২৭ অক্টোবর। এ মাঠে বাংলাদেশ ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পেয়েছে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ। দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক রুডলফ,নিউজিল্যান্ডের স্টিভেন ফ্লেমিং আর পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফের এই মাঠে আছে ডাবল সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল, হাবিবুল বাশাররা তো সেঞ্চুরি করেছেনই, করেছেন ভারতের রাহুল দ্রাবিড়, গৌতম গম্ভীররা। অনেকটা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম স্টাইলেই এ মাঠ থেকে ক্রিকেটকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ২০০৬ সালে। চট্টগ্রামে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নির্ধারিত মাঠে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। তবে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না হলেও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সিরিজের আগে প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ক্যারিসব্রুক স্টেডিয়াম, ডানেডিন, নিউজিল্যান্ড
ডানেডিন শহর থেকে দক্ষিণ–পূর্বে অবস্থিত এই মাঠটিতে প্রথম ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। ওটাগোর বিপক্ষে তাসমানিয়ার সেই ম্যাচের পর ১৯৫৫ সালে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টেস্টটি অনুষ্ঠত হয় এ মাঠেই। তবে এই মাঠেও ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্য খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯০৮ সাল থেকে এ মাঠে রাগবির আয়োজন নিয়মিত হওয়া শুরু করে। ১৯৭৪ সালে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ওয়ানডে। এভারটন উইকস, গ্রাহাম ডাউলিং, মুশতাক মোহাম্মদ, ভিভ রিচার্ডসদের সেঞ্চুরিধন্য এই মাঠে শেষ টেস্টটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে—নিউজিল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে। শেষ ওয়ানডে অবশ্য ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে।
রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডস, সেন্ট জোনস, অ্যান্টিগা
অ্যান্টিগার এই মাঠে এখন ক্রিকেট হয় না, এটা ভাবাই যায় না। এ মাঠেই ব্রায়ান লারা দুবার (১৯৯৪, ২০০৪) টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহের রেকর্ড গড়েছিলেন। তিনি অবশ্য ত্রিনিদাদের সন্তান। তবে অ্যান্টিগার ছেলে ভিভ রিচার্ডস এ মাঠেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৬ বলে টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন, যেটি টেস্টের দ্রুততম সেঞ্চুরি। ১৯৮১ সালে টেস্ট ভেন্যুর মর্যাদা পাওয়া এই মাঠের সবচেয়ে দারুণ গল্পটা ছিল এতে গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে কাজ করতেন কাছেরই একটি কারাগারের কয়েদীরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই কারাগারেরই কমকর্তা ছিলেন স্বয়ং ভিভ রিচার্ডসের বাবা।
ঘরের ছেলে ‘কিং’ ভিভই প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন এ মাঠে। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ উপলক্ষ্য অ্যান্টিগায় নতুন স্টেডিয়াম বানিয়ে সেটির নামকরণ করা হয় ভিভ রিচার্ডসের নামেই। এই মাঠে শেষ টেস্টটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডের মধ্যে। এতে অনুষ্ঠিত শেষ ওয়ানডেটি ২০০৭ সালেই কানাডার বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ।
অ্যাসগিরিয়া স্টেডিয়াম, ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার অনেক পুরোনো একটি ভেন্যু এই অ্যাসগিরিয়া স্টেডিয়াম। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে এ মাঠে কেনিয়ার বিপক্ষে সে সময় ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান তুলেছিল শ্রীলঙ্কা (৩৯৮/৫)। কুমার সাঙ্গাকারা যে ট্রিনিটি কলেজে পড়েছেন, অ্যাসগিরিয়া স্টেডিয়াম মূলত, তাদেরই মাঠ। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ক্যাচ ধরতে গিয়ে স্টিভ ওয়াহ আর জেসন গিলেস্পির মধ্যে সংঘর্ষ হয়, মারাত্মক আহত হন তাঁরা দুজন—সেটি এই অ্যাসগিরিয়া স্টেডিয়ামেরই ঘটনা। মুত্তিয়া মুরলিধরনের ‘হোমগ্রাউন্ড’ ক্যান্ডির এই মাঠে শ্রীলঙ্কা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ২০০৭ পর্যন্ত ২১টি টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাহাড় ও বনভূমির নৈসর্গিক পরিবেশ ঘেরা এই মাঠে ১৯৮৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলে শ্রীলঙ্কা। ১৯৮৬ সালে প্রথম ওয়ানডে হয় পাকিস্তানের বিপক্ষে। ২০০৭ সালের পরপরই এখান থেকে ক্রিকেট সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পাল্লেকেল্লে স্টেডিয়ামে। সেটিই এখন ক্যান্ডির মূল আন্তর্জাতিক ভেন্যু।