ঢাকা অফিস: ভারতের জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠান শুরু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ৫২ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারের আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম বজলুর রহমান ফাউন্ডেশনের যৌথভাবে। সেমিনারে ভারতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তারা নানা ভাবে এ নিয়ে মন্তব্য করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনসুরা আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ঢাবির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে আজ (গতকাল) প্রথম রোজার দিন সম্মিলিতভাবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। সার্বভৌমত্বের আর কোনকিছু বাকি রইলোনা এই দেশে। সেটা শেষ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত শত নেটিজেন ভারতীয় সংগীত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার শুরু করার প্রতিবাদ করেছেন। অনেকে এমন সব শব্দের ব্যবহার করেছেন যা গণমাধ্যমে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা দূরহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করছেন হাজার হাজার মানুস। আসাদ এস নিলয় লিখেছেন- আমরা অচিরেই সিকিমের মতো ভারতের অংশ হবো। ভারত তাদের প্ল্যান অনুযায়ী তাবেদার হাসিনা (শেখ হাসিনা) কে দিয়ে কাজ প্রায় ৬০ শতাংশ করে নিছে, বাকি ৪০ শতাংশ ২০২৯ এবং ২০৩৫। আমরা ভারতের অঙ্গরাজ্য, এদেশের মানুষ ভয়ে রাস্তায় আসবে না, অনলাইনে এসে ভারতবিরোধী কথা বলবে, আন্দোলন হলে বিড়াল। মো. সবুর খান লিখেছেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইফতার করা যাবে না, তবে ভিনদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে। বললেই হয়, এটা ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গাওয়া হচ্ছে ‘ভারতের জাতীয় সঙ্গীত’। এই হচ্ছে আমার, আপনার, আমাদের সকলের স্বাধীন বাংলার ৯২ শতাংশ মুসলিম বাংলাদেশ। একই কথা লিখেছেন সাইফুল ইসলাম রানা। এইচ আর হারুন লিখেছেন- প্রথম রোজায় তারা দেখিয়ে দিল যে, নেহায়তই তারা বসে নেই বরং কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গাওয়া হলো ‘ভারতের জাতীয় সঙ্গীত’। সাইফুল ইসলাম জনি লিখেছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর নামে ঢাবির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন। সেই ভবন মিলনায়তনে প্রথম রোজার দিন যেই ভারত সম্মিলিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিল, সেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। তারপরও একশ্রেণির মানুষ নির্লিপ্ত আত্মপরিচয়হীন মানুষ সেই ভারতের দালালি করে নিজেদের জন্ম পরিচয়ের শুদ্ধতা দাবি করে। জয় ধর হিরু লিখছেন- ঢাবির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে আজ (গতকাল) প্রথম রোজার দিন সম্মিলিতভাবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। সার্বভৌমত্বের আর কোনকিছু বাকি রইলো না এই দেশে। সেটা শেষ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেই।
দিদার হোসেন লিখেছেন- ইন্নালিল্লাহ, দেশকে শেষ করে দিয়েছে মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গাওয়া হচ্ছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত! বাংলাদেশ স্বাধীন আছি কি? হয়তো কোন একদিন আমাদের স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীতও বাদ দিয়ে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা লাগবে?
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে এমন অনুষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় সংগীত দিতে শুরু করার প্রশ্নই আসে না। গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করাই স্বেয়। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশকে বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে এবং সন্মানের সঙ্গে দেখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু ভিন্ন বার্তা দেয়। আমরা তো স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। সেখানে ভারতীয় সংগীত গেয়ে অনুষ্ঠান শুরু কাম্য হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, দুই দেশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান উপস্থিত থাকলে দুই দেশের জাতীয় সংগীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইতে হবে। দেশের বিবেকবান বুদ্ধিজীবীরা যদি এখনই এ ব্যপারে প্রতিবাদী না হয় তাহলে ভবিষ্যতে সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসতে পারে।
হাইকমিশনার যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে সেখানে সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত কিভাবে বাঁজানো হয় সেই প্রশ্ন রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালে ভারত যেটি করেছে, সেটি তাদের স্বার্থেই। তবে তারা কখনোই চায়নি বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলুক। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। আগে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতো এজন্য তারা পারেনি। কিন্তু ৫ শতাংশ ভোটের বর্তমান সরকার ভারতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকার কারণে নতজানু রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। এই সুযোগ নিয়ে ভারত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে।
ভারতবিরোধী মনোভাব যখন বাংলাদেশে তীব্র হচ্ছে তখন ভারত আরো এগ্রেসিভ মনোভাব নিয়ে তাদের যেসব স্বার্থ আছে সেটি দ্রুত হাসিল করতে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। নেপালের লেন্দুপ দর্জির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, লেন্দুপ দর্জি যেভাবে নিজের সুবিধার জন্য তার দেশের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে দেশকে ভারতে হাতে তুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের সরকারও সেই একই পথে হাঁটছে কিনা সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই আলোচনা শুরু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ ছাড়াও সম্মানীয় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রী প্রণয় কুমার ভার্মা, সেনা সদর দপ্তরের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লে. জেনারেল মো. মজিবুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্ণেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক, পদ্মশ্রী) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড.আশফাক হোসেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছিল। আমাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। তাদের সর্বাত্মক সহায়তা না পেলে আমাদের ইতিহাস অন্যরকম হতো। তিনি বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইশারায় তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১২ই মার্চ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের এই ঘটনা বিরল। এটি বঙ্গবন্ধু›র বিশাল ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতার বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু ও মিসেস গান্ধীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়েছিল। ভারতকে বাংলাদেশের শর্তহীন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের প্রয়োজনে ভারত সর্বদা পাশে থেকেছে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন ভারতের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।
ভারতের হাইকমিশনার শ্রী প্রণয় কুমার ভার্মা বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা দু›দেশের বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারত এবং বাংলাদেশের এই সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা বর্তমানে অনন্য উচ্চতায় পৌছেছে। তিনি ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ৫২বছর পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এ এস এম মাকসুদ কামালকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাবি ভিসি প্রফেসর ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিরাজমান ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের অনেক সৈন্য জীবন দিয়েছেন। দু›দেশের জনগণের মধ্যে বিরাজমান মৈত্রীর এই বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও অসাধারণ দক্ষতার কারণেই অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। এর মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্ব সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হই। সৈন্য প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানও তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ইতিহাসের এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান।
এর আগে দুপুর ২.৩০ মিনিটে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ২.৩৫ মিনিটে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের উপর নির্মিত একটি প্রামাণ্য চিত্র উপস্থাপন করা হয়।