- সংকট নিরসনে সরকারের ৬ সিদ্ধান্ত।
- তিস্তা অভিমুখে বিএনপি’র দুই দিনের কর্মসূচি।
শামসুল ইসলাম, লণ্ডন- ‘আমরা পরিকল্পিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন চাই, আমরা ত্রাণ চাই না, মিথ্যা আশ্বাস শুনতে চাই না, আমরা দ়ল বুঝি না, নেতা বুঝিনা, দল যার যার তিস্তা সবার। তিস্তা আমাদের রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার ১২টি উপজেলার ৪৪ ইউনিয়ন মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এ নদীর সাথে বাংলাদেশের ২২টি নদী যুক্ত। সেই নদী আমাদের সাধারণ মানুষের মরণফাঁদে পরিণতি হয়েছে। বন্যা, খড়াসহ নানান দূর্যোগে পতিত হচ্ছে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ। ইন্ডিয়া যদি মনে করে তিস্তা তাদের একক নদী তা হবে তাদের ভু়ল ধারণা। কথায় কথায় আমরা বন্ধুত্বের কথা শুনি। ইন্ডিয়া যদি যদি আমাদের বন্ধু হয় তাহলে বর্ষাকালে পানি ছাড়ার আগে কেনো আমাদের জানায় না? শুস্ক মৌসুমে কেনো আমাদের পানি দেয় না? আমরা এসব কথা আর শুনতে চাই না। আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাই।’ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি, রবিবার কাউনিয়ার তিস্তা সেতু পাড়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে অংশ নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা এসব কথা বলেন।
এলাকার বাসিন্দারা আরো বলেন, ‘নদী শাসনের মাধ্যমে ১১৫ কিলোমিটার নদীর গতি- প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ ভাঙন প্রতিরোধ, বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ হ্রাস, ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদী খনন, নদী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নদী পুনরুদ্ধার, চ্যানেল ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, খননকৃত মাটি ভরাট স্থানে অর্থনৈতিক অঞ্চল, পাওয়ার প্লান্ট ও স্যাটেলাইট টাউন সেচ কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন, শুস্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরণ প্রকল্পসহ এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরকারকে কাজ করতে হবে।
গণশুনানি অনুষ্ঠানে পানিসম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। গণশুনানিতে তিস্তা পাড়ের মানুষ দুই উপদেষ্টার কাছে তাদের নানান দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন,‘অর্ন্তবর্তী কালীন সরকারের কাছে আপনাদের অনেক প্রত্যশা কিন্ত আমাদের কাছে তেমন অর্থ নেই, তবুও তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। চলতি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা চুড়ান্ত প্রস্তুত করা হবে। ইতিপূর্বে চায়নার সাথে যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা চুক্তি হয়েছিল তা টেকসই হত না বিধায় পরিকল্পনায় কী থাকবে আর কী থাকবে না এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং আপনাদের মতামত নিয়ে আবারো পাওয়ার চায়না তিস্তা প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এ অঞ্চলের ৪৫ কিলোমিটার নদী ভাঙন এলাকার মধ্যে ২২ কিলোমিটারেরও বেশি নদী ভাঙন প্রবণ এলাকা, তাই মার্চ মাসের মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করে নদী ভাঙন রোধে কাজ শুরু করার জন্য আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছি।’ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া বলেন, ‘বিগত সরকার প্রধান বলে গেছেন আমরা ভারতকে যা দিয়েছি ভারত তা চিরকাল মনে রাখবে। কিন্ত ভারত মনে রাখার মতো কিছুই করেনি। বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। আমরা ভারতকে চাপ দিয়ে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায় করবো। তিস্তা যেনো এ এলাকার মানুষের জন্য আর্শীবাদ হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘তিস্তার চরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে, ফসলের ন্যায্য মূল্য যাতে কৃষকেরা পায় সেজন্য কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণসহ তিস্তা নদীতে আরো একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। উত্তরাঞ্চলে কৃষি শিল্পের বিপ্লব ঘটানো হবে।’
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ রবিউল ফয়সালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসাইন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব একে এম তারিকুল আলম, অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি, আলহাজ্ব এমদাদুল ভরসা, একে এম মমিনুল হক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মহিদুল হক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. আতিক মোজাহিদ ও আবু সাঈদ লিয়ন প্রমূখ।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসাইন বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে ভারত পানি আটকিয়ে তিস্তা মরুভূমিতে রুপান্তর করে। নদী হওয়ার কথা আর্শীবাদ সে তিস্তা নদী হয়েছে আমাদের অভিশাপ। আমরা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করছি।’ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবি জানান তিনি।
– সংকট নিরসনে সরকারের ৬ সিদ্ধান্ত
তিস্তার নদী ও তীরবর্তী অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে সরকার ৬টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তিস্তা সংকট নিরসন নিয়ে আয়োজিত গণশুনানি শেষে নিজের ফেসবুক আইডিতে এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, তিস্তা তীরের জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং নদীসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান কল্পে নিচের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে:
১. পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আসন্ন বর্ষার পূর্বেই তিস্তার ভাঙনপ্রবণ ৪৫ কিলোমিটার তীরে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেবে। এটি নদী ভাঙন থেকে জনগণকে রক্ষা করবে।
২. স্থানীয় সরকার বিভাগ ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের জীবনযাত্রা পুনর্গঠন করতে পারে।
৩. বড় বড় স্থায়ী চরাঞ্চলগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে সেখানে বসবাসরত জনগণের সন্তানরা শিক্ষার সুযোগ পায়।
৪. উত্তরবঙ্গের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পেতে সহায়তা করার জন্য কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
৫. স্বাক্ষরতার হার তুলনামূলকভাবে কম যে উপজেলাগুলোতে রয়েছে, সেখানে আধুনিক ও সমৃদ্ধ পাঠাগার স্থাপন করা হবে, যাতে স্থানীয় জনগণ শিক্ষা ও তথ্য পেতে পারে।
৬. রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী, পীরগাছা-চিলমারী ১৪০০ মিটার ব্রিজ নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু হবে।
এর পাশাপাশি, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রমে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার উদ্যোগও নেওয়া হবে। এসব পদক্ষেপ তিস্তা তীরবর্তী অঞ্চলের জনগণের জন্য উন্নয়ন এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের কৃষকদের সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করবে।
– তিস্তা অভিমুখে বিএনপি’র দুই দিনের কর্মসূচি
তিস্তা নদী পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে তিস্তা নদী তীরবর্তী অঞ্চলে আগামী ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি ২ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপির সূত্র বলছে, ‘কর্মসূচির সার্বিক তত্ত্বাবধান করবেন রংপুর বিভাগের বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ এই স্লোগানে দুদিনের কর্মসূচিতে তিস্তা নদীর কাউনিয়া সেতু, মহিপুর সেতু এবং তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে তাঁবু করে এই সমাবেশ করবে দলটি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আগামী দিনে রাজনৈতিকভাবে ভারতকে চাপে রাখা যাবে মনে করেন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, চীনের অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ভারত চাপে থাকবে। তবে, বিএনপি মনে করেন তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যদি ভারত অর্থায়ন করে এতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল তৎকালীন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতৃত্বে তিস্তা অভিমুখে লং-মার্চ করেছিল। সেই সময় উত্তরা থেকে লং-মার্চ গাড়িবহর যাত্রা শুরু হয়। যাওয়ার পথে গাজীপুর কালিয়াকৈর, টাঙ্গাইল বাইপাস মোড়, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেইসময় ২২ এপ্রিল রাতে রংপুরে যাত্রাবিরতি থাকে। পরদিন রংপুরে সমাবেশ পর নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারেজ অভিমুখে লং-মার্চ যাত্রা শুরু হয়। ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারেজের কাছে সমাবেশের মধ্য দিয়ে দুই দিনের কর্মসূচি শেষ করে।
উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চল খরা পিড়িত এলাকায় ১৯৩৭ সাল তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ পরিকল্পনা হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন ১৯৭৯ সালে তা শুরু করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।