প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দর্শনের এই কথাটি বেশ প্রচলিত যে ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ।’ যার অর্থ, ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। ট্যাঁকে টাকা নেই বলে বিলাস-ব্যসন বন্ধ থাকবে কেন? এই দর্শনে ধার করে ঘি খাওয়ায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যা হাসিনা সরকার উৎসব হিসেবে নিয়েই গোটা দেশটাকে বিদেশী ঋণে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এ ‘ঘি’ খেয়ে শ্রীলংকা এখন দেউলিয়া রাষ্ট্র। বাংলাদেশও ঠিক সেই পথেই। ভয়ানক ঋণের ফাঁদে এখন বাংলাদেশ।
একদিকে ঋণের ফাঁদে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভবিহীন দেউলিয়ার পথে, অন্যদিকে বিদেশী ঋণের সিংহভাগই লুটেরাদের হাত ধরে ভারত, আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পাচার হয়ে যাওয়ায় চরম আর্থিক সঙ্কটে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্দশা অনেক আগেই শ্রীলংকাকে ছাড়িয়ে গেছে। শ্রীলংকা সেটি স্বীকার করে নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে, আর বাংলাদেশ সেই দুর্ভোগ আড়ালে রাখতে গিয়ে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে জাতিকে।
দেশের অর্থনীতির একটি সূচকও এখন ইতিবাচক নয়। রিজার্ভ শূন্যের কোঠায়, রপ্তানি আয় ধুকছে, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না ডলারের অভাবে, প্রবাসী আয়ে চলছে অশনি সঙ্কেত, পুঁজিবাজার বহু আগে থেকেই স্থবির, বিদ্যুৎ-গ্যাসের অভাবে শিল্পের চাকা অচল, কৃষি খাতকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানি নির্ভর খাদ্যখাত হওয়ায় নিত্যপণ্যের বাজার সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থাকে একজন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বহু আগেই ‘বেলুন ফুটো অর্থনীতির’ সাথে তুলনা করে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
একটি দেশের অর্থনীতির বড় একটি ভিত্তি হচ্ছে সেই দেশের পুঁজিবাজার। হাসিনা সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই এই ভিত্তিটি ভেঙ্গে দেন গোটা পুঁজিবাজারকে লুটে নিয়ে। সেই থেকেই দেশের পুঁজিবাজার স্থবির। সেই সাথে ব্যাংকিং খাতে লুটপাট চালিয়ে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পথে বসিয়েছে সরকার ও তার লুটেরা। ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংকসহ বাংলাদেশে মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশি ৯টি ছাড়া সবই এখন দেউলিয়ার পথে। বেসরকারি ইসলামি ব্যাংক এখনো কিছুটা শক্ত অবস্থানে আছে নেতৃত্বের কারণে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় দেড়যুগে দেশের ব্যাংক খাত ঋণের নামে প্রায় লুটে খেয়েছে সরকার ও আওয়ামী লুটেরারা। ঋণের নামে সরকার নিজেই ব্যাংকের সিংহভাগ টাকা নিয়ে নিয়েছে। চলতি অর্থবছরের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণ স্থিতি দাড়ায় ২ লাখ ৮২ হাজার ৭১২ কোটি টাকায়। এর আগের মাস আগস্ট শেষ এর পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ৬৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বুধবার (১৯ অক্টোবর) পর্যন্ত ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। প্রতি বছরই সরকারের বাজেট বড় হচ্ছে। কিন্তু বাজেটের আকারের সঙ্গে সংগতি রেখে রাজস্ব আয় বাড়াতে পারেনি সরকার। ফলে বাজেটের আকার বড় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ। এ ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য বিদেশী উৎসের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ নেয়া হয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে। আর পরোক্ষ ঋণ নেয়া হয় ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রির মাধ্যমে।
এক দশক আগে ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে হয় ৫ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণেই সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘাটতি বাজেটের আকার যত বড় হবে সরকারের ঋণও তত বাড়বে। এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বিদ্যমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। দিনশেষে জনগণকেই সরকারের এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
দেশীয় ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ নেয়ার পথ সংকোচিত হয়ে যাওয়ার পরই সরকারের নজর পড়ে বিদেশী ঋণে। এর ফলে অস্বাভাবিক ভাবে গত কয়েক বছরে বাড়ছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ শেষে এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৩২৩ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সংখ্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২১ শতাংশ। বড় ঋণের বেশির ভাগই সরকারের নেয়া ঋণ, যা শতকরা হিসাবে ৭৩ শতাংশ। আর এসময়ে বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে ২৭ শতাংশ।
স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশি ঋণের এ উল্লম্ফন ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দেশে এ মুহূর্তে ডলারের তীব্র সঙ্কট চলছে। আগামীতে এ সঙ্কট আরও গভীর হবে।
এ অবস্থায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও চাপে থাকতে হবে। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ঋণের চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে সেটি স্বাভাবিক নয়। প্রয়োজন নেই এমন অনেক খাতেও বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে লাইবরের সুদহার শূন্য দশমিক ৫০ থেকে বেড়ে ৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থেকে বেড়ে এসওএফআর এখন ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের পাশাপাশি লাইবর ও এসওএফআর সুদহার অস্বাভাবিক বাড়ায় বিদেশী ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, জুন শেষে সরকারের নেয়া বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের মধ্যে ৬৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ৩৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের উৎস হলো বহুপক্ষীয়। ২৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৩ বিলিয়ন, বাণিজ্যিক শর্তযুক্ত ঋণ হিসাবে ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ও অন্যান্য উৎস থেকে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার। জুন শেষে সরকারের নেয়া স্বল্পমেয়াদী ঋণের পরিমাণও ২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।
বর্তমানে (২০২০-২১ অর্থবছরের শেষে) বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ১৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ গত এক বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং বিশ্বব্যাংকের কাছে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাকি ঋণ তিনটি ভারত, চীন এবং রাশিয়া থেকে নেয়া হয়েছে। চীন থেকে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি মার্কিন ডলার, রাশিয়া থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি এবং ভারত থেকে ৭৩৬ কোটি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দ্বিপক্ষীয় ও অন্যান্য উৎস থেকে নেয়া বিদেশী ঋণের শর্ত অনেক কঠিন, সুদহারও চড়া। লাইবর বা এসওএফআরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দ্বিপক্ষীয় ও অন্যান্য বেশির ভাগ ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। গত এক বছরে এসওএফআর ও লাইবরের পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। ফেড এখন আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়িয়ে তোলায় সামনের দিনগুলোয় এ ব্যয়বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে।
দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ঋণের ভিত্তিতে দেশে এখন বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর একটি হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার নিউজের তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ার দেয়া ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ঋণের সুদহার ধরা হয়েছে লাইবরের অতিরিক্ত ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চুক্তিটি যখন সই হয় তখন লাইবর হার ছিল বেশ কম। কিন্তু এখন লাইবর হার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধযোগ্য ব্যয়ের পরিমাণও অনেকটাই বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও মনে করেন, লাইবর বা এসওএফআর হার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ ঝুঁকি স্ফীত হয়েছে। তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের ৮০ শতাংশ ছিল সুলভ সুদের। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় বিভিন্ন সংস্থা থেকে বেশি ঋণ নেয়া হতো। সুলভ সুদ আর দীর্ঘমেয়াদের কারণে বহুপক্ষীয় ঋণের ঝুঁকি অনেক কম। কিন্তু গত কয়েক বছরে দ্বিপক্ষীয় (বাইলেটারাল) ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। সাপ্লায়ারস ক্রেডিট ও বাণিজ্যিক শর্তযুক্ত ঋণের পরিমাণও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। লাইবর বা এসওএফআর হার বেড়ে যাওয়ায় এসব ঋণের সুদহারও অনেক বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে বাছবিচার ছাড়া বিদেশী ঋণের অনুমোদন দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় ভুল।
যেসব অনুমিতির ভিত্তিতে বিদেশী ঋণ নেয়া হয়েছিল সেগুলো এখন ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাছবিচার না করে বিদেশী ঋণ নেয়ার সময় মনে করা হয়েছিল ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার একই থাকবে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে লাইবরের সুদহার বাড়বে না বলেও ঋণ নেয়ার সময় ধারণা করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের বাজারেই টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। আবার বিশ্ববাজারে এসওএফআর ও লাইবর হার কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে হারে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে এসব হার কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা অনেক আগে থেকেই বিদেশী ঋণ নেয়ার বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করে আসছিলাম। যে ভ্রান্ত চিন্তা থেকে বিদেশী ঋণ নেয়া হয়েছে, সেটিকে বিশুদ্ধ বাংলায় অবিমৃষ্যকারিতা বলা যায়।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার অতিকথনের কারণে বাংলাদেশের বিপদ আরো বাড়বে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে বিশ্বব্যাংকসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলো থেকে এখন আর সুলভ সুদের ঋণ পাবে না। দ্বিপক্ষীয় যেসব বিদেশী ঋণ সরকার নিয়েছে, সেগুলোর সুদহার পরিবর্তনশীল। লাইবরের সঙ্গে সুদহার জুড়ে দিয়ে এসব ঋণ নেয়া হয়েছে। সাপ্লায়ারস ক্রেডিট ও বাণিজ্যিক শর্তযুক্ত যেসব ঋণ নেয়া হয়েছে, সেগুলোও এসওএফআর ও লাইবরের সুদহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১০ টাকার পণ্যের দাম ১০০ টাকা দেখিয়েও গত কয়েক বছরে বিদেশী ঋণ আনা হয়েছে। সময় যত গড়াবে, সুদের অংক বেড়ে এসব ঋণ দেশের ঝুঁকিকে তত বেশি বাড়াবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের ১৭ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের ধরনই স্বল্পমেয়াদী। বেসরকারি খাতের পুরো ঋণই নেয়া হয়েছে লাইবর রেট বা এসওএফআরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।
দেশের জনগণ সরকার ও তার লুটেরাদের হাতে যেমন ঋণে জর্জরিত, তেমনি বেকারত্ব ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কাছে এখন চরম অসহায়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র তথ্য মতে, দেশে ৯৩ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো বেলা এখন না খেয়ে থাকছে। রাজধানীতে প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবারের ব্যয় বেড়েছে প্রায় পৌনে পাঁচ হাজার টাকা। সিপিডি জানিয়েছে, শুধু বৈশ্বিক পণ্যই নয়, দেশে যেসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোর দামও ঊর্ধ্বমুখী, যা মানুষের ওপর বোঝা সৃষ্টি করছে। মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিদ্যুতের গল্প বানিয়ে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়া হলেও, বাস্তবে গত এক দশক ধরেই গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে ধুঁকছে শিল্প কারখানাগুলো। হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান গত এক যুগে বিলীন হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ বেকার। রপ্তানি আয়েও গাল-গল্প দীর্ঘদিনের। বাস্তবে যেমন শিল্পের প্রসার ঘটেনি, তেমনি রপ্তানি আয়ের বাজারও সম্প্রসারণ হয়নি।
প্রবাসী আয়েও উস্ফলন নিয়ে জনগনের প্রশ্ন ছিলো। সেটি এখন বাস্তবে প্রকাশ পেয়েছে। বিদেশে টাকার পাচার করে সেটি আবার বৈধ চ্যানেলে পাঠিয়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির অভিযোগ ছিলো আগে থেকেই। সেই প্রবাসী আয়েও এখন ভাটা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১০ বছরে চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দর্শনে জবাবদিহির অভাবকে তাত্ত্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। শাসক শ্রেণী ও তার সমর্থকরা বলতে চেয়েছেন, উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে জবাবদিহি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ উন্নয়ন ও জবাবদিহি একসঙ্গে যায় না। এজন্য অনেকে প্রথমে মালয়েশিয়ার উদাহরণ দেন, এরপর তামাদি হয়ে যাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং-হিয়ের মডেলের উদাহরণ দেন। কেউ কেউ আবার চীনের কথাও উদাহরণ হিসেবে আনেন। তারা বলেন, উন্নয়ন আগে গণতন্ত্র পরে। তবে এটা মূলত তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের অপরিপক্ব ধারণা।