- সংসদ ব্যবসায়ীদের দখলে।
- সেহরিতে মুড়ি, ইফতারে শুধু পানি খাইছি।
- চাল, মাছ, মাংস কিনমু ক্যামনে, দাম বেশি।
- সকালে ২শ’ টাকার তরমুজ বিকেলে ৬শ’।
- পণ্যের অগ্নিমূল্য দিশেহারা রোজাদার মানুষ।
- সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন।
ঢাকা, ১৩ মার্চ: আওয়ামী লীগ সরকারের চরম ফ্যাসিবাদী দু:শাসনে ও দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষের জীবন ক্রমেই দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। রমজান উপলক্ষে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানান দ্রব্যের দাম কমানো হলেও বাংলাদেশে আকাশচুম্বি হয়েছে। সরকার সব জানার পরেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধা করে দিচ্ছে। সংসদে ব্যবসায়ীদের হার বাড়ছে। তাঁরাই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকার দলের লোকেরা ব্যবসায়ীর মন নিয়ে রাজনীতি করছে। রক্ষক হয়ে ভক্ষক হচ্ছে।
বাজারে এমন কোন জিনিস নেই, যার দাম ক্রমাগত বাড়ছে না। বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে তাদের খাবার কমিয়ে দিতে হচ্ছে। শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন আবার নির্বাহী আদেশে সরকার গ্যাস- বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। সরকার বলছে, প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হবে অর্থাৎ দাম বাড়াবে। সরকারের দুর্নীতি, ভুলনীতির ফল জনগনভোগ করছে। শুধুমাত্র গত ১২ বছর ধরে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ৯৬ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। সেটার দায় জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
সাধারণত টিসিবি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, টিসিবির প্রদানকৃত চালের অংশও সরকারি দলের লোকেরা সাধারণ দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ না করে নিজেরা ভোগ করছে। যার ভয়াবহ প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়ছে। এভাবে উচ্চবিত্ত আরও ধনী হচ্ছে আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন হতদরিদ্রে পরিণত হচ্ছে। ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। সর্বোপরি, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে অমানিশার ঘোর অন্ধকার বয়ে আনছে।
বাজার ঘুরে আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি জানিয়েছেন- চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, ছোলা, বেসন, মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর বিভিন্ন ফলেরও অসহনীয় দাম থাকায় চাহিদা মেটাতে দুই-এক পিস ওজন করে কিনতে হচ্ছে। লেবু-শসার দামও অসহনীয়। ভালোমানের প্রতি কেজি শসা বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। প্রতি হালি লেবু খুচরা বাজারে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৩০ এবং গরুর মাংস ৭৫০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকে এখন সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মাংস কিনতে পারছেন না। প্রতি কেজি ছোলা ১১০ টাকা দাম চাচ্ছে। চিনি কেজি প্রতি ১৫৫ টাকা চাচ্ছে। মসুর ডাল কিনতে কেজিতে গুনতে হচ্ছে ১৪০ টাকা। আর সয়াবিন তেলের দামেও আগুন। প্রতি লিটার বিক্রি করছেন ১৭০ টাকা। বেগুন ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। মুড়ি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা। বেসন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। বুটের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সরিষা তেলের বোতল বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা। অন্যদিকে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লাল আপেল ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কমলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি। প্রতি কেজি আনার বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা। প্রতি কেজি বড়ই বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। পেয়ারার কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। জাম্বো মেডজুল খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায়। সাধারণ মেডজুল খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। মাবরুম খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। প্রতি কেজি আজওয়া বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। প্রতি কেজি তিউনিশিয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। ফলে গরিবের জন্য বাজার করা এখন বড় ধরনের মানসিক কষ্ট ও হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ বাজারে গিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকছেন। কেউ আবার নিরুপায় ঘোরাফেরা করছেন। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র লক্ষ করা গেছে। বাজারে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে, দেখার যেন কেউ নেই। এতে বাজারে নিম্নবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্তদেরও নাভিশ্বাস অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
গরীব মানুষ যারা সরকারি কোনো অনুদান পান না তাঁরা ইফতারে শুধু পানি আর সেহরিতে শুধু মুড়ি খেয়ে রোজা রাখছেন। বাড্ডার বিধবা হলিদা বেগম বলেছেন- সেহরিতে মুড়ি, ইফতারে শুধু পানি খাইছি। দুলাল মিয়া নামে মহানগরীর এক রিকশাচালক দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন- ‘চাল, মাছ, মাংস কিনমু ক্যামনে, দাম বেশি। আয় রোজগার কুমলেও সব জিনিসের দাম বাড়ছে। যে কারণে পোলাপানরে ভালো খাওয়াতি পারি না।’ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে উপজেলা খাসের কান্দি গ্রামের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম মঙ্গলবার সকালে দুইশ’ টাকা দিয়ে তরমুজ কেনেন। তাঁর দেখাদেখি একই আকারের তরমুজ কিনতে বিকেলে আসেন আরেক ক্রেতা ফারুক মিয়া। কিন্তু দাম শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন তিনি। সকালে যে তরমুজ ছিল দুইশ’ টাকা বিকেলে সেটাই ছয়শ’ টাকা চেয়ে বসেন বিক্রেতা। ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি তরমুজের আকার ভেদে ৫শ থেক আটশ’ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকা হচ্ছে। এতে বাজারে আসা অনেক ক্রেতাই দাম শুনে তরমুজ না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি পিষ্ট হচ্ছেন মেস বা হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরাও। নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন- দ্রবমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে আমরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছি। আগের তুলনায় বর্তমানে প্রতিমাসে আরও এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি লাগছে। যা পরিবার থেকে দেওয়া অনেকের জন্যই বেশ কষ্টকর। সাত্তার হোসেন নামে নগরীর এক বেসরকারি চাকরিজীবি বলেছেন- তেল গ্যাস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় – প্রবাদটি আজ চরম সত্য হয়ে ঘাড়ে বসেছে। মাছ-মাংস মাসে এক দিনও খাই কিনা সন্দেহ। মেস ভাড়া বাকি পড়ে। বউয়ের ফোন ধরতে লজ্জা লাগে।
নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো প্রতিবছর নানারকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। দাম কমানোর কথা বলেন কিন্তু এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না বাজারে। অথচ সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন নয়। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন।