|| আজফার হোসেন ||
যাহা বিশ্ব-সাহিত্যে স্থান পায় না, তাহা স্থায়ী সাহিত্য নয়, খুব জোর দু’দিন আদর লাভের পর তাহার মৃত্যু হয়। আমাদিগকেও তাই এখন করিতে হইবে সাহিত্যে সর্বজনীনতা সৃষ্টি। অবশ্য, নিজের জাতীয় ও দেশীয় বিশেষত্বকে না এড়াইয়া, না হারাইয়া।
—কাজী নজরুল ইসলাম
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান-সেনাদলের তুর্য-বাদকের একজন আমি—এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। […] আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের।
—কাজী নজরুল ইসলাম
তাঁর কবিতা পড়া মানেই উদীপ্ত হওয়া।
—সুভাষ বসু
যে সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখছিলেন—অর্থাৎ গত শতকের বিশের দশক থেকে চল্লিশের দশকের গোড়া পর্যন্ত—তখন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথবিরোধিতা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। যাঁদের সচরাচর ‘তিরিশ’-এর কবি বলা হয়, তাঁদের অনেকেই আধুনিকতাবাদের দোহাই পেড়ে ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা ভূতের খপ্পরে পড়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই সাহিত্যের একটা নতুন যুগ তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আমরা তখন লক্ষ্য করলাম বোদলেয়ার-পাউল্ড-এলিয়ট-লরেন্সের নাগরিক ও নান্দনিক জ্ঞানভাষ্যকে বিভিন্ন অনুষঙ্গে ও অভিজ্ঞতায় সরাসরি কবিতায় উপস্থিত করার প্রবণতা। এর একটা ফল (একমাত্র না হলেও) দাঁড়ালো এই যে, এক আরোপিত নগরের বা এক আরোপিত দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে লেখকদের অনেকেই তাঁদের অভ্যেস ও অনুশীলনের নতুন অভিমুখ তৈরি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। না, আমি পশ্চিমা সাহিত্যের বা পশ্চিমা জ্ঞানভাষ্যের প্রতি বিদ্বেষবশত কথাটা বলছি না। তবে আমি যা বোঝাতে চাইছি তা হলো এই যে, উপনিবেশবাদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্যে যে আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদের উন্মেষ ঘটেছে—যাকে আমরা বলতে পারি ‘ঔপনিবেশিক আধুনিকতা’—তার একটা ফলাফল হচ্ছে এমন এক বাস্তবতা যাকে ক্যারিবীয় লড়াকু তাত্ত্বিক ফ্রানৎস্ ফানো’র অনুসরণে বলা চলে ‘জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাস’(বলা প্রয়োজন, এই বর্গটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক অন্যভাবে ও অন্য প্রসঙ্গে ব্যবহার করলেও বর্গটির জন্মের আসল জায়গা হচ্ছে ফানো’র প্রধান কাজ দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ—যে বইটাকে আমি বিউপনিবেশিকীকরণের রক্ত-বলকানো টগবগে তত্ত্বভরা মহাকাব্য বলে থাকি)।
কিন্তু কি এই জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাস? এর একাধিক অর্থ করা হয়েছে। কিন্তু এর একটা অর্থ আমি এভাবে পেশ করতে চাইঃ উপনিবেশবাদের গর্ভে জন্মলাভ-করা সাংস্কৃতিক অর্থনীতিতে উপনিবেশায়িত অঞ্চলে জ্ঞানের উৎপাদন-বিনিময়-বণ্টন-ভোগের চক্র এমন এক আয়তন, মাত্রা এবং প্রভাব অর্জন করে যে, দেশজ জ্ঞানের বা দেশজ ঐতিহ্যের হয় ধ্বংস নয় বিকৃতি সাধিত হতে থাকে। হ্যাঁ, ভিনদেশি জ্ঞান দেশি জ্ঞানের ওপর চড়াও হয় বিভিন্ন কায়দায় এমনভাবে যে, সেখানে ভিনদেশি জ্ঞান বিশেষভাবে সম্মানিত হতে থাকে আর দেশি জ্ঞান নির্বাসিত হয় কিংবা তা প্রান্তে উপেক্ষিত হয়ে পড়ে থাকে। শুধু তাই নয়। ভিনদেশি জ্ঞান আবার দেশি জ্ঞানকে শোষণও করতে চায়, বা নিজের করে নিতে চায়, এমনভাবে যে, একদিকে যেমন দেশি জ্ঞান তার নিজস্ব চেহারা ও চরিত্র হারাতে থাকে, অন্যদিকে তেমনি ভিনদেশি জ্ঞান বিভিন্নভাবে তার আধিপত্য বা দাপট দেখাতে ও বাড়াতে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভিনদেশি জ্ঞানের উৎপাদন, ভিনদেশি জ্ঞানের বিনিময়, ভিনদেশি জ্ঞানের বণ্টন বা ভিনদেশি জ্ঞানের ভোগের পরস্পর-সম্পর্কিত বিষয়গুলো—যা জ্ঞানোৎপাদনের একটি বিশেষ গতিশীল সমগ্রকেই নির্দেশ করে—মোটেই রাজনৈতিকভাবে নিরীহ নয়। উপনিবেশবাদের একটা বিশেষ ফল হল, ভিনদেশি জ্ঞানের আধিপত্য চলতে থাকে এমনভাবে যে, বিদেশিরা সবসময় সরাসরি না হলেও সাংস্কৃতিকভাবেই দেশিদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে। আমি এই অবস্থাকেই বলছি উপনিবেশবাদের জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাস।
তবে এই ‘সন্ত্রাস’ সনাতন অর্থে সন্ত্রাস নয় মোটেই; এই সন্ত্রাস ‘হেজিমনিক’ বা মতাদর্শিকভাবে আধিপত্যবাদী। অর্থাৎ এই সন্ত্রাস বন্দুক দেখিয়ে দেশিদের সন্ত্রস্ত করার মাধ্যমে তাদের বশ্যতা আদায় করে না মোটেই; বরং দেশিরা স্বেচ্ছায় সেই ভিনদেশি সন্ত্রাসকে ভেতর থেকে লালন করতে থাকে। আমরা এখনও এই জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাসের যুগেই বাস করছি। এই কারণে আমরা যেমন বিদেশী জ্ঞানকে সম্মান দেখাতে অভ্যস্ত হয়েছি, ঠিক তেমনি দেশি জ্ঞানের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনাকে আমাদের কাজের কেন্দ্রে না রাখতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অবশ্য আমি এখানে ঐতিহ্যের অন্ধ প্রেমকে আদর্শায়িত করার কথা বলছি না। বরঞ্চ আমি মনে করি, দেশজ জ্ঞানের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের নিরন্তর প্রশ্নমূলক বোঝাপড়া জরুরি। সে-প্রসঙ্গে আমি পরে ফিরব। তার আগে আমাদের অঞ্চলে জারি-থাকা উপনিবেশবাদ নিয়ে কিছু কথা সামনে আনা দরকার। হ্যাঁ, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ গেছে বটে, তবে মনোজগতে উপনিবেশবাদ থেকে গেছে, এমনকি তা পোক্ত ও বিস্তৃত হয়েছে বিভিন্নভাবেই। এবং যাকে ‘গ্লোবালাইজেশন’ বা বিশ্বায়ন বলা হয়, তা আসলেই আজকের উপনিবেশবাদের আরেক নামও। এভাবেও বলা যায়, আজকের বিশ্বায়ন হচ্ছে উপনিবেশবাদের সাম্প্রতিকতম স্তর (যে উপনিবেশবাদ অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ের অগসর একচেটিয়া পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত)।
এখানে বলা দরকার, উপনিবেশবাদী জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাসের কথা বলে আমি কিন্তু দুনিয়াব্যাপী জ্ঞানভাষ্যের বা সাহিত্যের লেনদেনের বিরুদ্ধে একতরফা অবস্থান নিতে মোটেই রাজি নই। আমি এমনকি এও মনে করি যে, প্রভাবিত হওয়াও মাঝে মধ্যে জরুরি বটে। কিন্তু কথা থেকে যায়। তা হল, এই লেনদেনের নামে কিংবা প্রভাবিত হওয়ার ভেতর দিয়ে যখন উপনিবেশবাদী ক্ষমতা-সম্পর্ক বা আধিপত্যবাদী ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে এবং আফ্রিকার মার্কসবাদী বিপ্লবী আমিলকার কাব্রাল জাতীয় মুক্তির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে যাকে বলেছিলেন “জাতীয় সংস্কৃতি,” সেই সংস্কৃতি যখন বিপন্ন বা এমনকি বিলুপ্ত হতে থাকে, তখন উপনিবেশবাদী জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জরুরি হয়ে পড়ে পাল্টা জ্ঞানভাষ্যিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই।
এই লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট। এখানে এঁদের কয়েকজনের নাম গুরুত্ব সহকারেই উল্লেখ করা দরকার বলে মনে করি। এঁরা হলেন পেরুর মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও অ্যাকটিভিস্ট হোসে কার্লোস মারিয়াতেগি; ক্যারিবীয় কবি-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্ট এইমে সেজেয়ার, যাঁর রক্ত-বলকানো তাত্ত্বিক রচনা ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম-এর অগ্নিঝরা বাক্যগুলোকে যে কোনো মুহূর্তেই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়; ফ্রানৎস্ ফানো তো আছেনই, যাঁর বই দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ-এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি; আফ্রিকার সেনেগালের লড়াকু কবি এবং বিখ্যাত নিগ্রোবাদ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা লেপল্ড সেডার সেংঘর; এবং এখানে আরেকজনের কথা উল্লেখ করতে হয়, যিনি এখনও বেঁচে আছেন, তিনি হচ্ছেন আফ্রিকার ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-তাত্ত্বিক-অ্যাকটিভিস্ট নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, যাঁর ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড বইটি সাংস্কৃতিক ও ভাষিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা জ্ঞানভাষ্যিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ের এক ধরনের ইশতেহার হিসেবে পাঠ করা চলে, যার উপর অবশ্য ফানো’র দ্য রেচেড্ অব দ্য আর্থ-এর প্রভাব কাজ করেছে একাধিক মাত্রায়।
কিন্তু হোসে কার্লোস মারিয়াতেগি, এইমে সেজেয়ার, ফ্রানৎস্ ফানো এবং নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তো বটেই, এঁদের সকলের আগেই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ওই পাল্টা জ্ঞানভাষ্যিক লড়াইকে যিনি নিজের কাজ ও জীবনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হচ্ছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এমনকি এও বলা যাবে যে, উপনিবেশবাদী জ্ঞানভাষ্যিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ শতকের প্রায় গোড়াতেই সারা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সবচাইতে গর্জে-ওঠা, সবচাইতে টগবগ-করা, সবচাইতে বিস্ফোরক কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। আমার মনে হয় যে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সে সময় এবং পরেও এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হলে কবিতাটি থাকতে পারত চে গুয়েভারার বুকপকেটে, কিংবা গ্রানাডার বিপ্লবী মরিস বিশপের হ্যান্ডব্যাগে, কিংবা জেলখানায় ভিয়েতনামের হো চি মিনের প্রিজন-সেলে, কিংবা কেনিয়ার মাউ মাউ আন্দোলনের শেষ নেতা ডেডান কিমাথির কণ্ঠস্বরেই, যে কিমাথি নজরুলের মতোই গ্রামীণ প্রোলেতারিয়েতকেই ইতিহাসের মঞ্চে হাজির করেছিলেন। এই সব প্রসঙ্গে পরে ফিরব। কিন্তু তার আগে ফেলে-আসা একটি জরুরি প্রসঙ্গকে সামনে আনা যাক। প্রসঙ্গটি হচ্ছে তিরিশের আধুনিকতাবাদ।
হ্যাঁ, যে জ্ঞানভাষ্যিক সন্ত্রাসের কথা আমি এর মধ্যেই বলেছি, তার এক ধরনের নান্দনিক মধ্যস্থতা করছিলেন তিরিশের একদল কবি। বলা যাবে যে, এঁরা পশ্চিমা নন্দনতত্ত্বকে জায়গা করে দিতে গিয়ে তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার বদলে বরঞ্চ তারাই এই নন্দনতত্ত্বের দখলে চলে গিয়েছিলেন। আমি সেই নব্বইয়ের দশকে একে বলেছিলাম নান্দনিক নয়া-উপনিবেশবাদ। তবে কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, যাঁর কবিতা বাংলার মাটির অনুপুঙ্খে তীব্রভাবে জড়িত ও জারিত হয়ে নিজেই তৈরি করছিল ভিন্ন ধরনের এক উপনিবেশবাদবিরোধী বয়ান ও আখ্যান। “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও—/ আমি এই বাংলার পারে/ রয়ে যাব”—জীবনানন্দের এই উচ্চারণের একাধিক তাৎপর্যবহ রাজনৈতিক অর্থ আছে, যার অন্তত একটি মাত্রা ওই উপনিবেশবাদবিরোধিতাকে নির্দেশ করে। “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও—/ আমি এই বাংলার পারে/ রয়ে যাব”—এই কথাটা যেন জীবনানন্দ দাশ বলছেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দেকে উদ্দেশ্য করেই। সত্যিই তো, এঁরা সকলেই একাধিক অর্থেই বাংলার পার ছেড়েছেন, যা জীবনানন্দ কোনো অর্থেই ছাড়েন নাই। যাই হোক, পশ্চিমা আধুনিকতাবাদের সঙ্গে তাঁর একটা তাৎপর্যপূর্ণ টানাপড়েনেই চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে জীবনানন্দ দাশের কাজে, অন্তত আমার বিবেচনায়, কোনো উদ্ভট, আরোপিত জগৎ প্রশ্রয় পায় নাই।
কিন্তু তিরিশের কবিদের খানিকটা আগেই নজরুলেও আমরা রবীন্দ্রবিরোধিতার আরেকটি মাত্রা লক্ষ্য করি। তবে তিরিশের কবিদের মোহগ্রস্ত রবীন্দ্রবিরোধিতার সঙ্গে নজরুলের রবীন্দ্রবিরোধিতার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে নজরুলকে আমাদের অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত করার স্বার্থেই এই পার্থক্যটাকে বিশেষভাবে খেয়াল করা প্রয়োজন। না, রবীন্দ্রনাথকে জোরেশোরে বর্জন করবেন বলেই বোদলেয়ার বা এলিয়টকে পীর মানেননি নজরুল। কোনো ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের প্রচারকও সাজেননি তিনি। একেবারে ইতিহাসের ভেতরে থেকেই নিজের ইতিহাসের তাপে ও চাপে, বা সেই ইতিহাসের অনিবার্য ছন্দঃস্পন্দে, এক অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে, নজরুল কবিতার ভাষায় এবং গানের ভাষায় তৈরি করেছিলেন এমন এক কণ্ঠস্বর যাকে চট করে চেনা যায়, যাকে অনায়াসেই আলাদা করা যায় রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর থেকেও। সেখানেই শেষ নয়। নজরুলের এই অনায়াস রবীন্দ্রনাথবিরোধিতা তিরিশের আধুনিকতাবাদী রবীন্দ্রবিরোধিতাকেও বিরোধিতা করে বটে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথেও উপনিবেশবাদবিরোধিতা ছিল বটে, যদিও সেই বিরোধিতা তাঁর ওপর পশ্চিমা উদারনৈতিকতার প্রভাবে মাঝে মধ্যে পিছুও হটেছে; এক ধরনের ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক অচেতনও সেখানে কাজ করেছে বটে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে নজরুলই বোধ করি সবচেয়ে লড়াকু উপনিবেশবাদবিরোধী লেখক যাঁকে সামান্যতম ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা স্পর্শ করেনি, যাঁর স্বার্থতাড়িত ঔপনিবেশিক টানাপড়েনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এখানে নজরুলের সেই বিখ্যাত “রাজবন্দীর জবানবন্দী” থেকে একটা উদ্ধৃতি দেয়া যাকঃ
আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যাকে অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি—কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসা ও প্রসাদের লোভে কাহারো পোঁ ধরি নাই—আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারি তীব্র আক্রমন সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে—তার জন্যে ঘরে-বাইরের বিদ্রুপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার ওপর পর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্মউপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই, নিজের সাধনালব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই।
এক সময় ইতালীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনীতিক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি বলেছিলেন ‘অর্গানিক’ বুদ্ধিজীবীদের কথা, সনাতন বুদ্ধিজীবীদের বিপরীতেই। সনাতন বুদ্ধিজীবি যেখানে তাঁর পরিচিত ও পুনরাবৃত্ত বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বিরাজমান ব্যবস্থার পুনরুৎপাদনে ভুমিকা পালন করে থাকেন, সেখানে একজন ‘অর্গানিক’ বুদ্ধিজীবী কোনো বিশেষ শ্রেণি বা জনগোষ্ঠীর পরতে পরতে গভীরভাবে জড়িত ও জারিত হয়ে সেই শ্রেণি বা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অবিভাজ্য হয়ে তার স্বার্থেই পরিবর্তনের লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই জারি রাখেন। গ্রামসীয় অর্থেই আমরা নজরুলকে বলতে পারি উপনিবেশবাদবিরোধিতার ‘অর্গানিক’ কণ্ঠস্বর, যে-কণ্ঠস্বর এখনো আমাদের যে কোনো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে ‘গমগম’ করে—পেরুর সেই তরুণ বিপ্লবী কবি রাউল ব্লাঙ্কো-কথিত মার্কসের কণ্ঠস্বরের মতোই। আর ‘অর্গানিক’ বলেই নজরুলের কন্ঠস্বর মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়েই গমগম করে ওঠে ধুমকেতু পত্রিকাটির পাতায় পাতায়। তাহলে লক্ষ্য করুন নজরুলের গমগম-করা স্পষ্ট কণ্ঠস্বরঃ
সর্বপ্রথম ধুমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায। স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশত বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না […] আমাদের এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।
পরিষ্কার যে, শুধু স্বাধীনতা নয়, দরকার “পূর্ণ স্বাধীনতা”। বলা দরকার, তৃতীয় বিশ্বের একদল লড়াকু তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী ওই পূর্ণ স্বাধীনতার ওপরই জোর দিয়েছিলেন বারবার। এখানে যাঁদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, তাঁরা হলেন ফ্রানৎস্ ফানো ও আমিলকার কাব্রাল, যাঁরা মনে করেছিলেন যে, বিউপনিবেশিকীকরণের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে “পূর্ণ স্বাধীনতা,” একমাত্র শর্ত না হলেও। কিন্তু ফানো ও কাব্রালের অনেক আগেই পূর্ণ স্বাধীনতাকে যিনি নির্বিকল্প এবং অনিবার্য ঘোষণা করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর নজরুল আগেভাগেই পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, আবেদন-নিবেদনে ওই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটেই সম্ভব নয়। নজরুল একেবারে খাঁটি সত্যটা চাঁছাছোলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন এখানে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর’ বলে তাদের সঙ্গে ডায়ালগে গিয়ে যারা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার বা গণতন্ত্রের কথা বলতে চায়, নজরুলের কণ্ঠস্বর তাদের বিরুদ্ধেই এই মুহূর্তে গমগম করতে থাকে।
আর নজরুলের কণ্ঠস্বরের একটা প্রতিধ্বনি শুনি মার্কিন উপনিবেশ পুর্তো রিকোর সাম্প্রতিক কালো নারীবাদী কবি মারথা ভিয়ানুয়েভার কবিতায়: “তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা/ তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা/ পুঁজি শেখায় ভিক্ষা/ উপনিবেশ শেখায় ভিক্ষা”। মারথা ভিয়ানুয়েভা এবং নজরুল ইসলাম উভয়েই ওই ভিক্ষাকে বা ঔপনিবেশিক নির্ভরশীলতা ও হীনম্মন্যতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এমনকি সেই বিখ্যাত হেগেলীয় ‘মালিক/ক্রীতদাস’-এর দ্বান্দিকতার পুনর্লিখন সম্পন্ন করেছিলেন মারথা ভিয়ানুয়েভা ও আমাদের নজরুল ইসলাম, এই বুঝিয়ে যে, যেখানে ক্রীতদাস নেই সেখানে মালিকও নেই। বলা দরকার, আফ্রিকার লড়াকু লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো “মনের বিউপনিবেশিকীকরণ” বা “বিউপনিবেশিকীকরণ” কথাগুলো জোরেশোরে সামনে এনেছেন তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে; কিন্তু তাঁরও অনেক আগে “গোলামী মন” ও “মনের গোলামী” কথাগুলো নজরুলই সরাসরি ব্যবহার করেছিলেন এবং তাদের বর্জন করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
এখানে আরেকটা কথা পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। যে সময়ে—অর্থাৎ গত শতকের বিশের দশকের গোড়ার দিকে—নজরুল ঔপনিবেশিক ভারতের “পূর্ণ স্বাধীনতা”র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন এবং তার জন্য প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে দাবি তুলছিলেন, সে সময়ে ভারতের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কোনো লেখক প্রকাশ্যে সেই দাবি তোলার ধারে কাছে যান নাই। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও তখন মহাত্মা হয়ে ওঠেন নাই। বরঞ্চ সেই সময় গান্ধী বলেছিলেন যে, ভারত কেবল ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস পেলেই তিনি খুশি হয়ে ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ পতাকা উড়াতে থাকবেন। (গান্ধীর এই উক্তির প্রমাণ মেলে নজরুলের কম্যুনিস্ট বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদ-এর বই কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা-য়।) আর যেভাবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন নজরুল, তাঁর বয়ানই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের ময়দানে-ময়দানে। আসলে নজরুল যেভাবে কথা বলেছেন, পরবর্তী সময়ে ঠিক একইভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন তৃতীয় বিশ্বের দু’জন উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াকু তাত্ত্বিক: একজন হচ্ছেন ফ্রানৎস্ ফানো, অপরজন আমিলকার কাব্রাল, যাঁদের কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
আর হ্যাঁ, আজকে আরো জোরেশোরে এই কথাটা সামনে আনা দরকার: ১৮৫৭ সালে ঘটেছিল ভারতের প্রথম জাতীয় মুক্তির সশস্ত্র লড়াই আর ১৯২২ সালে নজরুলের কণ্ঠেই প্রথম প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে উচ্চারিত হয়েছিল “ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা”র দাবি।
২
১৯২২ সালে যেখানে ধুমকেতু পত্রিকার পাতায় নজরুল ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন, তার কিছু আগেই, ১৯২১ সালেই, নজরুল এক অর্থে পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে ফেলেন তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। অবশ্যই বলা যাবে, ওই কবিতাটি বারবারই বুঝিযে দেয় যে, আমাদের আসল বসতি কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় যতটা না, তার চেয়ে বেশি তা ইতিহাসেই, অর্থাৎ আমাদের ইতিহাসই তো আমাদের আসল বাড়িঘর। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এও বুঝিয়ে দেয় যে, প্রেমের টান বা রক্তের টানের চেয়েও প্রবল হয়ে থাকে শ্রেণীর টান। সত্য, আমাদেরকে বারবারই যেতে হয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কাছে। এও বলা দরকার যে, যেখানে স্বাধীনতা নেই—এবং যে বাংলাদেশে আজ অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি এখনও আসে নাই—সেখানে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ার কোনো শেষ নাই। তাহলে পড়া যাক ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারো।
সৃজনশীল লেখকদের একবার কার্ল মার্কস একটা চমৎকার পরামর্শ দিয়েছিলেন এই বলে: “তোমার জমাটবাঁধা ধারণাগুলোকে ঘষতে থাকো, যাতে আগুন ধরে”। উপনিবেশবাদবিরোধী ক্যারিবীয় কবি এইমে সেজেয়ার জোর দিয়েছিলেন কবিতার ‘অগ্নিগুণ’-এর ওপর। এভাবে তাহলে বলা যায়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল শব্দের সঙ্গে শব্দ ঘষে আগুন জ্বালান; সেজেয়ার-কথিত ‘অগ্নিগুণ’ই সেই কবিতার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই কথা আমরা জানি, এবং কথাটা আমি আগেও বলেছি, তবে আবারো বলা দরকার যে, ভাষায় ও ছন্দে এমন এক অভূতপূর্ব তেজ ও ঝাঁঝ নিয়ে কবিতাটি উপস্থিত হলো যে, নজরুলকে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে একজন আলাদা শক্তিশালী কবি হিসেবে অনায়াসেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উঠে এসেছে নজরুলের অনিবার্য টগবগ-করা ইতিহাস-চেতনা, যে-চেতনা নজরুলের বারবার উচ্চারিত “আমি”-এর মধ্যস্ততায় উঠে এসেছে কবিতায়, যে-চেতনা প্রকাশ্যেই উস্কে দিয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই। এখানেও নজরুলের বিশিষ্টতা বিশেষভাবেই চোখে পড়ে।
সত্য, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শুরুতেই নজরুল একজন বীরকে সামনে এনেছেন ঠিকই; এই বীর এবং বিদ্রোহী ‘আমি’-এর বেশে খোদার আরশ ছেদ করে ঊর্ধ্বমুখী হতে চায় ঠিকই; কিন্তু তাকে ঘরেই ফিরে আসতে হয়—ফিরে আসতে হয় ইতিহাসের কাছে, মাটির কাছে, নিজের মানুষের কাছেই। কিন্তু এই নিজের মানুষ কারা? নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় জারি-থাকা বিশেষণগুলো আবারও ব্যবহার করে বলা যাবে যে, নজরুলের এই নিজের মানুষেরা হচ্ছেন তাঁরাই যাঁরা “অপমানিত,” “লাঞ্ছিত,” “উৎপীড়িত” এবং “অত্যাচারিত”। কিন্তু আবারও প্রশ্নঃ কারা এই অত্যাচারিত মানুষ?
এখানে জোর দিয়েই বলা দরকার যে, একদল নজরুল-সমালোচক নজরুলকে ‘মানবতবাদী’ হিসেবে উপস্থিত করতে গিয়ে ‘মানুষ’ বর্গটি নজরুলের নামে এমনভাবে ব্যবহার করতে থাকেন যে, সেখানে শ্রেণী-জেন্ডার-বর্ণের প্রশ্ন অনুপস্থিত থাকে। অর্থাৎ তাঁদের ভাষ্যে নজরুল উপস্থিত হন একজন উদারনৈতিক মানবতাবাদী হিসাবে। কিন্তু জোর দিয়েই বলা দরকার, নজরুল ‘মানুষ’ বর্গটা ব্যবহার করেন শ্রেণীর প্রশ্নকে বাদ দিয়ে নয় মোটেই। আর সত্যিকার অর্থেই নজরুলের ওই নিজের মানুষকে চিনতে হলে ফাঁকা বুলি হিসাবে ‘মানুষ’ বর্গটা বর্জন ক’রে বলতে হবে শোষিত কৃষক ও শ্রমিকের কথা, বলতে হবে বর্ণবাদ-আক্রান্ত কালা আদমীদের কথা (“কালা আদমী” কথাটা নজরুলের নিজেরই; যুগবাণী’র অন্তর্ভুক্ত নজরুলের একটি চোখা নিবন্ধের শিরোনামই হচ্ছে “কালা আদমীকে গুলি মারা”) এবং বলতে হবে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্নভাবেই ‘প্রোলেতারিয়েত’-হয়ে-থাকা নারীর কথা, যদিও এটাও উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁর সেই বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে নজরুল নারী ও পুরুষের সমতার পক্ষে তাঁর দুর্দান্ত সব পংক্তি রচনা করলেও চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে নজরুল কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক বয়ানের বাইরে যেতে পারেন নাই। পুরুষের—এমনকি ভীষণ ‘প্রগতিবাদী’ পুরুষেরও—মতাদর্শিক অচেতনে পুরুষতন্ত্র বিভিন্নভাবেই কাজ করতে পারে।
ফেরা যাক নজরুলের ‘নিজের মানুষ’ প্রসঙ্গে। নজরুলের এই ‘নিজের মানুষ’ চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ তাঁরা হচ্ছেন শোষিত কৃষক ও শ্রমিক—তাঁরা হচ্ছেন কুলি-মজুর-মুচি-চামার-কামার ইত্যাদি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল উৎপীড়িতদের কথা বলতে গিয়েই ওইসব সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিকসহ কুলি-মজুর-মুচি-চামার-কামারকেই বুঝিয়েছেন, যাঁদের বাদ দিয়ে ইতিহাস ও গণতন্ত্র উভয়েই কেবল অসম্পপূর্ণই নয়, অর্থহীনও বটে। এঁদের দিকেই ফিরে আসে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আপাতঊর্ধ্বমুখী গতি। এই কারণে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রবহ বা গতি শেষ পর্যন্ত উলম্ব থাকে না; তা হয়ে ওঠে স্পষ্টত আনুভূমিক বা ভূমি-সংলগ্ন। এখানে বন্ধনীতে একটা কথা বলে নেয়া দরকার। এই গতি বা প্রবহের পরিপ্রেক্ষিতেই তুমুলভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক তুলনামূলক সমালোচনা-পদ্ধতির ঘোরে অনেকেই আবার নজরুলকে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের সঙ্গে, বিশেষ করে ইংরেজ কবি পি, বি, শেলির সঙ্গে, তুলনা করে থাকেন; ভাবটা এমন যে, শেলির সঙ্গে তুলনা করলেই যেন নজরুল জাতে উঠেন। হায়রে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা!
তবে তুলনা যদি করতেই হয়, তাহলে দেখানো দরকার যে, শেলি তার বিদ্রোহের গতি ও গন্তব্যকে প্রাযই আকাশমুখী করে রাখেন। যে শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন, সোনালি, স্বপ্নিল জগতের রূপরেখা শেলি এঁকেছেন তাঁর কবিতায়, সেই জগৎ কখনো ঝুলে থাকে মেঘে, কখনো আকাশে। এ এক রোমান্টিক কল্পনার জগৎ, যে-জগৎকে শেলির আগেই এমনকি গ্যেটের ‘বিদ্রোহী’ ফাউস্টও সুযোগ পেলেই অন্বেষণ করেছেন। কিন্তু নজরুল? না, তাঁর টার্গেট আকাশ নয়; শেষ পর্যন্ত মাটিই তার ঠিকানা। এই যে ‘আকাশ’ ও ‘মাটি’র যে রূপক দুটো আমি ব্যবহার করলাম, আসলে নজরুল সেগুলো নিজেই ব্যবহার করেছেন তাঁর এক তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত প্রবন্ধে, যে প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বর্তমান বিশ্ব সাহিত্য’। এই প্রবন্ধে নজরুল বলছেনঃ
বর্তমান বিশ্ব সাহিত্যের দিকে একটু ভাল করে দেখলে সর্বাগ্রে চোখে পড়ে তার দুটি রূপ। এক রূপে সে শেলীর ‘skylark’-এর মত, মিল্টনের ‘birds of paradise’-এর মত এই ধুলি-মলিন পৃথিবীর ঊর্ধ্বে উঠে স্বর্গের সন্ধান করে, তার চরণ কখনও ধরার মাটি স্পর্শ করে না; কেবলি ঊর্ধ্বে—আরও ঊর্ধ্বে স্বপনলোকের গান শোনায়। এইখানে সে স্বপনবিহারী। আর এক রূপে সে এই মাটির পৃথিবীকে অপার মমতায় আঁকড়ে ধরে থাকে—অন্ধকার নিশীথে, ভয়ের রাতে বিহবল শিশু যেমন করে তার মাকে জড়িয়ে থাকে—তরুলতা যেমন করে সহস্র শিকড় দিয়ে ধরণী মাতাকে ধরে থাকে—তেমনি করে। এইখানে সে মাটির দুলাল।
নজরুল নিজেকে মাটির দুলাল হিসেবেই দেখেন, যদিও ওই প্রবন্ধের ভাষ্য মোতাবেক তিনি বিপ্লবের স্বপ্নও দেখেন এবং বিপ্লবে বিশ্বাস করেন, যে-বিপ্লব তাঁর নিজের মানুষ আর মাটিকে নিয়েই। হ্যাঁ, নজরুল যে বিদ্রোহীর সঙ্গে তাঁর ‘আমি’র অবিভাজ্যতা ঘোষণা করেছেন, ইতিহাসে ও ভাষায় নাজিল-হওয়া সেই বিশেষ কর্তাসত্তা নিজেই বীর, ক্ষ্যাপা, বেপরোয়া, মুক্ত জীবনানন্দ হলেও তাঁর ‘শির’ নতজানু হয় ইতিহাসের কাছেই, মাটি ও মানুষের কাছে, কেননা ইতহিাসের অনিবার্য চাপেই বিদ্রোহীকে তাঁর নিজস্ব ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করতে হয় এবং সেই কারণেই বলতে হয়, ‘আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’। এখানে যে ইতিহাসের কথা বলছেন নজরুল, তা স্পষ্টতই উৎপীড়িতের সাক্ষাৎ ইতিহাস—যে উৎপীড়িতকে ফানো বলেছেন, “রেচেড অব দ্য আর্থ”। আর এই ইতিহাস থেকেই তো তিরিশের আধুনিকতাবাদীদের অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে “সহেনা-জনতার-এ-জঘন্য-মিতালী”-মার্কা ভিনদেশি নন্দনতত্ত্বের চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।
আবার এও লক্ষ্য করা দরকার, ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল তাঁর ‘আমি’কে ফার্সি মরমিবাদী কবি জামি-রুমি-একবালের ‘আমি’র মতো কেবল ভগবৎরসে বা ঈশ্বরপ্রেমের শারাবে মশগুল রাখতে চান নাই। সেই কারণে নজরুলের ‘আমি’ মোটেই বিচ্ছিন্ন, উৎকেন্দ্রিক, কিংবা আধিভৌতিক নয়; সে অনিবার্যভাবে একাত্ম ইতিহাসের সঙ্গে, সমষ্টির সঙ্গে, ভূমির সঙ্গে। আর ভূমিই তো হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তাবৎ উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের মোক্ষম ও মুখ্য এজেন্ডা। “ভূমি আগে, প্যাচাল পরে”—এই স্লোগানটি তো লাতিন আমেরিকার আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই উঠে এসেছে, যার একটা চমৎকার চিত্র এঁকেছেন আদিবাসী ইন্ডিয়ান ঔপন্যাসিক লেজলি মারমোন সিল্কো তাঁর মহাকাব্যিক আয়তনের উপন্যাস অ্যালমানাক অব দ্য ডেড-এ। ভূমি ও ভাষার স্পন্দিত ‘ডায়ালেকটিকস’-এ ভূমিকে ভাষায় রূপান্তরিত করার কারণে আর ভাষাকে ভূমি হিসেবে ব্যবহার করার কারণে—আর এই ভাষা-ভূমির ছন্দঃস্পন্দেই—নজরুলের ভাষিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ, শ্রেণী-চেতনা, ইহজাগতিকতা সবকিছুই তাঁর ইতিহাসচেতনারই সাক্ষ্য বহন করে, যার প্রমাণ একেবারে শুরু থেকেই, অগ্নিবীণা থেকেই, স্পষ্ট হয়ে থাকে।
অবশ্যই বলতে হবে যে, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কোনো উদ্দেশ্যহীন বিদ্রোহের কবিতা নয়; তা একই সঙ্গে যুদ্ধে যাবার ও ঘরে ফেরার কবিতাই বটে, যেভাবে ক্যারিবীয কবি এমে সেজেয়ারের দীর্ঘ কবিতা নোটবুক অব এ রিটার্ন টু মাই নেটিভ ল্যান্ড আসলে যুদ্ধে যাবার ও ঘরে ফেরারই কবিতা (যদিও কবিতা দুটির অনেক বিষয়গত ও শৈলীগত পার্থক্য চোখে পড়ে)। হ্যাঁ, নজরুল তাঁর ঘরকে চিনেছিলেন স্পষ্ট করেই, যেমন তাকে জীবনানন্দও চিনেছিলেন তাঁর মতো করেই, যদিও ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিকতাবাদের ভূতের আছরে থাকা তিরিশের কবিদের অনেকেই তা চিনতে পারেন নাই। তাঁদের অনেকেই যখন বোদলেয়ার ও এলিয়টের দিকে সেজদা দিযে বুঁদ হয়ে বা ঝিম ধরে নান্দনিক ‘ট্রিপ’ নেয়ায় ব্যস্ত, তখন নজরুল একেবারে আপন ইতিহাসের ভেতরেই উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাসহ তাঁর বুঝ মোতাবেক সকল ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর সাংস্কৃতিক লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এই লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘই বটে। “আজ চারিদিক হতে ধনিক-বণিক শোষণকারীর জাত/ ও ভাই জোঁকের মতন শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত”—এই দুটি পঙ্ক্তিতে যে ইতিহাস মুহূর্তেই ঝলক দিয়ে উদ্ভাসিত হয়, যে-ইতিহাস শোষক-শোষিতের সম্পর্কের ইতিহাস, তার সঙ্গেই তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে আজকের পুঁজিবাদবিরোধী লড়াই।
নজরুল ওই লড়াইয়ের ঘোষনা দিয়েছেন একাধিকবার এবং বিভিন্নভাবেই, যেমন তাঁর কাজে বৃহত্তর অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা স্পষ্ট হয়ে থাকে এবং পুনরাবৃত্ত হয়, যদিও আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার শুরুটা ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লক্ষণীয়। ‘স্বাধীনতা’র সঙ্গে ‘মুক্তি’ কথাটার পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। ‘মুক্তি’ কথাটা ব্যাপক। তবে আমি এখানে নজরুল-কথিত “পূর্ণ স্বাধীনতা” আর ‘মুক্তি’ একই অর্থে ব্যবহার করছি। অর্থাৎ নজরুল কেবল একটি ভূখণ্ডের ভৌগোলিক স্বাধীনতার কথাই বলছেন না; তিনি আসলেই জোর দিচ্ছেন কৃষক-শ্রমিকের সার্বিক মুক্তির ওপর। সে কারণেই তাঁর জন্য জরুরি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। বিভিন্ন গানে, কৃষকের গানে ও শ্রমিকের গানে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা উচ্চারিত হয় নিঃশ্বাসের মতো এক অনিবার্য স্বাভাবিকতায়: “যত শ্রমিক শুষে নিংড়ে প্রজা/ রাজা উজির মারছে মজা/ আমরা মরি বয়ে তাদের বোঝারে!/ এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে/ দলবি রে আয় মজুর দল!/ ধর হাতুড়ি, তোর কাঁধে শাবল”। দেখা দরকার, নজরুল এই পঙ্ক্তিগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গেই উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রামকেও সম্পর্কিত করেছেন বটে।
৩
জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের প্রশ্নটা তখনই ওঠে—যে প্রশ্নটি নজরুল নিজেই তুলেছিলেন তাঁর মত করেই—যখন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ তাদের অর্থনৈতিক, মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন অব্যাহত রাখে। আর যে কোনো শ্রেণী-বিভক্ত সমাজেই শ্রেণী-সংগ্রাম থাকে; তবে তা হতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা প্রচ্ছন্ন। শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের ‘ডায়ালেকটিকস’টাকে নজরুল তাঁর মতো করে ধরতে পেরেছিলেন ঠিকই। আর এই ‘ডায়ালেকটিকস’টাকে বোঝার জন্য মার্কস ও এঙ্গেলস-এর কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো-এর একটি জায়গায় যেতে পারি কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু তার আগে জাতীয় মুক্তির লড়াই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, জাতি, জাতি-রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় মুক্তির লড়াই এক জিনিস নয়, যদিও একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময় ও স্পেসে একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। পরিসরের সীমাবদ্ধতার কারণে এখানে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব না হলেও মার্কস ও এঙ্গেলস কিভাবে ও কোন্ প্রসঙ্গে ‘জাতীয়’ বর্গটা ব্যবহার করেছিলেন তা একটু দেখে নেয়া যেতে পারে। তবে তার আগে বন্ধনীতে মার্কসের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে দুয়েকটা কথা বলে নেয়া দরকার, যদিও এটি আমার বর্তমান রচনার মূল বিষয়বস্তু নয়। আসলে বিষয়টি নিজেই একটি আলাদা ও বিশদ আলোচনা দাবি করে। তাহলে মার্কস সম্পর্কে নজরুল কি ভেবেছেন তা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে, তিনি পরম শ্রদ্ধাভরে মার্কসকে “ঋষি” বলতেন। এখানে নজরুলের প্রবন্ধ ‘বর্তমান বিশ্ব সাহিত্য’ থেকে আরেকটা উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যাক। প্রবন্ধটিতে লেনিনের বিপ্লব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মার্কসের প্রসঙ্গকে নজরুল সামনে এনেছেন এভাবেঃ
দূর সিন্ধুতীরে বসে ঋষি কার্ল মার্কস যে মারণ-মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন তা এতদিনে তক্ষকের বেশে এসে প্রাসাদে-লুক্কায়িত শত্রুকে দংশন করলে। জার গেল—জারের রাজ্য গেল—ধনতান্ত্রিক প্রাসাদ হাতুড়ি-শাবলের ঘায়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল।
একই প্রবন্ধে নজরুল এমনকি মার্কসের রাজনৈতিক অর্থনীতির রুপান্তরকামী বৈপ্লবিক শক্তি নিয়েও মন্তব্য করেছেনঃ “কার্ল মার্কসের ইকনমিকস-এর অঙ্ক এই যাদুকরের হাতে পড়ে আজ বিশ্বের অঙ্কলক্ষ্মী হয়ে উঠেছে। পাথরের স্তুপ সুন্দর তাজমহলে পরিণত হয়েছে”।
এবার তাহলে ফিরে আসি মার্কসের (এবং এঙ্গেলসের) কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো-তে, যেখানে যাওয়ার কথা ছিল আগেই—দেখা যাক সেখানে কিভাবে তাঁরা ‘জাতীয়’ বর্গটা প্রয়োগ করেছেন। কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো-এর দ্বিতীয় সেকশানেই মার্কস ও এঙ্গেলস সেই বিখ্যাত কথাটা বলেছিলেনঃ “শ্রমজীবী মানুষের কোনো দেশ নাই”। এরপর আবার এও বলেছিলেন তাঁরাঃ তাই শ্রমজীবী মানুষদের যা নেই তা তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যায় না। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর এই কথাগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত থেকে বেমালুম ছিনতাই করে অনেকেই উদ্ধৃত করে থাকেন। ওই কথাগুলো বলার পর মার্কস ও এঙ্গেলস যে আরও কিছু জরুরি কথা বলে নেন, তা প্রায়শ খেয়াল করা হয় না। সেই কথাগুলোকেই আমি এখন সামনে আনতে চাই। মার্কস ও এঙ্গেলস বলছেন যে, যেহেতু প্রোলেতারিয়েতকেই সর্বাগ্রে রাজনৈতিক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব অর্জন করতে হবে, সেহেতু তাকেই জাতির নেতৃত্বদানকারী শ্রেণী হয়ে উঠতে হবে, এমনকি নিজেকেই জাতি হিসাবে গঠন করতে হবে এবং এভাবেই এই পর্যন্ত সে জাতীয় হয়ে উঠবে, যদিও এখানে ‘জাতীয়’ কথাটা বুর্জোয়া অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে না মোটেই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কস ও এঙ্গেলস জাতি ও শ্রেণীর ‘ডায়ালেকটিকস’কে চালু রেখেছেন এবং বোঝাচ্ছেন যে, জাতি গঠনে যা ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে তা হচ্ছে শ্রেণী। বলতে হবে, নজরুলও জাতি ও শ্রেণীর সম্পর্কটাকে বুঝেছিলেন এভাবে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদ ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে কোনোভাবে প্রশ্রয় না দিয়ে জাতীয় মুক্তির লড়াই বলতে বুঝেছিলেন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমিকসহ নিম্ন শ্রেণীর মানুষের লড়াই। নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সর্বহারা’র আলোকে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে নজরুল সর্বহারাদের শ্রেণী-স্বার্থকেই কেন্দ্রিকতা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ নজরুলের বিবেচনায় জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রামের কোনো বিরোধ নাই; বরঞ্চ ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের আরেক নাম শ্রেণী সংগ্রাম, যদিও নজরুল ইসলাম কখনই কোনো অর্থে ‘জাতীয়তাবাদী’ ছিলেন না। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী কিন্তু ভীষণভাবে ভূমি-সংলগ্ন ও শ্রেণী-সংলগ্ন।
হাঁ, মার্কসীয় অর্থেই নজরুল ‘জাতীয়’ হলেও কম্যুনিস্ট বলেই (তত্ত্বের তত্ত্ববাগিশ ‘কম্যুনিস্ট’ না, সৃষ্টিশীলভাবেই কম্যুনিস্ট) তিনি দারুণভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদী। এখানে বন্ধনীতে আরেকটু বলে নেয়া যায়ঃ তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ—একমাত্র না হলেও—অংশ হচ্ছে তাঁর বিশ্বসাহিত্যভাবনা। নজরুল ওই তথাকথিত ‘বিশ্ব সাহিত্য’-এর আধিপত্যবাদী ‘বিশ্ব’কে আগেভাগেই ঠিকঠাক চিনে নিয়েছিলেন। এদিক থেকেও তিনি ‘তিরিশ’-এর ওইসব ‘পণ্ডিত’-কবির চেয়েও আলাদা। এমনকি তিনি যে পোলিশ লেখকদেরও মনোযোগ দিয়ে পড়তেন, তারও প্রমাণ মেলে তাঁর লেখা ‘বর্তমান বিশ্ব সাহিত্য’ প্রবন্ধে, যে-প্রবন্ধ বর্তমান সময়ের তাগিদেই আমাদের পুনর্পাঠ দাবি করে বলে আমি মনে করি।
তাহলে আন্তর্জাতিকতাবাদের নিরিখে, কিন্তু একই সঙ্গে ভূমি-সংলগ্নতা ও শ্রেণী-সংলগ্নতার নিরিখেও, এবং পুঁজিবাদ-ও-সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতাসহ অন্তর্গত বিপ্লবী স্বভাবের নিরিখেও নজরুলের সঙ্গে বিশেষভাবে তুলনীয় হচ্ছেন লাতিন আমেরিকার বা এল সালভেদরের কমিউনিস্ট কবি রোকে ডালটন (১৯৩৫-১৯৭৫), যিনি অবশ্য বয়সে নজরুলের ছোট। আর নজরুলের মতোই রোকে ডালটন লিখেছেন বেশ কিছু ছোট ছোট বিদ্রোহী কবিতা—বিদ্রোহী ব্যাঙ্গ কবিতাও। এই রোকে ডালটনের খানিকটা নজরুলীয় স্বভাবের প্রসঙ্গ ধরেই আমরা ত্রিমহাদেশীয় লড়াকু কাব্যতত্ত্বের কথা বলতে পারি। ‘ত্রিমহাদেশীয়’ বর্গটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন চে গুয়েভারা, সেই ১৯৬৬ সালে, যদিও এই নির্দিষ্ট বর্গটির ‘পেছন-ধারণা’ এসেছিলো খোদ মাও জে দং-এর কাছ থেকে, এটাই বোঝানোর জন্য যে, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একটি গভীর রাজনৈতিক ঐক্য রয়েছে ওই জায়গায় যেখানে এই তিনটি মহাদেশই বিভিন্নভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শাসনে, আক্রমণে ও আগ্রাসনে আক্রান্ত। এই কারণেই চে গুয়েভারা জোর দিয়েছিলেন ওই তিন মহাদেশের জনগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যের ওপর। আর চে গুয়েভারার সঙ্গে তাল মিলিয়েই কবি রোকে ডালটন জোর দিয়েছিলন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লড়াকু লেখকদের বিপ্লবী সংযোগ, সংহতি ও মৈত্রীর ওপর।
কিন্তু এই মৈত্রী তো আপনা-আপনি সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পড়ে লেখকদের সঙ্গে লেখদের কিংবা কবিদের সঙ্গে কবিদের রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও নান্দনিক মিলগুলো খুঁজে বের করার। এই কাজটি করতে পারে তুলনামূলক সাহিত্য নিজেই। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্য প্রায়ই থেকেছে ইউরোপকেন্দ্রিক। আমরা জানি যে, নজরুলকে প্রায়ই তুলনা করা হয় বায়রন, শেলি ও হুইটম্যানের সঙ্গে; মনে হয়, এইসব শাদা মহারথীর সঙ্গে নজরুলকে তুলনা না করলে তিনি যেন জাতে ওঠেন না! কিন্তু নজরুলের সঙ্গে মিল রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী কবির। তুলনার ওই উপেক্ষিত বা অকর্ষিত অঞ্চল ধরেই তো সম্ভব ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্বকে সামনে এনে তুলনামূলক সাহিত্যের বিউপনিবেশিকীকরণ ঘটানো।
হ্যাঁ, অবশ্যই বলতে হবে যে, একটি গর্জে-ওঠা ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্বকে সামনে আনতে গেলে অবশ্যই প্রথমেই নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাগুলো পাঠ করতে হয়। এও বলা দরকার, তাঁর নিজস্ব উচ্চারণ অনুসারেই নজরুল কেবল বিদ্রোহী কবি-ই নন; তিনি মূলত বিপ্লবী কবি, যিনি মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বার্থেই বিরাজমান ব্যবস্থার বিনাশকে জরুরি বিবেচনা করেছিলেন এবং তীব্রভাবেই চেয়েছিলেন নতুন ব্যবস্থার—সাম্যবাদী ব্যবস্থার—উদ্বোধন। আর তাঁর কাব্যস্বভাব এবং বিদ্রোহী ও বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে তৃতীয় বিশ্বের আরো অনেক লড়াকু কবির কাব্যস্বভাবের ও বিপ্লবী চেতনার। এইসব কবির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত, এল সালভাদরের রোকে ডালটন তো আছেনই, গুয়াতেমালার ওতো রেনে কাস্তিও, নিকারাগুয়ার এর্নেস্তো কার্দেনাল ও গিয়োকান্দা বেই-ই, চিলির পাবলো নেরুদা, পুর্তো রিকোর হুলিয়া দ্য বুর্গোজ ও পেদ্রো পিয়েত্রি, মার্তিনিকের এইমে সেজায়ার, কিউবার কালো কবি নিকোলাস গিয়েন, দক্ষিণ আফ্রিকার কুমালো ও ডেনিস ব্রুটাস, এ্যাঙ্গোলার ভিরিয়াতো দ্র ক্রুজ ও আন্তোনিও জাসিন্তো, সিরিয়ার নিজার কাব্বানি, ফিলিস্তিনি কবি রশিদ হোসেন ও মাহমুদ দারবিশ, পাকিস্তানের ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও বালাখ খান এবং কোরিয়ার কবি কিম চি হা। তাঁদের সঙ্গে নজরুলের সুনির্দিষ্ট সাদৃশ্য নিযে যে কোনো আলোচনা আসলেই বিস্তর পরিসর দাবি করে।
তবে এখানে এই তথ্যটি সামনে আনা দরকার যে, কিউবার কবি ফার্নান্দেজ শেরিকানের হাতে নজরুলের কবিতার কিছু ইংরেজি অনুবাদ পৌঁছলে তিনি নিজেই তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক সংহতি ঘোষণা করে নজরুলের কয়েকটি কবিতা হিস্পানি ভাষায় অনুবাদ করেন। অন্যদিকে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ‘চিকানো’ কবি (মেক্সিকান-আমেরিকান)কবি লুইস রডরিগেজ ও জিমি সান্তিয়াগো বাকা নজরুলের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ শোনার পর যে উব্দেলিত ও অনুপ্রাণিত প্রতিক্রিয়া জনসমক্ষে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেন, তার মর্মশাস হলো এই: নজরুল আমাদেরও বিদ্রোহী কবি। বলা দরকার, রডরিগেজ ও বাকা উভযেই প্রবলভাবে মার্কিন-সাম্রাজ্রবাদবিরোধী কবি।
এখানে বন্ধনীতে একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে নেই। ২০১৭ সালে গিয়েছিলাম কিউবার হাভানায়। জানুয়ারারির দুপুর উপুর করে ঢেলে-নেয়া সমস্ত রৌদ্রে যখন ঝলমল করছিল কিউবার হাভানা, তখন আমরা—কয়েকজন কিউবান লেখক আর আমি—কবিতা আর বিপ্লব নিয়ে আলাপ করছিলাম ওয়ার্কারস ইউনিয়ন-এর এক ক্যাফেতে । যখন এক পর্যায়ে তাদের জানালাম যে, কাস্ত্রোকে নিয়ে চে গুয়েভারা আর পাবলো নেরুদার কবিতা আমি নিজেই বাংলায় তর্জমা করেছি, তখন এক কালো কিউবান কবি—হাবিয়ের রদরিগেজ—আমাকে কিছু লাইন বাংলায় পড়ে শোনাতে বলল। পড়লামও। সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললঃ “মায়ের ভাষায় যে ফিদেলের কথা, চে’র কথা, বলতে চায়, সে আমাদের ভাই, সে আমাদের বোন।” নজরুলের কবিতাও পড়েছি। সেকি উন্মাদনা তাদের। কিউবার আরেক কবি—জোল সুয়ারেজ—তখন বলে উঠলোঃ “হোসে মার্তি আর নিকোলাস গিয়েনের মত নজরুলও কিউবার কবি!” প্রায় একই ধরনের আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়। ২০০৫ সালে ওয়াশিংটন স্টেইট ইউনিভার্সিটি-তে আমার প্রিয় লেখক, বন্ধু এবং কমরেড—আফ্রিকার অন্যতম ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-তাত্ত্বিক—নগুগি ওয়া থিওঙ্গো’র সঙ্গে নজরুল নিয়ে বেশ কথা হয়েছিল। আর নজরুলকে নিয়ে আমার কথা শোনার পর তিনি নির্দ্বিধায় বলে উঠেছিলেন, “কমরেড! নজরুল আমার প্রাণের কবি, এমনকি আমাদের আফ্রিকারও কবি”।
আমি এই পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের যে কয়জন কবির নাম দ্রুত উল্লেখ করেছি, তাঁদেরকে কেবল বামধারার রাজনৈতিক কবি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না মোটেই। তাঁদের কবিতা এক সঙ্গে জড়ো করলে অবশ্যই একটি গর্জে-ওঠা ত্রিমহাদেশীয় কাব্যতত্ত্ব দাঁড়িয়ে যায়। এই কাব্যতত্ত্বের কয়েকটি মূলকথা এভাবে বলে নেওয়া যায়: প্রথমত, কবিতা অন্তর্নিহিতভাবেই রাজনৈতিক এই কারণে যে, কবিতা ভাষার সম্ভাবনাকে সম্প্রসারিত করতে গিয়ে এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন উৎসমুখ খুলতে গিয়ে বিরাজমান ভাষিক আধিপত্যকে ও প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যকেও অর্থাৎ ক্ষমতাকেই বারবারই চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। দ্বিতীয়ত, এভাবে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে কবিতা নিজেই হয়ে ওঠে প্রাক্সিস। তৃতীয়ত, সব কবিতা এক সমতলে আসে না; কবিতারও থাকে মতাদর্শিক পক্ষপাত ও অভিক্ষেপ। চতুর্থত, রহস্যময়তাই কবিতার শেষ কথা নয়। পঞ্চমত, নতুন ভাষা তৈরি করার ভেতর দিয়েই যে কবিতা একটি জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের তাবৎ অনুশীলনের সমগ্রকে ধারণ করতে পারে না, সেই কবিতা সেই জনগোষ্ঠীকে নাড়া দিতে পারে না। ষষ্ঠত, কবিরা ঘুমাবার সময় হয়তো ঘুমান, কিন্তু জাগরণের সময় সবাইকে নিয়েই জেগে থাকেন। সপ্তমত, প্রযোজন হলে একটি কবিতা নিজেই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে হয়ে উঠতে পারে বুলেট কিংবা বারুদ কিংবা বন্দুক। অষ্টমত, কবিতা কোনো ধরনের পরাধীনতা বা দাসত্বকে বরদাশত করে না, কেননা কবিতা মানেই মুক্তিযুদ্ধ।
সবশেষে নজরুলের কাজের সমগ্রকে বিবেচনায় রেখেই নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর উদ্দেশেই আমার এই উক্তি-নিবেদনঃ যে-কবি হরফে হরফ ঘষে আগুন জ্বালান এবং যে-কবি জনপদের হাজার বছরের ইতিহাস একটি চিত্রকল্পেই ঝলকে তুলেন এবং যে-কবি চিন্তাকে চিহ্নে ও চিহ্নকে চিন্তায় ঘটনা হিসাবে নাজিল করেন এবং যে-কবি তাঁর বাক্যে-বাক্যে ধ্বংস করেন সৃষ্টিবিরোধী প্রথা আর প্রতিষ্ঠান এবং যে-কবি অসম্ভবকে টার্গেট করে ভাষা দিয়ে নতুন দুনিয়া বানাতে চান এবং যে-কবি এমনকি নতুন মানুষ পয়দা করার কথা বলেন, সেই কবি কেবল আমার প্রিয় কবিই নন, তিনি আমার নেতাও। আর সেই কবি-নেতা হচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম।