শিরোনাম
বৃহঃ. ডিসে ৪, ২০২৫

নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভোটার টানার নয়া কৌশল

বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমছে। নানা কারণে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা যাচ্ছে না। এবার ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতে ভিন্ন কৌশল হাতে নেয়া হয়েছে। আগামী ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটে যাওয়া নিশ্চিত করতে কোনো কোনো এলাকায় উপকারভোগীদের সংশ্লিষ্ট কার্ড জমা নেয়া হচ্ছে। যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও হবিগঞ্জে সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের কার্ড জমা নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা এই কার্ড জমা নিচ্ছেন বলে উপকারভোগীরা জানিয়েছেন।

কেউ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হলে তার কার্ড বাতিলেরও হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক জেলায় এমন কার্যক্রম শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সরকার অনেকগুলো খাতে ভাতা ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা, ভিডব্লিউবি, ভিজিএফ, ভিজিডি, জিআর, টিআর, ওএমএস, টিসিবি ইত্যাদি। নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব খাতের উপকারভোগীদেরই কার্ড জব্দ করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।

যদিও এসব খাতের বেশির ভাগ অর্থই অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিয়ে থাকে সরকার। তবুও এভাবে কার্ড জব্দ করায় অনেকে আতঙ্কে আছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি জেলায় অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষ রয়েছেন সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগী। এসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে কেন্দ্রমুখী করা গেলে নির্বাচনে ভোট পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, যশোর জেলায় বিভিন্ন খাতে ভাতাভোগী রয়েছেন- মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০ জন। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতার কার্ডধারী ১ লাখ ২৫ হাজার ৩১ জন, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডধারীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৮৭৩ জন, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতার কার্ডধারীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৭০০ জন, প্রতিবন্ধী শিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্ত কার্ডধারী পরিবারের সংখ্যা ১ হাজার ৭৯৩টি, সরকারি শিক্ষা উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার, টিসিবি পণ্য সরবরাহ কার্ডধারীর সংখ্যা ৫৬ হাজার ২২১ জন। এ ছাড়াও জেলার ৮টি উপজেলায় কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের তালিকাভুক্ত দিনমজুর নারী পুরুষের সংখ্যা আরও প্রায় ৬৫ হাজার। সব মিলিয়ে যশোর জেলায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখের মতো। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দলের প্রার্থী ও তাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা এসব কার্ডধারীদের টার্গেট করেছেন। যে এলাকা যার নিয়ন্ত্রণে তারাই এসব কার্ডধারীদের জিম্মি করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যশোর পৌর সভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের একজন বয়স্ক ভাতাভোগী (পুরুষ) বলেন, পরশু একজন আওয়ামী লীগ নেতা লোক পাঠিয়ে আমাকে তার বাড়িতে ডাকেন। এ সময় তিনি বলেন- নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় যেন আমার বয়স্ক ভাতার কার্ডটি নিয়ে যাই। তার কথামতো ওই কার্ডটি নিয়ে পরদিন সকালে ওই নেতার বাড়ি যাই। তিনি আমার কাছ থেকে কার্ডটি নিয়ে সাফ জানিয়ে দেন ৭ই জানুয়ারি সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দিলে তিনি কার্ডটি ফেরত দিবেন। না হলে এই কার্ড আর পাওয়া যাবে না। পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষপাড়া এলাকার আরেক বাসিন্দা (নারী) জানান, স্থানীয় একজন নেতার কথা বলে এলাকার ছেলেরা তিনিসহ তার আশপাশের ৫টি ভিজিএফ চালের কার্ড নিয়ে গেছে।

১ নম্বর পৌর ওয়ার্ডের স্বামী পরিত্যক্তা একজন দুস্থ নারী জানান, বহু চেষ্টা তদবির করে ৩ বছর আগে তিনি এই কার্ডটি করেছিলেন। কার্ডের বিনিময়ে তিনি প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাচ্ছিলেন। কিন্তু ২ দিন আগে এসে ওই নেতার লোকজন তার কার্ডটি নিয়ে গেছেন। যশোর পৌর এলাকার মতো বিভিন্ন উপজেলার সব ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা কার্ডধারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার্ড সংগ্রহ করছেন। আর বলছেন, ভোট না দিলে এসব কার্ড আর ফেরত দেয়া হবে না। বিশেষ করে যারা ভোটকেন্দ্রে যাবে না তাদের খবর আছে বলেও হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন ওই সব নেতাকর্মীরা।

একই চিত্র দেখা যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ও। জেলার বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে কার্ডগুলো। ৭ই জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান শেষেই কেবল এসব কার্ড ফেরত পাবেন বলে জানানো হয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত এসব কার্ড বাতিল করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান। মানবজমিনকে তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এমনটা করা হচ্ছে। বেশকিছু দিন ধরে এসব কার্ড জব্দ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এদিকে ভুক্তভোগীরা জানান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তরের লোকজনও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

হবিগঞ্জেও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের টার্গেট করেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জব্দ করেছেন উপকারভোগীদের কার্ড। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। অতি গোপনীয়তায় পরিচালিত হচ্ছে বিশেষ এই কাজ। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। ভোটের দিন এসব উপকারভোগীদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের পরিকল্পনা করেছেন তারা।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তারা (ক্ষমতাসীন) কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে, যদিও এটা হচ্ছে সাজানো একটা নির্বাচন। নির্বাচনটা হওয়ার কথা ছিল প্রভাব ও মতলবমুক্ত। যার মাধ্যমে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবে। বর্তমানে যেটা হচ্ছে তা হচ্ছে নির্বাচন নির্বাচন খেলা। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের কাছ থেকে যদি কার্ড জব্দ করা হয় তাহলে তা হবে মানুষকে জিম্মি করার শামিল। এটা অবিশ্বাস্য, কল্পনাতীত এবং অরাজকতা ছাড়া কিছুই না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য না।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *