জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে ততই প্রশাসনের মধ্যে এতদিন ধরে যারা আওয়ামী লীগার হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় দিত, আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় আওয়ামী লীগ হিসেবে জাহির করত তারা বোল পাল্টাতে শুরু করেছে। তাদের মুখোশ খুলে যাচ্ছে। তারা এখন আস্তে আস্তে নিরপেক্ষ হচ্ছে। কোথাও কোথাও সরকারের সমালোচনা করছে।
সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে যে প্রশাসনের গতি শ্লথ হয়ে গেছে। অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী এজেন্ডার চূড়ান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে। কেউ কেউ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিরোধীপক্ষের হাতে দিচ্ছে। অনেকের মধ্যেই শোনা যায় সরকারের সমালোচনার সমালোচনা। অথচ কদিন আগেও তারা সরকারের স্তুতি করতেন।
আওয়ামী লীগ টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় রয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যারা লাভবান হয়েছে তাদের মধ্যে সিভিল প্রশাসন অন্যতম। আওয়ামী লীগ সরকার এদের দু’দফা বেতন বৃদ্ধি করেছে এবং এখন সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ঈর্ষণীয়। বেতন ছাড়াও বিভিন্ন রকমের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি হলো দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। একসময় সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি ছিল ডুমুরের ফুলের মতো। সেখানে এখন নিয়মিত পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। আর এই পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিবের একটা জট তৈরি হয়েছে সিভিল প্রশাসনে। যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তারা সকলেই সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। কে কিভাবে আওয়ামী লীগ ছিলেন এবং কার আত্মীয় কখন, কিভাবে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন তার ফিরিস্তি দিতে দিতেই তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে এই সমস্ত চাটুকার আমলাদের একটি বড় অংশই আসলে বিভিন্ন সময়ে সুবিধাবাদী অথবা বিএনপি-জামাত ঘরোনার।
গত পাঁচ বছরে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ সচিব পদে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের মধ্যে খুব কমই আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে বলে অনুসন্ধানে পাওয়া যাচ্ছে। বরং অতীতে বিএনপি-জামাত ঘরোনার ছিলেন, বিএনপির ঘনিষ্ঠ ছিলেন—এমন ব্যক্তিরাই সচিবালয়ের সচিব পদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে যারা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ থেকে এসেছেন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেন তাদের চাকরি জীবনে তারা সচিব হলেও খুব গুরুত্বহীন এবং অপাংক্তেয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় যে বিএনপি-জামাত আমলেও যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন এবং সবসময় সততা নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন তাদের একজন এখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বটে কিন্তু সেখানে তিনি টিকতে পারেননি। ছাত্রলীগ করে পরবর্তীতে সরকারি চাকরি করে মেধার পরিচয় দিয়েছেন এমন একজন মেধাবী সচিব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন।
আবার অন্যদিকে জামাত-বিএনপি পরিবার থেকে এসে কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপি-জামাত আমলে প্রচণ্ড দাপুটে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তারও করেছিলেন তেমন একজন ব্যক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। এরাই সামনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে বিভিন্ন মহল মনে করছেন। কারণ এরা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের স্বার্থ দেখে না। এরা বিভিন্ন পদে থেকে এখন সরকারি কাজকর্মকে থামিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন ফাইলে নানা প্রশ্ন তুলছে এবং নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে কাজ বিলম্বিত করছে। এর ফলে নির্বাচনের সাত মাস আগে থেকেই সচিবালয়ের কাজের এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।

