আসাম ‘লাল নদের (ব্রহ্মপুত্রকে অসমিয়াতে লোহিত বলা হয়) এবং নীল পাহাড়ের (পূর্ব হিমালয় পর্বতমালা) দেশ’ নামেও পরিচিত।
মহানব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বতের মান-সরোবর হ্রদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে, আসামের বৃক্ষাচ্ছাদিত পাহাড় ও ঘূর্ণায়মান সমভূমির আঁকাবাঁকা পথ ধরে প্রবাহিত হয়েছে। আসাম পর্যটনের প্রধান আকর্ষণ গুলি হল – প্রাচীন পৌরাণিক গাথা, প্রলোভিত সঙ্গীত এবং নৃত্য, বিশ্ব বিখ্যাত চা, বৈচিত্র্যময় রঙিন উপজাতি এবং শেষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ – এক বিরল প্রজাতি একশৃঙ্গ গণ্ডার।
এখানকার অমায়িক মানুষ এবং আসামের চমৎকার সুবাস যুক্ত এক কাপ চা আপনার ভ্রমণকে চিরস্মরণীয় করে তুলবে।
আসামে ভ্রমণ করার পূর্বে আসাম সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিন –
আসাম পৌঁছানোর উপায়
আসাম, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রবেশদ্বার তাই এই রাজ্যের উন্নত পরিবহন প্রয়োজনীয়তা উত্তরপূর্ব অঞ্চলের ভবিষ্যত বিস্তৃতির জন্য অত্যাবশ্যক। আসাম বিমান, রেল ও সড়ক পথ দ্বারা দেশের বাকি অংশ গুলির সাথে সংযুক্ত।
বিমানপথ দ্বারা
আসামে প্রধান বিমানবন্দর হল, আসামের বৃহত্তম শহর গুয়াহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদোলোই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দর দৈনন্দিন উড়ান দ্বারা ভারতের প্রধান শহরগুলির সাথে সংযুক্ত। আসামের অন্যান্য বিমানবন্দরগুলি জোড়হাট, ডিব্রুগড়, তেজপুর এবং শিলচরে অবস্থিত। এই বিমানবন্দরগুলিতেও নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়ার উড়ান চলাচল করে।
রেলপথ দ্বারা
ভারতীয় রেলওয়ের উত্তর পূর্ব রেল জোন দ্বারা আসামের বৃহত্তম শহর গুয়াহাটি দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্ত। গুয়াহাটি উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রেলের সদর দপ্তর। ভ্রমণকারীরা রেল পথের মাধ্যমে আসামে সুবিধাজনকভাবে পৌঁছতে পারে কারণ এটি ভারতের সব প্রধান শহরগুলির সাথে রেলপথ দ্বারা সু-সংযুক্ত। এই রাজ্যের মধ্যে কিছু শহর গুয়াহাটি থেকে ট্রেন পরিষেবা দ্বারা সুসংযুক্ত।
সড়ক পথ দ্বারা
উত্তরপূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার হওয়ায় আসাম জাতীয় মহাসড়কের একটি সু-জালবিন্যাস দ্বারা বিভিন্ন শহর এবং অন্যান্য রাস্তা দ্বারা রাজ্যের কাছাকাছি শহরগুলির সাথে সংযুক্ত। ৩৭-নং, ৩১-নং, ৪০-নং, ৩৮-নং ও ৫২-নং জাতীয় সড়ক আসাম ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। রাজ্য পরিবহন ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিচালকরা যাত্রীদের জন্য দৈনিক বাস পরিষেবা প্রদান করে। এছাড়াও এই রাজ্যের মধ্যে যাতায়াত করার জন্য ট্যাক্সি ও জীপ ভাড়া করা যায়।
গুয়াহাটি পর্যন্ত দূরত্ব
- শিলং থেকে – ১০০ কিলোমিটার।
- শিলিগুড়ি থেকে – ৪২৯ কিলোমিটার।
- পাটনা থেকে – ৮৮৯ কিলোমিটার।
- কলকাতা থেকে – ১০২০ কিলোমিটার।
- রাঁচি থেকে – ১০৪৬ কিলোমিটার।
আসামের পরিদর্শনমূলক স্থান
আসাম, উত্তুঙ্গ নীল পাহাড় এবং শ্যামলিমা সমৃদ্ধ রহস্যময়দেশ, উত্কলিত নদী উপত্যকা সহ ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের প্রবেশদ্বার। পর্যটকদের জন্য এক জনপ্রিয় গন্তব্য উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অচিরপ্রবাস, আসামে বহু সংখ্যক পর্যটক আকর্ষণ আছে।
মহান ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বত থেকে প্রবাহিত হয়, যা আসামের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে বয়ে চলে রাজ্যের সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। সকালের কোমল রোদ ও সন্ধ্যে বেলার শীতল হাওয়া উপভোগ করতে প্রায়সই এই নদতটে পর্যটকদের পদযাত্রা করতে দেখা যায়। পর্যটকরা প্রায়ই এখানে নৌকা যাত্রা উপভোগ করে যা ব্রহ্মপুত্র থেকে নিকটস্থ নদী দ্বীপ মাজুলী পর্যন্ত নিয়ে যায়। মাজুলী বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ এবং বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি কেন্দ্র হিসাবে দাবী রাখে।
স্পন্দনশীল রঙে উল্লসিত এবং সাংস্কৃতিক উন্মত্ততায় সমৃদ্ধিশালী, আসামে পর্যটকরা একটি আড়ম্বরপূর্ণ সময় কাটাতে পারেন। আসামের শহরগুলিতে ঐতিহাসিক অতীতের একটি মনোরম সংমিশ্রণ সহ শহুরে বিশ্বজনীন সংস্কৃতিও লক্ষ্যণীয়।
পূর্বের আলোক, প্রাগজ্যোতিষপুর বা গৌহাটি পর্যটন আকর্ষণে সমৃদ্ধ, সোনার পৌরাণিক দেশ তেজপুর বা শোণিতপুর, ডিগবয় এবং শিবসাগর তৈল ক্ষেত্র, হাফলং এবং ভালুকপং-এর ন্যায় শৈল শহর এই ভাববিলাসী ঐশ্বর্যশালী পার্বত্য দেশকে ঘিরে রেখেছে।
আসামের দর্শনীয় স্থান
আসামের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে –
- কামাক্ষ্যা মন্দির।
- হাফলং।
- শিবসাগর।
- মাজুলী দ্বীপ।
- মানস জাতীয় উদ্যান।
- কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান।
- হাজো।
- অগ্নিগড়।
* আসামের কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যটক আকর্ষণগুলির বিষয়ে নীচে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে –
কামাক্ষ্যা মন্দির
শ্রেণী : ধর্মীয়
এটি ভারতের তান্ত্রিক বৌদ্ধদের একটি আসন। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগবান শিব যখন পার্বতীর মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়েপার্বতীর মৃতদেহ টুকরো টুকরো করেছিলেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী পার্বতীর যোনি এখানে পড়ে ছিল, তারপর থেকে এটি এক অত্যন্ত পবিত্র শক্তিপীঠে পরিণত হয়।
হাফলং
শ্রেণী : প্রকৃতি
এটি একটি চিত্রানুগ শৈল-শহর, এখান থেকে আপনি নীচে রামধনু দেখতে পাবেন। জাটিঙ্গা, হাফলং থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যা পরিযায়ী পাখিদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার জন্য বিখ্যাত।
শিবসাগর
শ্রেণী : ইতিহাস ও সংস্কৃতি
এই ঐতিহাসিক শহরের কেন্দ্রে ২০০ বছর বয়সী শিবাসাগর নামক এক জলাশয় আছে। শিবাদোল ভারতের তিনটি সর্বোচ্চ শিব মন্দিরের মধ্যে একটি।
মাজুলি দ্বীপ
শ্রেণী : প্রকৃতি
ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যস্থলে অবস্থিত, এটি পৃথিবীর বৃহত্তম নদী দ্বীপ। ১৫-টির ওপর বৈষ্ণব মঠ বা ক্ষেত্র মাজুলীর উপর অবস্থিত।
বন্য প্রাণীর বিপুল বৈচিত্র্য আসামে বহু পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আফ্রিকা ছাড়া, সম্ভবত বিশ্বের কোন অংশে এইরকম বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র্য দেখা যায় না।
মানস জাতীয় উদ্যান
শ্রেণী : বন্যপ্রাণী
মানস নদীর তীরে অবস্থিত, এটি ব্যাঘ্র সংরক্ষণের জন্য সুপরিচিত এবং এছাড়াও এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান
শ্রেণী : বন্যপ্রাণী
এটি একশৃঙ্গ গণ্ডারের আশ্রয় স্থল। এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
হাজো
শ্রেণী : ধর্মীয়
বেশ কিছু বিখ্যাত মন্দির, পীর গিয়াসউদ্দিন আউলিয়া দ্বারা নির্মিত মসজিদ পোয়া মক্কা, প্রভু বুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ বহনকারী হায়াগ্রিব মাধব মন্দির সহ এই স্থানটিকে হিন্দু, ইসলাম ও বৌদ্ধধর্মের একটি সংমিশ্রণ বলা যেতে পারে।
অগ্নিগড়
শ্রেণী : প্রকৃতি
তেজপুরে অবস্থিত এটি আসামের এক আবশ্যক পরিদর্শনমূলক স্থান। এখান থেকে ব্রহ্মপুত্র ও তেজপুরের একটি মনোহর দৃশ্য দেখা যায়।
আসামে কেনাকাটা
যেহেতু, এই রাজ্য ঐতিহ্যগতভাবে হস্তশিল্প দ্বারা সমৃদ্ধ তাই আসামে কেনাকাটা মানেই এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। আসামের প্রচুর পরিমাণে হস্তনির্মিত বস্তু পাওয়া যায়। আসাম এছাড়াও ঐতিহ্যগত হস্তচালিত তাঁত উৎপাদনে শ্রেষ্ঠতম। আসাম অনন্য মানের রেশম উৎপাদনের জন্যও সুপরিচিত।
আসামে কেনাকাটা করার সময় কিছু নিম্নলিখিত বিষয় দেখে নিন –
- মৃত্তিকা,কর্ক(পীঠ), কাঠ,বাঁশ,কাপড় এবং মাটির মিশ্রণ দ্বারা তৈরি হস্তনির্মিত খেলনা।
- বিভিন্ন ধরনের রেশম বস্ত্র – মুগা (অনন্য সুবর্ণ সিল্ক যা শুধু এই রাজ্যে উপলব্ধ), পাট, এরি।।
- তাঁতজাত পণ্য যেমন লাইচেম্পি (লেপের উপাদান)।
- বেত ও বাঁশের কাজ।
- কাঁসা এবং পিতলের আলঙ্করিক উপাদান।
- বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র।
- আদিবাসী শিল্পকলার অন্তর্ভুক্ত মুখোশ ভাওনাস।
- কাঁসার তৈরি পণ্য।
- আসামের চা।
এই রাজ্যে বৃহৎ সংখ্যক সরকারি এম্পোরিয়া এবং ব্যক্তিগত দোকান রয়েছে। প্রধান শপিং কেন্দ্র গুলি হল গুয়াহাটির ফ্যান্সি বাজার, পল্টন বাজার এবং পান বাজার।
ভারতের যে কোনো অন্যান্য গন্তব্যের মত আসামের স্থানীয় বিক্রেতারা সন্ধ্যায় রাস্তার পাশে বহু জিনিসপত্র বিক্রি করে। সামান্য দড়াদড়ি জিনিসের বৈচিত্র্য এবং মূল্য নিশ্চিত করে।