শিরোনাম
শুক্র. ডিসে ৫, ২০২৫

নয়-এগারো কী পার্থক্য গড়েছে

।। জোসেফ এস নাই।।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা ছিল ভয়াবহ একটি ধাক্কা। টুইন টাওয়ারে আটকে পড়া মানুষদের লাফিয়ে নিচে পড়ার দৃশ্য ভোলার নয়। এই হামলার প্রেক্ষাপটে যেসব নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো তখন থেকেই জীবন বাস্তবতার অংশ হয়ে গেছে।

সংশয়বাদীরা সন্দেহ করতেই পারেন, এটা ইতিহাসের একটা বাঁকবদলের ক্ষণ কিনা। তারা মনে করতেই পারেন, আমেরিকার যে শক্তিমত্তা সে তুলনায় ওই হামলার তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি কোনো বিষয়ই না। কিন্তু ২০০১ সালে আমেরিকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এর পরিণামে ইন্স্যুরেন্স খাতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। আল কায়েদা চারটি বিমান ছিনতাই করে সেগুলো ক্রুজ মিসাইলের মতো ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছিল। এতে নিউইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া ও ওয়াশিংটনে তিন হাজারের মতো মানুষ মারা গিয়েছিল।

এই সব বাস্তবতা বিবেচনায় আমার নিজের কাছে মনে হয়, ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদেরা নয়-এগারোর হামলাকে, ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে জাপানিদের হামলার দিনটার মতো একই রকম গুরুত্ব দেবেন। হাওয়াইতে আমেরিকার ঘাঁটিতে জাপানিদের আচমকা হামলায় দুই হাজার চার শ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিলেন। আটটি যুদ্ধজাহাজসহ ১৯টি নৌযান ধ্বংস হয়েছিল। এ হামলার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছিল জন মনস্তত্ত্বে। ২০০০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে জর্জ ডব্লিউ বুশ একটা নমনীয় পররাষ্ট্র নীতি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু নয়-এগারোর হামলার ধাক্কায় তিনি ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেন। আফগানিস্তান ও ইরাক-দুই দেশেই অভিযান শুরু করেন।

নয়-এগারো পরবর্তী যুদ্ধে কমপক্ষে ১৫ হাজার মার্কিন সেনা ও ঠিকাদার নিহত হয়েছেন। এ সব যুদ্ধের ব্যয় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া অনেক বিদেশি বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন। উদ্বাস্তু হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। সবকিছুর বিবেচনায় যুদ্ধের ক্ষতি অপূরণীয়। যুদ্ধের কারণে যে সব সুযোগ হাতছাড়া করতে হয়েছ, সেটার পরিমাণও অনেক। এ সব ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও অনেকে বলেন, যুদ্ধে আমেরিকা তার লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে। নয়-এগারোর মতো এত বড় সন্ত্রাসী হামলা আর আমেরিকার মাটিতে হয়নি। বিন লাদেন এবং তার শীর্ষ সামরিক কমান্ডোরা নিহত হয়েছেন। সাদ্দাম হোসেনকে (যদিও নয়-এগারোর সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের সম্পৃক্ততা স্পষ্ট নয়) ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা গেছে।

বিপরীতভাবে, কেউ বলতে পারেন, বিন লাদেনও সফল। যদিও তার জিহাদি আন্দোলন খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। কিন্তু এটা অনেকগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফের এসেছে। হাস্যকরভাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য নয়-এগারোর বর্ষপূর্তির সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। স্বল্পমেয়াদি প্রভাব হিসাবে বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের মূল্য অনেক। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বাইডেনের সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

আফগানিস্তান ছেড়ে আসার ঘটনায় চীনের উত্থান ঠেকাতে বাইডেনের যে ভারসাম্যমূলক কৌশল, সেটার প্রতিফলন ঘটেছে। এশিয়াতে ক্ষমতার নিজস্ব একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা অনেক আগে থেকেই রয়েছে। জাপান, ভারত, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো চীনের আধিপত্যকে মেনে নেয়নি। আমেরিকার উপস্থিতিকে তারা সাধুবাদ জানায়। ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকার যন্ত্রণাদায়ক বিদায়ের বিশ বছরের মধ্যে সেখানে আবার আমেরিকাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাইডেনের কৌশলও অর্থপূর্ণ।

একই সঙ্গে, নয়-এগারোর বিশ বছর পরে, সন্ত্রাসবাদের সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা আবার হামলা করতে উৎসাহিত হতে পারে। যদি তাই হয়, তবে মার্কিন নেতাদের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কৌশল নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে। সন্ত্রাসীদের পাতা ফাঁদে পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে যেন আমরা আবার না পড়ি-সেটাই এর কেন্দ্রে থাকতে হবে। দেশে ও বিদেশে মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা কীভাবে সামলানো যায় সেটার পরিকল্পনা নেতাদের করতে হবে।

কল্পনা করুন, নয়-এগারোর ঘটনায় যদি বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধটা এড়াতে পারতেন। অথবা যদি কূটনৈতিকভাবে কিংবা দক্ষ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সামরিক হামলা পরিচালনা করতে পারতেন। অথবা, কল্পনা করুন তিনি আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন, কিংবা ছয় মাসের মধ্যে সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। অথবা তালেবানদের ঘৃণা উপেক্ষা করে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন।

ভবিষ্যতে কোনো দিন আমেরিকা যদি আবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট তাতে কীভাবে সাড়া দেবেন? তিনি কি জনগণের প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাবেন। নাকি সন্ত্রাসীদের পাতা ফাঁদের ব্যাখ্যা জনগণের সামনে উপস্থাপন করে সহনশীল আচরণ করবেন। এই প্রশ্ন আমেরিকার জনগণকে করতে হবে। নেতাদের সেটার মীমাংসা করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; ● জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জন এফ কেনেডি স্কুলের ডিন ইমেরিটাস

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *