পাকিস্তানের জন্মের পর প্রথম এক দশক ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। এই সময়ের রাজনীতিতে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যার প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তান ভেঙে গিয়ে এক সময়ে যে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হবে দেশটির সূচনালগ্নেই তার ক্ষীণ কিছু আভাস পাওয়া গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কিছু প্রস্তুতিও হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে।
হিন্দু মুসলিম এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট। এই জন্ম ছিল মূলত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল। কিন্তু এর পরেই দেশটির রাজনীতিতে অভাবনীয় কিছু ঘটনা ঘটে যার একটি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মুসলিম লীগের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।
পাকিস্তানের জন্ম: লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু
পাকিস্তানের জন্মের বীজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবকে। এই প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতা এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এই প্রস্তাবটি পেশ করেন। পরে এই লাহোর প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মাত্র ছয় বছর পর ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভাজন আরো স্পষ্ট হয়। মুসলিম এলাকায় মুসলিম লীগের প্রার্থী এবং হিন্দু এলাকায় কংগ্রেসের প্রার্থীরা জয়ী হয়। মূলত মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতেই মুসলমানরা দলে দলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সেসময় মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল।
জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন
লর্ড মউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করেন যে ব্রিটিশ সরকার দেশ বিভাগের নীতি মেনে নিয়েছে,এবং ১৪ই অগাস্ট তারা শাসনভার ছেড়ে দিলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তানের। ভারতকে মাঝখানে রেখে পাকিস্তানের ছিল দুটো অংশ- পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। পরের এক দশক ধরে পূর্ব পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল পূর্ব বাংলা। কিন্তু জন্মের পর থেকে একই দেশের এই দুটো অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে লিখেছেন: “বাঙালি মুসলমান পরিচিত প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক রাষ্ট্রে বসবাস করবে না, এই লক্ষ্য নিয়ে অপরিচিত দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তান বানাল। তবে মোহভঙ্গ হতে দেরি হলো না।”
স্বপ্নভঙ্গ: এই পাকিস্তান আনলেন?
মুসলিম লীগের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ঠিকই কিন্তু খুব শীঘ্রই পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মুসলিম লীগের হাতছাড়া হয়ে গেল। সূচনা হলো নতুন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পাকিস্তান যে স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল যে সেই স্বপ্ন সুদূর পরাহত।” এর পরের কয়েক বছরে “মানুষ যে অবস্থার মধ্যে পড়লো সেই অবস্থা একাধিক কারণে অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল। প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা হয়েছিল, অর্থনীতিও ভেঙে পড়েছিল। আরেকটি হল রাষ্ট্রভাষার সমস্যা,” বলেন মি. চৌধুরী। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তখন থকেই অন্য এক পথ তৈরি হতে শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এরকম স্বপ্নভঙ্গের বহু ঘটনার উল্লেখ আছে। তার একটি এরকম: সেসময় মুসলিম লীগের নেতার নামে ‘জিন্নাহ ফান্ড’ নামে সরকার একটি ফান্ড খুলেছিল। তাতে যে যা পরে দান করার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও জোরপূর্বক টাকা তোলা শুরু হয়। শেখ মুজিব নৌকায় করে গোপালগঞ্জে যাওয়ার সময় মাঝির সাথে তার কথাবার্তা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ” নৌকা ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, ‘ভাইজান আপনি এখন এসেছেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। পাঁচজন লোক আমরা, হুকুম এসেছে পাঁচ টাকা দিতে হবে। দিনভর কোনদিন দুই টাকা, কোনোদিন আরও কম টাকা উপার্জন করি, বলেন তো পাঁচ টাকা কোথায় পাই? গতকাল আমার বাবার আমলের একটা পিতলা বদনা ছিল, তা চৌকিদার টাকার দায়ে কেড়ে নিয়ে গেছে।’ এই কথা বলে কেঁদে ফেলল। শেষে বলে, ‘পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম, এই পাকিস্তান আনলেন!”
ভাষা আন্দোলনের সূচনা
পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এর কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কার্যকলাপে হতাশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম তরুণরা ততদিনে সংগঠিত হওয়া শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। আহবায়ক কমিটির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়। গবেষকরা বলছেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মানুষ মুসলিম লীগের প্রতি আরো বেশি বিরূপ হয়ে পড়ে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “জিন্নাহ সাহেবের ঘোষণায় মধ্যবিত্ত, যে মধ্যবিত্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, তারা দেখলো যে এরকম হলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। যারা উর্দু জানে তারা তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। আগে তারা কোনরকমে ইংরেজি শিখেছিল। এখন তাদেরকে উর্দু শিখতে হবে। ফলে মধ্যবিত্ত খুব হতাশ হয়ে পড়লো। এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়ে গেল।” এই আন্দোলনের প্রথম ধাপটি ছিল সরকারি দল মুসলিম লীগের বিরোধী দল হিসেবে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব।
আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে তখনও পর্যন্ত ছিল দলটির এক চেটিয়া দাপট। এর মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আসাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চর ভাসানে দীর্ঘ সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন। এজন্য তিনি ভাসানী নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ভীতি ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “মওলানা ভাসানী যে পাকিস্তান চেয়েছিলেন সেটা না পেয়ে তিনি আন্দোলনে নেমে পড়লেন এবং তাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হল। তিনি সভাপতি হলেন।” নতুন দল গঠনের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে বসবাসরত পূর্ব বাংলার আরেক জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং কলকাতা ফেরত যুবক শেখ মুজিবুর রহমান। উনিশ’শ উনপঞ্চাশ সালের ২৩শে জুন গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগ নামটি দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী যার অর্থ জনগণের মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের অগ্রগণ্য অনেক নেতা নতুন দলে যোগ দেন। জেলে আটক থাকলেও শেখ মুজিব হলেন যুগ্ম সম্পাদক। রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “জেলে আটক অবস্থায় দলের একটি উঁচু পদে তার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে এটা অনুমান করা যায়, তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবে মনে করা হতো।”
আওয়ামী মুসলিম লীগ পরিচালনার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন শেখ মুজিব। সোহরাওয়ার্দী তাকে খুব স্নেহ করতেন- পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন, জামা কাপড় কিনে দিতেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলায় এলে শেখ মুজিব সব সময় তার সহযোগী হতেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম একটি তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। পাঁচ দশক পরে এই দলটির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে জন্ম হয় বাংলাদেশের।
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন ধরনের রাজনীতির সূচনা ঘটে, উন্মেষ হয় ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির। “নতুন দলটি দুটো বিষয়কে ধারণ করলো: একটা হচ্ছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিক্ষোভ, সেটা রাজনীতিকদের মধ্যে, আবার মধ্যবিত্তের মধ্যে বিক্ষোভ তৈরি হলো কারণ তারা দেখলো যে সরকার পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে এবং সেখানে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব নেই।” তিনি বলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ কতো দূর যাবে সেটা প্রথমে বোঝা যায়নি। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর দলটি অনেক দূর এগিয়ে গেল।
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় ও পরে শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক ছিলেন। যখন জেল থেকে বের হয়ে এলেন তখন মওলানা ভাসানীসহ তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জেলে বন্দী। এসময় তিনি সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে পূর্ব বাংলার জেলায় জেলায় ঘুরে সংগঠন গড়ে তুলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন: “এই সময় প্রায় প্রত্যেকটা মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠেছে। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল।” রাজনৈতিক ভাষ্যকার মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, “শেখ মুজিবের বয়স তখন ৩২ বছর। দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মেশা, কর্মী সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করা এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী সংগঠনকে মাঠ-পর্যায়ে বিস্তৃত করার গুরুদায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন দলের প্রাণ পুরুষ।”
ইত্তেফাকের প্রকাশনা: আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুখপত্র’
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইত্তেফাকের প্রকাশনা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এক পর্যায়ে পত্রিকাটি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়। আর কোন পত্রিকায় মুসলিম লীগের খবর প্রকাশিত না হলেও ঠাই পেত ইত্তেফাকের পাতায়। নবাবপুর রোড থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়, অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো, এবং এক পর্যায়ে এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৫১ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পাদনায় আবার সাপ্তাহিক হিসেবে ছাপা হতে শুরু করে। এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা হতো। দৈনিক হিসেবে ইত্তেফাকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে। তখন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি চালানোর খরচ দিতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “তিনি ইত্তেফাক চালাতেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ওকালতি করে যত টাকা পেতেন এর একটা বড় অংক ইত্তেফাকের পেছনে খরচ করতেন।” পত্রিকাটি পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল যার চেয়ারম্যান ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। পত্রিকাটি চলানোর ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের সংবাদ পত্রিকাটিতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো যা আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে সাহায্য করে।উনিশ’শ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন এবং আরো পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়েও ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল।
২১শে ফেব্রুয়ারি: মস্ত বড় পরিবর্তন
পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলেও তা উত্তাল হয়ে ওঠে ১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যাতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগেরই প্রাধান্য ছিল। আন্দোলন দমন করতে ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরদিন ২১ ও ২২শে ফেব্রুয়ারি আইন অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানের রাজনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তির ওপর তৈরি। তার প্রধান উপাদান ছিল ধর্ম। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রাজনীতির ক্ষেত্রে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করলো। অর্থাত্ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তার প্রধান উপাদান হল ধর্মনিরপেক্ষতা। ফলে বাঙালি মধ্যবিত্ত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করলো। এটা ছিল মস্ত বড় পরিবর্তন।” ভাষা আন্দোলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং এ কে ফজলুল হক এদের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। তখন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব তরুণ কর্মীদের সামনে চলে আসেন।
যুক্তফ্রন্ট গঠন: মুসলিম লীগ ঠেকাও
পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ১৯৫২ সালে। তার পর থেকেই নিশ্চিত হয়ে যায় যে অচিরেই পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখেই ১৯৫৩ সালে গড়ে ওঠে যুক্তফ্রন্ট। এই জোট গঠনে প্রধান ভূমিকা ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ কে ফজলুল হকের। যুক্তফ্রন্টের সভাপতি হন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দী। পাকিস্তানের জন্মের পর রাজনীতিতে ছিলেন না ফজলুল হক। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এটর্নি জেনারেল) হিসেবে চাকরি করতেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং কিছু দিনের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগেও যোগ দান করেছিলেন। কিন্তু দলাদলির কারণে থাকতে পারেন নি। এসময় তিনি তার পুরনো দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করে গঠন করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি। সোহরাওয়ার্দী করাচীতে বসবাস করলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এসে যুক্তফ্রন্টের সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। বাঙালিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন তিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা তাকে “ভারতের দালাল” বলে প্রচারণা চালিয়েছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “প্রধানত এটা ছিল নির্বাচনী জোট। মুসলিম লীগকে ঠেকানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু তার ভেতরে মানুষের হতাশা, ক্ষোভ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এসব কিছু যুক্ত হলো। এর মধ্যে ছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতাও।”
একচেটিয়া বিজয়: মুসলিম ভোটারে উল্টো স্রোত
নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। এই নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ২১ দফার যাতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পরিষ্কার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। এতে আরো ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন এই প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। “তিনি মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন। কৃষক সমিতি, মত্স্যজীবী সমিতি, তাতই সমিতি, অটো রিকশা সমিতি এসব গঠন করেন। সংগঠিত করেন শ্রমিকদের।” “শেখ মুজিবের সাংগঠনিক ক্ষমতারও বড় ভূমিকা ছিল। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ,” বলেন মি. চৌধুরী। এ সময় শেখ মুজিব এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত হন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন: “আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বললো, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমরা সামনে ধরে বললো, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল।” নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে। নৌকা প্রতীক নিয়ে নিরঙ্কুশ জয় পায় যুক্তফ্রন্ট। ২৩৭টি মুসলিম আসনের এই জোটের প্রার্থীরা ২২৮টি আসনে জয়ী হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। শেখ মুজিব লিখেছেন, “দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোনা যায় নাই। বাঙালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তার প্রমাণ দিল।” মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল গ্রামের মানুষের কাছে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মতো একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দল। এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী একটি অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে প্রচারে নামার ফলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পেছনে আরো একটি কারণ ছিল দুর্ভিক্ষ ও বন্যা। কিন্তু এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন তত্পরতা মানুষের চোখে পড়েনি যা পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যে ব্যাপারে মানুষের চোখ খুলে দিয়েছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একচেটিয়া জয়লাভ করেছিল। সব মুসলিম ভোট তখন পাকিস্তানের পক্ষে পড়েছে। ওই নির্বাচনে মানুষ যেমন স্রোতের মতো গিয়ে ভোট দিয়েছে তেমনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও মানুষ স্রোতের মতো ভোট দিল। কিন্তু এবারের স্রোত গেল উল্টো দিকে। কারণ পাকিস্তান তাদের কিছুই দেয়নি। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হয়ে যাবে এই ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করছিল।”
পূর্ব পাকিস্তানে নতুন সরকার: জন্মেই হোচট
নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। মুখ্যমন্ত্রী হন এ কে ফজলুল হক। এই সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সরকার ৩রা এপ্রিল থেকে ৩০শে মে এই অল্প কিছু দিন স্থায়ী হয়েছিল। রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ফজলুল হক করাচীতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সমস্ত ফ্লাইট ভারত হয়ে আসতো। ফেরার পথে তিনি কলকাতায় কয়েকদিন ছিলেন। সেখানে তিনি একটি জনসভায় ভাষণ দেন। বলেন পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গে আমাদের একই সংস্কৃতি একই ইতিহাস একই ঐতিহ্য। আমাদের আলাদা করে রাখা যাবে না। তখন তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আনা হয় এবং পূর্ব বঙ্গের মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়।” এর পর ফজলুল হক গৃহবন্দী হন। শেখ মুজিবকে আটক করে আবার পাঠানো হয় জেলে। ভেঙে যায় যুক্তফ্রন্ট।
যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এ কে ফজলুর হক। মওলানা ভাসানী এসময় এক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপে ছিলেন। তার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কয়েক মাস বিদেশে অবস্থানের পর কলকাতায় কিছু দিন থেকে তিনি ফিরে যান ঢাকায়। উনিশ’শ পঞ্চান্ন সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য এই প্রস্তাব দেন এবং কাউন্সিলররা তা সমর্থন করেন। মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলটি সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রিক হওয়ায় আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শেখ মুজিবের হাতে। উনিশ’শ ছাপ্পান্ন সালে পাকিস্তানে নতুন সংবিধান চালু হলে পূর্ব বাংলার আনুষ্ঠানিক নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান।
সে বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা
5 Comments
sbobet
I don’t know whether it’s just me or if everybody else experiencing issues with your blog.
It looks like some of the written text on your content are running off the
screen. Can someone else please provide feedback and let
me know if this is happening to them as well? This could be a problem with my browser because I’ve had this happen before.
Appreciate it
buy CBD
I have been exploring for a bit for any high-quality articles or blog posts on this sort of house .
Exploring in Yahoo I ultimately stumbled upon this site.
Reading this information So i am glad to
show that I’ve an incredibly good uncanny feeling I found out just what I needed.
I most unquestionably will make sure to don?t omit
this website and provides it a glance on a continuing basis.
senior-formation.com
Have you ever thought about adding a little bit more than just your articles?
I mean, what you say is fundamental and all. However just
imagine if you added some great pictures or videos to give your posts more,
“pop”! Your content is excellent but with images and video clips, this site
could certainly be one of the very best in its field. Amazing
blog!
https://allhunting.ca/author/walletbrown9/
Hi, I do believe this is an excellent website.
I stumbledupon it 😉 I may revisit once again since i have
saved as a favorite it. Money and freedom is the best way to change, may you
be rich and continue to help others.
Christopher
Hello, i think that i saw you visited my website thus i came
to “return the favor”.I’m trying to find things to improve
my website!I suppose its ok to use some of your ideas!!