লণ্ডন, ২১ জুন- আগামীকাল ২৩ জুন, রবিবার পলাশী দিবসে অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন ‘পলাশী থেকে ওয়েস্টমিনস্টার’ নামে এক সমাবেশের আয়োজন করেছে। রবিবার বেলা ২.০০ টা থেকে ৪.০০ টা পর্যন্ত এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
সমাবেশে সবাইকে দলে দলে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আয়োজকদের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলা ও বাঙালির দুর্দিন চলছে। সামনে মহাবিপদ। আশির দশকে বার্মায় জেনারেল ‘নে উইন’ যেভাবে আদমশুমারির নামে রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে বিদেশি ঘোষণা করে নিপীড়ন করে বাংলাদেশে পুশ ইন করেছিলো এবং সর্বশেষ বার্মার শাসকরা যেভাবে রোহিঙ্গাদের বড় একটা অংশকে বাঙালি বলে মেরেকেটে বাংলাদেশে পুশ ইন করেছে বা পালিয়ে আসতে বাধ্য করছে; ঠিক সেভাবে ভারতের দখলে থাকা বাঙালি অধ্যুষিত প্রদেশগুলো থেকে বাঙালিদের তাড়াতে নরেন্দ্র মোদি সরকার জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছে। মোদি সরকারও একই রকম কৌশল অবলম্বন করে নাগরিকপঞ্জির আড়ালে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করার চক্রান্ত করছে। ইতোমধ্যে আসামে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করে নতুন করে নাগরিকপঞ্জি তৈরী করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সেখানে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন বাঙালিকে নাগরিকত্বহীন করা হয়েছে। তাঁদের পাসপোর্ট, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, জমানো টাকা, বাড়ি-ঘর, জমির দলিল সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন নাগরিকত্বহীন মানুষ বর্তমানে ডিটেনশন ক্যাম্পে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বাংলার বিরাট ভূখণ্ডের ভূমিপুত্ররা নিজ ভূখণ্ডে একাধিকবার গণহত্যার শিকার হয়েছে, এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়েছে আর এখন এনআরসি’র জাঁতাকলে মরছে। আসাম থেকে ৪০ লাখ বাঙালিকে তারা বের করার পরিকল্পনা করছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় বজরং দল বাংলাদেশি মুক্ত ভারতের কথা উল্লেখ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও আন্দামানেও এই বিল আনার তোড়জোড় চলছে। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীন অংশটাকেও টুকরো করার অবিরাম ষড়যন্ত্র চলছে। দেশের পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা তারা করছে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বাহিনী তারাই তৈরী করেছে। কেএনএফকে তারাই অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কুকি-চিন, গারো ও চাকমাদের তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত উস্কে দিচ্ছে। তাদের স্পষ্ট লক্ষ্য এবং শিকার যে বাঙালি জনগোষ্ঠী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভারতে রীতিমতো ‘বাঙালি’ এবং ‘বাংলাদেশি’ শব্দ দুটো প্রায় ভয়ংকর অপমানজনক শব্দে পরিণত হয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা কর্ণাটকের বেলগাঁওয়ে এক নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন,‘বাংলাদেশ থেকে মানুষ আসামে আসেন। এটা আসামের সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য একটি হুমকি।’ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশিদের উইপোকার সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লোক আসামে গিয়ে অবৈধভাবে বাস করছে’।
কী আজব ব্যাপার! ভারতে কাজ নাই দেখে যেখানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ লাখ ভারতীয় অবৈধভাবে কাজ করছে, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে আসামে গিয়ে কাজ করবে? আর আসামে গিয়ে বাস বা কাজ করলেই বা কী? বাঙালিরা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র। সমগ্র বাংলা বলয়ের মাটি বাঙালি/বাংলাদেশিদের পূর্বপুরুষদের মাটি। বাঙালিদের রয়েছে এখানে থাকার নিঃশর্ত অধিকার। কেন্দ্রীয় বাংলা বলতে আজ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ বোঝালেও প্রান্তিক বাংলা—ত্রিপুরা, আসাম, আন্দামান, আরাকান, বিহার, থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তীতে বিহার ভেঙ্গে ঝাড়খন্ড প্রদেশ ও উড়িষ্যা ভেঙ্গে ছত্তিসগড় প্রদেশ এবং আসাম ভেঙ্গে মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড আর অরুণাচল প্রদেশ তৈরি করা হলেও এই পুরো অঞ্চলেই বাঙালি এবং তাদের কাছাকাছি নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করেন। এ আমাদের নবাবি বাংলা, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ’র বাংলা, সিরাজ-উদ-দৌলা’র বাংলা। এ আমাদের সুবা বাংলা, শাহ বাংলা, সেন বাংলা, পাল বাংলা, বাংলা সালতানাতের ভূমি। বাঙালির দেশ।
নৃ-বিজ্ঞান এবং জেনেটিক সায়েন্সের তথ্য-প্রমাণ মতে বাঙালি সনাতন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা আমরা একই জনগোষ্ঠীর লোক, একই রক্তের একই পূর্বপুরুষের বংশধর। অনিবার্যভাবেই এ অঞ্চল আমাদের ঠিকানা। বস্তুত বাঙালি এবং বাংলা বলয় চেতনে-অবচেতনে তাদের কাছে আতঙ্কজনক এক প্রতিপক্ষ। কাজেই ভারত জুড়ে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, শতধা ছিন্নভিন্ন এই বাঙালিকে হীন করতে, কোণঠাসা করতে তারা মরিয়া। তারা চায় বাংলা বলয়ের ভূমির দখল, তারা চায় বাংলা বলয়ের মেরুদণ্ড বাঙালিদের উৎখাত করতে, তারা চায় বাংলা বলয়ের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করতে। তারা চায় বাংলাদেশকে বৃত্তবন্দী করতে। ফলে জরুরি হয়ে উঠেছে বাঙালি খেদানো। যে বাঙালির বাংলা বা বাংলা বলয়, সেখান থেকে বাঙালি খেদানোর চিন্তা করাও এক ঘোরতর নৈতিক অপরাধ।
ভারত রাষ্ট্রটির জন্ম ১৯৪৭ সালে। কিন্তু এই ভূমি তো ১৯৪৭ সালে রচিত হয়নি! এই মানুষ, মানুষের পূর্বপুরুষ, ভূমিপুত্ররা তো ১৯৪৭ সালেই এ অঞ্চলের বাসিন্দা হয়নি! বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে আছে নিজভূমে, বাঙালিদেরই এলাকায়। একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে তার নিজভূমে পরবাসী বানানোর সিদ্ধান্ত ন্যায়ত কোনো আইন হতে পারে না। আসুন, আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করি। আমরা এর প্রতিবাদে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আরাকান, আন্দামান, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও ছত্তিসগড় নিয়ে একটি বৃহত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবি করি। আমরা আমাদের বাংলা বলয়ের সকল বাংলাভাষীর জন্য একটি অখন্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবি করি। এখনই না করলে বার্মার মত ভারতও যদি বাঙালিদের বিদেশি বলে বাংলাদেশে পুশ ইন করে তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে?
স্বাধীন বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৮ কোটি। কিছুদিন পর ৩০ কোটি হবে, ৪০ কোটি হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী ৫০ বছর পর বাংলাদেশের অর্ধেক জমি সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে। এরপর আবার ভারত যদি বাঙালিদের বাংলাদেশে পুশ ইন করে, তখন এই মানুষগুলো কোথায় থাকবে? কী খাবে? আসুন, আমরা সমস্বরে আওয়াজ তুলি। ঢাকা এ ব্যাপারে নীরব কেনো, শেখ হাসিনা সরকারকে প্রশ্ন করি। বাংলা ও বাঙালি জাতির একটি গৌরবময় অতীত ছিল। বাঙালি জাতির দূরদৃষ্টি, তীক্ষ্ণ মেধা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, অধ্যবসায়, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি দেখে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, ‘What Bengal Thinks Today India Thinks Tomorrow’। আসুন আমরা আমাদের সেই গৌরবময় অতীত ফিরিয়ে আনি।
আসুন, আমরা ‘অখন্ড বাংলা’র প্রথম স্বাধীন নবাব শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও শেষ নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা’র বাংলা ফিরিয়ে আনি। আমরা বাঙালিরা একই ভাষায় কথা বলি, আমাদের সংস্কৃতি এক। আমাদের সাহিত্যে, আমাদের ভালোবাসায়, ভালো লাগায় কোন ফারাক নেই। আমাদের আকাশটাও সেই আগের মতোই আছে। চেষ্টা করলে আবার কেন মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারব না? অখন্ড বাংলাদেশ বা ঐক্যবদ্ধ বাংলা হওয়া উচিত প্রত্যেক বাঙালির স্বপ্ন। বাঙালির নিশ্চিত প্রতিরক্ষার জন্যই এই বিপ্লবটা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। আসুন সমগ্র বাংলা অঞ্চলকে বাংলাদেশের সাথে অন্তর্ভূক্ত করে ‘অখন্ড বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে আন্দোলনে নামি। নিজে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও জনমত গড়ে তুলি।
আসুন, আগামীকাল ২৩ জুন, রবিবার বেলা ২.০০টা থেকে ৪.০০ টা পর্যন্ত ওয়েস্টমিনস্টার এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে আমরা সমস্বরে আওয়াজ তুলি। আসুন আমরা আবার দিল্লীর শাসকদের বিরুদ্ধে একসাথে লড়ি।