স্বর্ণালী তালুকদার: পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে বড় উত্সব হল দুর্গাপূজা। এই উত্সবে ধর্ম-জাতি-বর্ণ-রূপের কোনও ভেদাভেদ নেই। মায়ের দরবারে তাঁর সকল সন্তানদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এই উত্সবের প্রচলন কে কবে কোথায় কিভাবে করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বিস্তর। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মুলতঃ মহিষাসুরমর্দিনী বন্দনা। এই বিশেষ পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ, যা লেখা হয়েছিল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে।
এছাড়াও মার্কন্ডেয় পুরাণেও দুর্গাপূজার উল্লেখ রয়েছে, যা লেখা হয়েছিল চতুর্থ শতাব্দীতে, দুর্গাপূজার বিবরণ-সম্বলিত সপ্তশতী চন্ডী অংশটি এই পুরাণে যোগ করা হয়েছিল।নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের অন্তর্ভুক্ত বহু মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। একাদশ শতাব্দীতে এক বাঙালি শ্রী ভবদেব ভট্ট দেবী দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার বিধান দিয়েছিলেন।
চতুর্দশ শতাব্দীতে মিথিলার কবি বিদ্যাপতির লেখা ‘দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী’ ও বাঙালি পন্ডিত শ্রী শূলপাণির লেখা ‘দুর্গোত্সব-বিবেক’ বই দুইটি থেকে পশ্চিমবঙ্গে দূর্গাপুজোর কথা জানা যায়। ইতিহাস অনুযায়ী বঙ্গে চতুর্দশ শতাব্দীতে দুর্গাপূজা উত্সবের রূপ ধারণ করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হিসেবে চিহ্নিত। মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরীমূল্ল রাজবংশের কুলদেবী ছিলেন দেবী মৃন্ময়ী। ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজ জগত্মল্ল এই পূজা শুরু করেন। এই পূজার পদ্ধতি, দেবতাদের মূর্তির গড়ন, সনাতনী দুর্গাপূজার থেকে যথেষ্ট আলাদা ছিল।
এখানে মৃন্ময়ী দেবী সপরিবারে থাকতেন বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতীর স্থান নিয়ে একটু অদল বদল ছিল। এই পূজাতে লক্ষ্মীর জায়গায় গণেশ ও গণেশের জায়গায় লক্ষ্মী এবং কার্তিকের জায়গায় সরস্বতী ও সরস্বতীর জায়গায় কার্তিক অবস্থান করতেন। জগত্মল্ল-প্রথা রূপে প্রসিদ্ধ ছিল এই বিশেষ মূর্তি স্থাপনার নিয়ম।
বাঁকুড়া জেলার বহু বনেদী পরিবারে আজও জগত্মল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তির বন্দনা করা হয়। শোনা যায়, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে নিজের বাড়িতে দুর্গা প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং দুর্গোত্সবের প্রচলন শুরু করেছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় প্রাচীন দুর্গাপূজা হিসেবে রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সময়টা ছিল সপ্তদশ শতাব্দী, সেই সময়ে চলছে মুঘল শাসনকাল। বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ন তত্কালীন আমলে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করে শুরু করেছিলেন দুর্গাপূজা।
বাংলায় সপ্তদশ শতাব্দীতে বহু জমিদার এবং রাজারা দুর্গাপূজার আয়োজন করেন, যাদের মধ্যে নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, বড়শিয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী, কোচবিহার রাজবাড়ির পূজা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। রাজবাড়ির পূজাতেই গ্রামের মানুষ অংশগ্রহণ করতেন। আলাদা করে পাড়ায় পাড়ায় পূজার চল বা সামর্থ্য কোনটাই ছিল না।
এরপর রাজবাড়ির জাঁকজমক ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে বিট্রিশ আমলে। এছাড়াও সবার জন্য পূজা করার চিন্তাও এসেছিল মানুষের মনে। তাই দুর্গাপূজার ইতিহাসে যোগ হল বারোয়ারী বা সার্বজনীন দুর্গাপূজা। বারোয়ারী কথাটি এসেছে বারো জন ইয়ার অর্থাত্ বন্ধুদের ইচ্ছায়। তাই সার্বজনীন পূজাকে অনেক সময় বারোয়ারী পূজাও বলা হয়।
১৭৯০ সালে গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন মিলে, অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে বারোয়ারী পূজার প্রচলন করেন, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা মহানগরীর বুকেও। ইতিহাসে কলকাতার পূজা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। ইতিহাসবিদদের মতে কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথের হাত ধরেই প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। এরপরে ব্রিটিশ রাজত্বকালে কলকাতায় বেশিরভাগ বাড়িতেই দুর্গাপূজা করা হত।
কয়েক দশক ধরে চলে আসা দুর্গাপূজার উত্সবে মেতে ওঠেন বাঙালি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই এখন দুর্গা মায়ের আরাধনা চলে ভক্তি ভরে। দুরত্ব বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। আজও পূজার চারটে দিনে নতুন জামা কাপড় কেনার জন্য দোকানে দোকানে ভিড় পরে, যতই অনলাইনে কেনাকাটি হোক না কেন। সাবেকি প্রতিমার বদলে থিমের পূজার চল হয়েছে অনেক। রাস্তায় রাত বাড়লেই ভিড় বাড়ে মানুষের। কিন্তু আজও কাশ ফুলের দোলায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে সকলের। শত ব্যস্ততার মাঝেও পূজার চারটে দিন সবাই ম্যানেজ করে নেয়।