।। আলতাফ পারভেজে ।।
১৯৪৭ সালের আগে মতুয়াদের বড় অংশ ‘নমশূদ্র’ নামে পরিচিত ছিল। তারও আগে তাদের পরিচয় ছিল শুধুই ‘নমো’। রাজনৈতিকভাবে মতুয়াদের বিভক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক ঘরানার রাজনীতি থেকে তাদের একাংশের ফারাক তৈরি হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোটব্যাংকের পরিণতি খানিকটা আগাম বুঝিয়ে দেবে, বিধানসভা নির্বাচনে কারা সরকার গড়তে যাচ্ছে।
ভারতে ভোট শেষ হতে আরও কিছুদিন বাকি। পশ্চিমবঙ্গের বেলায়ও একই হিসাব। তবে কে কাকে ভোট দিচ্ছেন, কোন গোষ্ঠী কোন দিকে হেলে পড়ছে, তার মেঠো ময়নাতদন্ত চলছে এখন। এর মধ্যে বিশেষ মনোযোগে আছে পশ্চিমবঙ্গের ‘মতুয়ারা’। ভোটের রাজনীতির কবলে পড়ে ধর্মীয় এই ঘরানার কেন্দ্রে সৃষ্ট কোন্দল ও ভাঙন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। এর মধ্যে এ প্রশ্নও উঠেছে যে ভোট ও রাজনীতির দোলাচলে মতুয়াদের জাতপাতবিরোধী মূল আদর্শে কোনো টান পড়ল কি না?
‘মতুয়াদের’ আদি কথা
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়াদের নিয়ে প্রায়ই আলোচনা ওঠে। দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিগত ভোটের সময় বৃহত্তর ফরিদপুরে এসে ওই আলোচনাকে আন্তর্জাতিক চেহারা দিয়েছিলেন। ঢাকায় তখন সহিংস বিক্ষোভও হয়, যার জেরে কয়েকটি সংঘর্ষে বেশ কিছু নিহতের ঘটনাও ঘটে। পাশাপাশি বিশ্ব জেনেছিল যে মতুয়া দর্শনের অনেক মানুষ আছেন বাংলাদেশেও।
কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি এই সম্প্রদায়ের আদি ভূমি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বড় রাজনীতিবিদদের যে কারও আগে মোদি-বিজেপি-আরএসএসের কাছে ওড়াকান্দি যে বাড়তি মনোযোগ ও সম্মান পেল, সেই কৃতিত্ব গেরুয়া শিবিরের গবেষকদের দিতেই হয়।
২০২১ সালের মার্চে কাশিয়ানীতে বিজেপি নেতার সফর মতুয়াকেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতির গণিতকে এতটাই প্রচার দিয়েছে যে নতুন প্রজন্মের কাছে এখন মতুয়াবাদের পেছনের ইতিহাস বেশ আড়ালেই পড়ে গেছে।
আজ যাঁরা ‘মতুয়া’, ১৯৪৭ সালের আগে তাঁদের বড় অংশ ‘নমশূদ্র’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তারও আগে তাঁদের পরিচয় ছিল শুধুই ‘নমো’।
নমোদের মতুয়া চেতনায় জড়ো হওয়ার শুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে, যদিও সব নমো মতুয়া হয়ে যাননি আজও। ‘হরি’ নামে ‘মত্তরাই’ কেবল মতুয়া অভিধা পেলেন। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের এখনকার প্রায় ৫০ ভাগ হবেন এ রকম মানুষ। তাঁদেরই আদি গুরু হরিচাঁদ চেয়েছিলেন, ‘হরি’ নামকে কণ্ঠে নিয়ে বাংলায় বল্লাল সেনদের তৈরি করে যাওয়া ‘৩৬ জাতকে’ জোড়া লাগাতে। সেই সূত্রেই জন্ম ‘হরিবোলা’ সম্প্রদায়ের।
হরিচাঁদ ঠাকুরের ছেলে গুরুচাঁদ এবং গুরুচাঁদের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর (পি আর ঠাকুর নামে অধিক পরিচিত) এই আন্দোলনে শিক্ষা ও রাজনীতির যোগ ঘটান। ইতিমধ্যে ‘হরিবোলারা’ ‘মত্ত’ বা ‘মাতোয়ারা’থেকে মতুয়া হয়েছেন এবং তাঁদের ধর্মপুস্তকে আদি পরিচয়ে ‘মৈথিলী ব্রাহ্মণ’ কথাটাও যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় হরিবোলাদের ৩৬ জাতকে এক করার অঙ্গীকার কমে গিয়ে ‘মতুয়া’ হিসেবে নিজেই একটা জাত হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা দেখা দেয়।
ইতিমধ্যে ১৯৪৭ ও বিশেষভাবে ১৯৫০-এর দাঙ্গা এই সমাজকে লন্ডভন্ড করেছে। ওড়াকান্দি ছাড়িয়ে বনগাঁর ‘ঠাকুরনগর’ মতুয়াদের দ্বিতীয় পবিত্র ভূমি হয়ে উঠেছে।
পি আর ঠাকুরের মৃত্যুর পর ১৯৯০ সাল থেকে ঠাকুরনগরে বসেই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তাঁর স্ত্রী বীণাপানি দেবী তথা ‘বড় মা’। ২০১৯ সালে বীণাপানি দেবীর মৃত্যুর পর মতুয়া আন্দোলন তার ভরকেন্দ্রে আর কোনো একক নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারেনি। বহুমুখী সাংগঠনিক প্রবণতা তৈরি হলো এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক পছন্দ–অপছন্দে। বিশেষ করে এককালের জাতপাতবিরোধী এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির প্রভাব বাড়ল।
এটা আবার সহজে নিতে পারল না সম্প্রদায়ের কেউ কেউ। যদিও এবার কিছু ভোট মমতার ঘাসফুল মার্কায় থাকছে, কিন্তু মতুয়া ভোটের বড় হিস্যা আশা করছে বিজেপি। কয়েকটি আসনে মতুয়াদের নিজেদের প্রার্থীও আছেন। ভোটের অঙ্কও তাই বহুমুখী। যে অঙ্কের আড়ালে পড়ে গেছে হরিচাঁদের সমাজচেতনা। সে বিষয়ে কথা বেশ কম।
ক্ষমতার রাজনীতিতে ‘ঠাকুরবাড়ি’
বাংলাদেশের মতুয়ারা গত পঞ্চাশ বছরে কমবেশি পুরোনো এক রাজনৈতিক পছন্দই আঁকড়ে আছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে থাকা একই জনগোষ্ঠীর অপর অংশের অবস্থান সে রকম নয়। দেশভাগের আগে-পরে স্বল্প সময়ের জন্য তাঁদের প্রথম পছন্দ ছিল কংগ্রেস। ১৯৬২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পি আর ঠাকুর কংগ্রেসের মনোনয়নে প্রথম বিধানসভার সদস্য হন নদীয়ার হাঁসখালী থেকে। স্বল্পকাল পরই তিনি কংগ্রেস ছাড়েন।
তারপর পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় বামফ্রন্টের কাল। মতুয়া জগতেও লাল পতাকার প্রভাব দেখা যায়। এটা অস্বাভাবিক ছিল না। নমো কৃষক সমাজে বামপন্থীদের প্রভাব দেশভাগের বহু আগে থেকে এবং বরিশাল-ফরিদপুরের পুরোনো দিনের কৃষক আন্দোলন তার সাক্ষী। তারও আগে গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে দক্ষিণবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে নমোরা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থক ছিলেন।
ঐতিহাসিক সেই সিলসিলা হিসেবে হয়তো ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুদের উত্থানে তখনকার উদ্বাস্তু এসব মানুষের বড় ধরনের শুভকামনা ছিল। ছিল প্রত্যাশাও। বামরা মতুয়াদের পুনর্বাসনের কথাও বলত। কিন্তু ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবন-লাগোয়া মরিচঝাঁপিতে বাংলাভাষী উদ্বাস্তুদের ওপর বাম প্রশাসনের দমন-পীড়ন বামফ্রন্ট-মতুয়া মৈত্রীতে মনস্তাত্ত্বিক ফাটল তৈরি করে।
এরপর ২০১১ সাল থেকে এই সম্প্রদায় হেলে পড়তে থাকে তৃণমূলের দিকে। হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সম্প্রদায়কে তুষ্ট রাখতে অনেক কিছু করেন। পি আর ঠাকুর ও বীণাপানি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে গাইঘাটা থেকে বিধানসভার সদস্য করলেন, রাজ্যের মন্ত্রী বানালেন। ২০১৪ সালে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বড় ভাই কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর তৃণমূলের মার্কা নিয়ে বনগাঁ থেকে লোকসভার সদস্য হলেন। এভাবে তৃণমূলে ভরে গেল ঠাকুরবাড়ি। কিন্তু এই সবই ছিল ক্ষমতার রাজনীতি ও বামফ্রন্টকে নিয়ে অভিমানের ফল।
তৃণমূল মতুয়াদের কোনো অগ্রসর রাজনীতি দিতে পারেনি। তারই ফল হিসেবে ভরদুপুরে বজ্রপাতের মতো ২০১৯ সালে এসে দেখা গেল, মতুয়া গ্রামগুলোয় গেরুয়া সুনামি শুরু হয়েছে। ২০১৫ থেকেই ধীরলয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু। শেষমেশ ২০১৯-এ বনগাঁ থেকে বিজেপির মার্কা নিয়ে লোকসভায় সদস্য হলেন পি আর ঠাকুরের নাতি ও মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের ছেলে শান্তনু ঠাকুর। রানাঘাট, ব্যারাকপুর—এসব আসনও গেল পদ্মফুলের পক্ষে।
বলা বাহুল্য, ভোটের রাজনীতি শান্তনু ঠাকুর পর্যন্ত আসতে আসতে মতুয়াদের ‘ঠাকুরবাড়ি’র ঐক্য ছত্রখান হয়ে গেছে। পি আর ঠাকুরের বড় ছেলের বউ লড়ছেন দেবরের ছেলের সঙ্গে—দৃশ্যটা রাজনীতিতে মানানসই হলেও পারিবারিক সংস্কৃতিতে অস্বস্তিকর। এ রকম ভেদাভেদে নতুন উপাদান যুক্ত করেছে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বা ‘সিএএ-১৯’।
বিজেপি যখন নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিল
মতুয়া সমাজ প্রথম দফায় বিপদে পড়ে দেশভাগ-পরবর্তী বছরগুলোয়। তখন কেবল দুটি পরিচয় ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমানের’ ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গেল। মতুয়ারাও তখন রাজনীতিতে স্রেফ ‘হিন্দু’। কিন্তু সেই পরিচয়ও থাকল না ঠিকমতো। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন বহু দশকের জন্য, তাঁদের পরিচয় হলো ‘উদ্বাস্তু’।
এসব উদ্বাস্তু মানুষের আবারও ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠার আকুতি কংগ্রেস-বামফ্রন্ট-তৃণমূলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে পেরেছিল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক মোজাইক চৌচির করার একটা রাস্তাও তাদের জন্য তৈরি হলো এভাবে। ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করল তারা। খুবই সাম্প্রদায়িক ধারায় ছিল এই সংশোধন। অমুসলিম উদ্বাস্তু হলে সুবিধা মিলবে, মুসলমান হলে নয়।
কংগ্রেস, বামপন্থীরাসহ বহু দল নীতিগত কারণে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াল। বহু মানুষ মরল ভারতজুড়ে। কিন্তু ‘উদ্বাস্তু হিন্দু’রা নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনায় একে খারিজ করলেন না। উদ্বাস্তুদের ‘অবৈধ নাগরিক’ বলা হবে না—বিজেপির এ ঘোষণা তাঁদের কাছে অনেক স্বস্তিকর হলো। কারণ, ইতিমধ্যে আসামে আরআরসি বা নাগরিকপঞ্জি হয়েছে। এতে প্রচুর বাংলাভাষী হিন্দু নাগরিকত্ব পানি। পশ্চিমবঙ্গেও ‘অবৈধ নাগরিক’ হওয়ার শঙ্কা একটা ভীতিকর বিষয় হয়ে উঠেছিল।
হরিচাঁদের বিভেদবাদ–বিরোধিতা এ সময় আপাতত স্থগিত থাকল মতুয়া সমাজে। বলা বাহুল্য, বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের পুরোনো একটা ভোটব্যাংক এভাবেই ভাঙল। একই উদ্যোগে বিজেপি আরও অনেকভাবে সফল হয়। ‘সিএএ’ বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানের দূরত্বও বেশ বাড়াল। বামদের জন্য পরিস্থিতি বেশ কঠিনই হয়ে গেল। শ্রেণি রাজনীতি দিয়ে মানুষকে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে আর আটকে রাখা গেল না।
সবচেয়ে বেশি যা হলো, রাজনৈতিকভাবে মতুয়াদের বিভক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক ঘরানার রাজনীতি থেকে তাদের একাংশের ফারাক তৈরি হওয়া। কিন্তু এখনো কেউই নিশ্চিত জানেন না যে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক কোটি মতুয়া ভোট এবার কতটুকু কোন দিকে যাবে! সবটাই বিজেপির দিকে যাবে কি না?
মতুয়া ভোটব্যাংকের চেহারা
লোকসভার ৪২টি আসন পশ্চিমবঙ্গে। তার অন্তত ছয়টিতে মতুয়াদের বড়সড় প্রভাব আছে বলে দাবি করা হয়। ছয়টির মধ্যে বনগাঁ, রানাঘাট, ব্যারাকপুর ও বারাসাতে তাদের প্রভাব মোটা দাগে। লোকসভার হিসাবের সঙ্গে তুলনা করলে বিধানসভায় মতুয়াদের প্রভাবের পরিসর দাঁড়ায় ৪০টির মতো আসন। বলা যায়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে নদীয়া পর্যন্ত পুরো এলাকায় মতুয়া ভোটের একটা প্রভাব তৈরি হয়ে আছে ইতিমধ্যে। অনেকটা যেন বাংলাদেশের কোটালীপাড়া, রাজৈর, মুকসুদপুর, নাজিরপুর, চিতলমারীর মতো এলাকাগুলো।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোটব্যাংকের পরিণতি খানিকটা আগাম বুঝিয়ে দেবে, পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে কারা সরকার গড়তে যাচ্ছে। এই বিবেচনায় মতুয়া ভোটের হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের জন্যও বিশেষভাবে মনোযোগ পাচ্ছে। কারণ, বিজেপি এখন মতুয়া ‘উদ্বাস্তু’দের ‘সিএএ’ অনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করতে বলছে।
অন্যদিকে তৃণমূল বলছে, যাঁরা এতে আবেদন করবেন, তাঁরা ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। অর্থাৎ তাঁরা ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে চালু সামাজিক বিভিন্ন ভাতা থেকে বঞ্চিত হবেন। ভোট এলেই কোনো না কোনো দল এভাবে বাংলাদেশকে হাজির করে পশ্চিমবঙ্গের মাঠে।
তবে আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও রাজ্যভিত্তিক এসব বিবেচনার বাইরে মতুয়া ভোটের রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভিন্ন এক সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিয়েও হাজির আছে। এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিভেদের বিরুদ্ধে দুটি বড় দার্শনিক ধারা হলো—আম্বেদকরপন্থা ও মতুয়াবাদ। শেষোক্তটি ছিন্নভিন্ন হলে আরএসএসের সামনে বাকি থাকলেন কেবল আম্বেদকর।
রাজনৈতিক আদর্শ কি পাল্টাল
মতুয়া আন্দোলনের জন্মপ্রেরণা ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ মোকাবিলা’ হলেও ১৯৫০ সাল থেকে এই ঘরানার মনোযোগের বড় একাংশ হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রচেষ্টা। যার বড় প্রকাশ হিসেবে ২০১০ সালে কলকাতায় বড় এক সমাবেশ করে মতুয়া মহাসংঘ। এই সমাবেশই মতুয়া আন্দোলনকে মতুয়া ভোটব্যাংক আদল দেয়। নজরকাড়া এই সমাবেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে জাতপাতের রাজনীতির মধ্যে নতুন এক বর্গ হয়ে ওঠে তারা। একই দাবিতে ‘নিখিল ভারত বাঙালি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতি’সহ আরও কিছু সংগঠনও কাজে নামে।
কিন্তু এ রকম উদ্যোগগুলো কখনো স্বতন্ত্র কোনো ‘দল’ আকারে নিজেদের প্রকাশ ঘটাতে পারেনি। চায়ওনি হয়তো। বরং ২০১০ সালের সমাবেশশক্তিকে উদ্বাস্তু পরিচয় ঘোচাতে উঁচু জাতের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দর-কষাকষির কাজে লাগানো হয়। পশ্চিমবঙ্গে দলিত তাত্ত্বিকেরাও এ অবস্থায় সাহসী ও স্বতন্ত্র কোনো রাজনৈতিক পথ দেখাতে পারেননি। তা ছাড়া বাস্তব ওই কৌশলের সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির ছোঁয়াও যুক্ত হয়।
পরিবর্তনবাদী রাজনীতিতে কষ্টকর তৃতীয়-চতুর্থ স্রোত হওয়ার চেয়ে দর-কষাকষির পথেই সহজে এমপি-এমএলএ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেল। সংগত কারণে মতুয়া অনেক সংগঠককে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ–বিরোধিতা’র অতীত তীব্রতা কমাতে হলো। আরএসএসের জন্য এ-ও উদ্যাপনের মতো বড় এক উপলক্ষ বটে। তারা হয়তো একে ‘ঘর ওয়াপসি’ বলবে। কিন্তু ‘উদ্বাস্তু’ পরিচয় থেকে মুক্ত হয়ে ‘নাগরিক’ হওয়া মতুয়ারা আদি নিশান যে আবারও ওঠাতে চাইবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিশেষ করে যখন খোদ হরিচাঁদ তাঁর ‘দ্বাদশ আজ্ঞা’র ষষ্ঠটিতে বলে গেছেন, ‘জাতিভেদ করবে না।’
●আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক