পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোট গণনায় দেখা যাচ্ছে আবারো বড় সংখ্যক আসনে তৃণমূল কংগ্রেস জয় পেয়েছে। তবে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ভোট গণনার মধ্যেই ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গড় এলাকায় কমপক্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হওয়া ভোট গণনা বুধবার (১২ জুলাই) বেলা ১১টা পর্যন্তও শেষ হয়নি। নির্বাচন কমিশনের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৬৩ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এখনো পর্যন্ত ৪২ হাজারেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে।
অন্যদিকে, বিজেপি জিতেছে ৯৩০০-র কিছু বেশি আসন, আর ২৯৩৫টি আসনে সিপিআইএম জয়ী হয়েছে। এছাড়া কংগ্রেস পেয়েছে আড়াই হাজারের বেশি আসন।
গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট গণনা চলার মধ্যেই শুরু হয় পঞ্চায়েত সমিতির ভোট গণনা। সেখানে মোট ৯৭৩০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৫৪৩২টি। আর বিজেপি পেয়েছে ৬০১টি আসন এবং সিপিআইএম ও কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৩০৫টি আসন।
তিন স্তরের পঞ্চায়েতের সর্বোচ্চ স্তর জেলা পরিষদের ৯২৮টি আসনের ভোটগণনা সব থেকে পরে শুরু হয়েছে। বুধবার বেলা ১১টা পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস ৫৬৩টি আসনে জিতেছে বা এগিয়ে আছে । বিজেপি জিতেছে ২৪টি আসনে আর সিপিআইএম-কংগ্রেস জোট জিতেছে ১৩টি আসনে।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য ভোট ইভিএমে নেয়া হলেও পঞ্চায়েত ভোট নেয়া হয় সাবেকি ব্যালট পেপারে। তাই সে ভোট গুনতেও অনেক সময় লেগে যায়।
ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূলের জয়
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্য স্তর থেকে শুরু করে গ্রাম স্তর পর্যন্ত ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
গ্রামের মানুষকে প্রতিটি পরিষেবা বা যোজনায় বরাদ্দ অর্থ পেতে গেল একটি নির্দিষ্ট হারে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যদের ‘কাট-মানি’ দিতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল।
বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, বিপুল অঙ্কের রোজগারের সম্ভাবনা থাকে বলেই নির্বাচনের আগে পঞ্চায়েত ভোটে জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেস।
কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে গ্রামস্তরে ওই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগের বিশেষ প্রভাব পড়েনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস এত বিপুল আসনে জিতেছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তা ভোটে প্রভাব ফেলেনি। এর একটা কারণ সম্ভবত, সাধারণ মানুষ বোধহয় বিভিন্ন স্কিমে অর্থ বা পরিষেবা পেয়ে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে। যদিও সেটা পাওয়ার জন্য তাদের ঘুষ দিতে হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাক্ষর ব্যবস্থাটা তারা পুরোপুরি বদলিয়ে ফেলতে চায়নি।’
তবে মৈত্র মনে করেন, এটা যদি সরকার পরিবর্তনের ভোট হতো অর্থাৎ বিধানসভা ভোট হতো তাহলে হয়তো দুর্নীতির ইস্যু ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলত।
‘কিন্তু যে ব্যবস্থাপনাটা চলছে, তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েতে না থাকলে ওই স্কিমগুলি থেকে অর্থ পেতেন না সাধারণ মানুষ। সেটাই বোধহয় মানুষ চান নি,’ বলছিলেন তিনি।
আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্যের কথায়, ‘গরীব মানুষ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত অংশের মানুষের একটা বড় অংশ এখন নির্ভরশীল সরকারি অনুদানের ওপরে। তাই তারা এখন নাগরিকের থেকেও বেশি দানগ্রহীতা হয়ে উঠেছেন।’
‘তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ওপরে তাই বহু সংসার নির্ভরশীল। তারা হয়তো ভেবেছেন যে তৃণমূল কংগ্রেস যদি না থাকে তাদের অনুদানও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই তারা তাদেরকেই ক্ষমতায় রেখে দিতে চাইলেন,’ বলেন ভট্টাচার্য।
বিক্ষিপ্ত সহিংসতা
পশ্চিমবঙ্গের বারুইপুর পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার (১১ জুলাই) রাত ১১টার নাগাদ ভাঙ্গড়ে ব্যাপক বোমা গুলি চলতে থাকে। তাতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
ফুরফুরা শরিফের পীরজাদাদের রাজনৈতিক দল ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফের এক প্রার্থী অভিযোগ করেন, তিনি ভোট গণনার শেষ মুহুর্তে জিতছিলেন কিন্তু তাকে পরাজিত বলে ঘোষণা করায় উত্তেজনা ছড়ায়।
পুলিশের অভিযোগ, ‘একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকেরা’ তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে।
এরপর এলাকায় একের পর এক বিস্ফোরণ হয়। বোমা এবং গুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো হয়।
কিন্তু অবস্থা বদলায়নি। আইএসএফের পাল্টা অভিযোগ, পুলিশ গুলি চালিয়েছে। তাদের একজন কর্মী এবং একজন স্থানীয় অরাজনৈতিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে সংগঠনটি।
অন্যদিকে, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের হাতেও গুলি লেগেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন ভোর ৩টা পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপক গুলি-বোমা চলেছে। এর আগে শনিবার (৮ জুলাই) মূল ভোট গ্রহণের দিনে এবং পরে সোমবার (১০ জুলাই) ৬৯৬টি বুথে পুনঃনির্বাচনের দিন সহিংসতায় পশ্চিমবঙ্গে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
শনিবার ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ছাপ্পা ভোট দেয়া, বুথ দখল এমনকি ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা সামনে এসেছিল।
হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রতিটা বুথে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি বলে অভিযোগ এসেছিল। তবে ভোট গণনার দিন সব গণনা কেন্দ্রেই পর্যাপ্ত সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন ছিল।
তবে গণনার প্রথম দিন মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনো বড় সহিংসতার খবর আসেনি।
হেরে গিয়ে ব্যালট খেয়ে ফেললেন প্রার্থী
পঞ্চায়েত ভোটে নানা উত্তেজনার মধ্যে কিছু হাস্যকর কাহিনীর কথাও জানা যাচ্ছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে।
সকালে কোচবিহার জেলার ফলিমারিতে তৃণমূল কংগ্রেসের একজন নারী প্রার্থী গণনার জন্য রাখা ব্যালট পেপারে কালি ছিটিয়ে দেন। রিঙ্কু রায় নামে ওই প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জেলা পুলিশ জানিয়েছে।
মিজ রায় অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন তিনি ইচ্ছা করে ব্যালটে কালি ছেটাননি। তিনি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বারবার ভোটের তথ্য জানতে চাইছিলেন। তা নিয়ে বিতণ্ডার মধ্যেই কালির বোতল উল্টিয়ে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, হারতে চলেছেন বুঝতে পেরে তৃণমূল কংগ্রেসের একজন প্রার্থী ব্যালট পেপার চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছেন বলে জানা যাচ্ছে। ঘটনা উত্তর-২৪ পরগনা জেলার। ওই আসনে সিপিআইএম প্রার্থী চার ভোটে জিতে গিয়েছিলেন। নিশ্চিত হার জেনে তৃণমূল প্রার্থী মহাদেব মাটি কিছু ব্যালট মুখে পুড়ে দেন আর বাকি ব্যালট ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন। সূত্র : বিবিসি