সীমান্তবাসী নাগরিকদের অধিকার নিয়ে বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর উদ্যোগে সোমবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হল একটি সাংবাদিক বৈঠক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বাংলা, অসম ও পাঞ্জাবে বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশিকা জারি নিয়ে এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে সরব হন সুশাল সমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
১২টি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের পাশাপাশি এদিন প্রেস ক্লাবে উপস্থিত ছিলেন, অপর্ণা সেন, সোহাগ সেনের মতো বিশিষ্টজনেরাও। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম)এল-এর কার্তিক পাল, আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য ও সুজাত ভদ্র, কিরীটি রায়ের মতো মানবাধিকার এবং সমাজকর্মীরাও।
গত মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নয়া নির্দেশিকা অনুসারে বাংলা, অসম ও পাঞ্জাবে বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এতদিন সীমান্ত বাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত গ্রেফতার, বাজেয়াপ্ত এবং তল্লাশি করতে পারত। নয়া নির্দেশিকা অনুযায়ী, এবার বিএসএফ সীমান্ত থেকে ৫০ কিমি ভিতরে ঢুকে এই কাজ করতে পারবে।
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোমবারের সাংবাদিক সম্মেলনে ক্ষোভ উগরে দেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেন। এর আগেও তিনি সিএএ, ৩৭০ ধারা বিলোপের মতো বিজেপি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের ক্ষোভ জানিয়েছেন। আজও তিনি সেই একই পথে হেঁটে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বিরুদ্ধে সোচ্চার অপর্ণা বলেন, ‘মিলিটারিদের যতটা ক্ষমতা দেওয়ার কথা, তার থেকেও বেশি দেওয়া হচ্ছে।’ দিনহাটা সংলগ্ন ছিটমহলের বাসিন্দাদের কথা ভাবলেই তিনি শিউরে ওঠেন বলে জানান তিনি। অপর্ণা সেন বলেন, ‘এমনিতেই খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাটাতে হচ্ছে ছিটমহলের বাসিন্দাদের। আমরা অনেকদিন ধরেই সীমান্তবাসীদের নিয়ে কাজ করছি। সেখানে গিয়ে দেখেছি কী কষ্টে দিন কাটে তাঁদের। দিনহাটার করোলা-২-এ ১১টি পরিবার বাস করে। মোট লোক সংখ্যা ৫০ জন। তাঁদের বাইরে বিয়ে হয় না। নিজেদের মধ্যেই সম্পন্ন হয় বিয়ে। এর ফলে কী ভয়ংকর জেনেটিক সমস্যা দেখা দিতে পারে ভাবতে পারছেন? এই অবস্থায় বিএসএফের ক্ষমতা বাড়লে তা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।’ সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, সেখানকার বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায় না। কারণ স্কুল ছুটি হয়ে যায় দুপুর দু’টোয়। এরপর সীমান্ত খোলার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় বিকেল চারটে অবধি। অতক্ষণ খালি পেটে বসে থাকতে পারে না শিশুগুলি।’
পরমা, ৩৬ চৌরঙ্গি লেনের এই পরিচালক রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেন, সীমান্তে বাস করা মানুষগুলোর কথা যেন একটু ভাবা হয়। তাঁরা যেন নিজেদের মতো করে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ করতে পারেন। এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা কিরীটি রায় বলেন, ‘কেন্দ্র কোনওরকম আলোচনা ও মতামত ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আমরা অনেকদিন ধরেই সীমান্ত অঞ্চলের নাগরিকদের নিয়ে কাজ করছি। প্রতিবছর সীমান্তে ১০০-১৫০ জন খুন হচ্ছেন, আর তার ৮০ শতাংশই ভারতীয়। পুলিশ, বিএসএফ, কাস্টমস অফিসার সবাই যুক্ত অবৈধ পাচারের সঙ্গে। কিন্তু খুন হচ্ছেন সাধারণ নাগরিক। ২০০১ থেকে ২০১০ দশ সালের মধ্যে সীমান্তে বছরে খুন হত ১০০ জন মত। ২০১১সাল থেকে সেটা দাঁড়িয়েছে দেড়শোতে। প্রায় দেড় কোটি মানুষ সীমান্ত অঞ্চলে বাস করেন। তাদের কাছে সরকারের কোনও পরিসেবা নেই। বিদ্যুত্ নেই, পানীয় জল নেই, শৌচাগার নেই, শিক্ষা নেই। এবার কেন্দ্রের এই নয়া নির্দেশিকা তাঁদের অবস্থা আরও ভয়াবহ করে তুলবে।’
সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশা করি আগামীকাল বিধানসভায় প্রস্তাব পেশ করা হবে। কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরণজিত্ সিং চান্নিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই নির্দেশিকার তীব্র নিন্দা করেছেন। চান্নি বলেছেন, কেন্দ্র সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় আঘাত করেছে। একই সঙ্গে অমিত শাহকে এই নির্দেশিকা প্রত্যাহারের আরজি জানিয়েছেন চান্নি। এবার বাংলা থেকেও প্রতিবাদ জানাচ্ছি আমরা।’