নবীন প্রজন্মের এমন অনেক জন সক্রিয় লেখক আছেন যাঁরা এই সময়ে এগিয়ে এসেছেন নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে। যেটা এখন করণীয়, তা হল সেইগুলিকে মনোযোগ সহকারে পড়া এবং তাঁদের কাছ থেকে দু হাতের অঞ্জলি ভরে সেইগুলিকে গ্রহণ করা। এর জন্য বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা বা বড় মিডিয়া হাউজগুলির অনুমতির জন্য অপেক্ষা করা নিষ্প্রয়োজন।
এই সাক্ষাৎকারটি কলম্বিয়ার বাররাংকিয়্যা শহরের লেখক, সম্পাদক এবং সাংবাদিক পাউল ব্রিতোর যিনি এল মালপেনসান্তে এবং আর্কাদিয়া ই এল এরালদো পত্রিকাগুলির সহ সম্পাদক এবং রেবিস্তা আকতুয়াল পত্রিকাটির সম্পাদক। যিনি লিখেছেন Premio UIS 2008 পুরস্কারপ্রাপ্ত Los Intrusos (অনুপ্রবেশকারীরা) বইটির লেখক। লিখেছেন La Muerte del Obrero (শ্রমিকটার মৃত্যু) (২০১৪), El proletariado de los Dioses (ঈশ্বরদের প্রলেতারিয়েত) যেটি ২০১৬ সালে Premio Narrativa EAFIT র জন্য নির্বাচিত হয়েছিল, Arbol de Lebas (চক্রদন্তকের গাছ) এবং El Dios de los deseos Ajenas (দূরায়ত আকাঙ্ক্ষার ঈশ্বর)। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে লাভ করেছেন Portafolio Distrital de Estímulos de Barranquilla পুরস্কার। ২০২০ সালে পেয়েছেন Funación Esteros de Uruguay বৃত্তি। লেখকের এই সাক্ষাৎকারটি El Comején নামক অনলাইন পত্রিকায় সম্প্রকি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক শুক্তি রায়।
প্রশ্ন: নিজেকে কি এই সব বন্দরশহরগুলিতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর মতো মনে হয় ? প্রথমে বাররানকিয়্যা, তারপর বার্সেলোনা আর এখন লা বাররা ? এই শহরগুলি থেকে কী শিখেছ তুমি আর ওনেত্তি, কিরোগা আর বেনেদেত্তির মতো বড় বড় লেখকদের দেশ উরুগুয়ের কাছ থেকেই বা তোমার কী প্রত্যাশা?
পাউল: আমার মনে হচ্ছিল যে আমার পড়া প্রথম বড়দের গল্পটাই উরুগুয়ের আর সেটা থেকেই আমার মধ্যে লেগেছিল সাহিত্য পাঠের ছোঁয়াচ এবং সেভাবেই আমি লিখতে পেরেছিলাম আমার নিজের প্রথম গল্প “ A la deriva de Oracio Quiroga” (ওরাসিও কিরোগার পট পরিবর্তন )। এখন আমি বুঝতে পারি যে এই গল্পটিই ছিল একটা নদী পেরোনোর মতো, গল্পের নায়ক নিজের বেঁচে থাকার জন্য ছিল নদীর উপর নির্ভরশীল কিন্তু জীবন তাকে বাঁচতে দেয়নি। আমরা সব সময়ই পরিস্থিতির পট-পরিবর্তনের মধ্যে থাকি আর যা আমাদের সঙ্গে থেকেই যায়, তা হল নদী।
প্রশ্ন: এখন অনেক ভালো লেখক আছেন যারা সক্রিয় এবং নতুন প্রজন্মের যাঁরা জোরালো ভাবে নিয়ে এসেছেন সর্বার্থেই অনেক নতুন এবং অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনা…
পাউল: তোমার প্রশ্নটাকে একটু অন্য ভাবে ভাবতে হলে আমায় প্রথমেই আমার নিজেরই একটা থিওরি বা তত্বের কথায় আসতে হয় যা আমার পদবি ব্রিতোকে নিয়ে। আমি দেখেছি এই পদবির বেশির ভাগ মানুষই বাস করেন আটলান্টিক মহাসাগর ছুঁয়ে থাকা দ্বীপগুলিতে না, মূল মহাদেশে, বলতে গেলে ওখানকার বন্দর শহরগুলিতে। আমার বাবা ছিলেন ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা যেখানে এই পদবিটা অনেক মানুষেরই আছে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি যে ফুয়ের্তেবেন্তুরা শহরের বাসিন্দাদের আশি শতাংশই ব্রিতো পদবিধারী। এখানে অর্থাৎ কলম্বিয়াতে এদের বাস মূলতঃ গুয়াহিরা নামক অন্য একটা উপদ্বীপে আর ব্রিতোনদের বসতি হল সান আন্দ্রেস দ্বীপে। এই পদবিটাকে একটা পর্তুগিজ পদবি মনে করা হয় যারা আইবেরিক উপদ্বীপে আটলান্টিক মহাসাগরের ধারে বসতি স্থাপন করার আগে ছিল ব্রেতোন পদবিধারী (সেখান থেকেই এসেছে ব্রিতো কথাটা) আর ব্রেতানিয়া আবার আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত একটা উপদ্বীপ। এই ব্রেতোনরা আবার হল গ্রেট ব্রিটেনের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত সেল্টিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরী যাদের আবার বাস সেই আটলান্টিক মহাসাগরের পাশেই। তার মানে আমার অস্তিত্ব শুধুমাত্র আটলান্টিক তীরবর্তী বন্দর শহরগুলিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমার পূর্বপুরুষদের অনেক কিছুই এর মধ্যে মিশে আছে।
প্রশ্ন: ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতিই তো গত শতাব্দীতে কলম্বিয়ার মেইনস্ট্রীম সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত হত: নিয়েতো আর্তেতা, ফালস বোরদা, গার্সিয়া মার্কেস, মারভেল মোরেনো, সাপাতো ওলিভেয়্যা, সোনিয়া ওসোরিও, আলবারো সেপেদা, হেরমান এস্পিনোসা, আলবারো বাররিওস, সিলবিয়া চেরাসসি, এরনান সাহার, এক্তোর রোহাস এরাসো, পাচো গালান, লুচো বেরমুদেস এবং এই রকম আরো অনেকে। তোমার কি সাহিত্য স্রষ্টা হিসেবে কোস্তা ক্যারিবে (ক্যারিবিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল) তে কোনো সংকট অনুভূত হয়?
পাউল: না, একেবারেই না। অন্তত আমি সে রকম কিছু দেখতে পাই না। সাহিত্য নিয়ে কিছু বলতে গেলে যেটা আমার বক্তব্য, সেটা হল, নবীন প্রজন্মের এমন অনেক সক্রিয় লেখক আছেন যাঁরা এই সময়ে এগিয়ে এসেছেন নতুন নতুন ধ্যান ধারণা নিয়ে। যেটা এখন করণীয়, তা হল সেইগুলিকে মনোযোগ সহকারে পড়া এবং তাঁদের কাছ থেকে দু হাতের অঞ্জলি ভরে সেইগুলিকে গ্রহণ করা। এর জন্য বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা বা বড় মিডিয়া হাউজগুলির অনুমতির জন্য অপেক্ষা করা নিষ্প্রয়োজন।
প্রশ্ন: আলবের্তো সালসেদো রামোস, যিনি নিঃসন্দেহে কলম্বিয়ার সবচেয়ে সাহিত্যপঞ্জীকার, তোমাকে ‘তোমার প্রজন্মের সব চেয়ে বড় কথাশিল্পী’ বলে মনে করেন। আমরা জানতে আগ্রহী তোমার সাম্প্রতিক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আর ভবিষ্যতের জন্য তোমার মাথায় কী আছে সেটাও।
পাউল: আমার উপর সালসেদো রামোস যে ভরসাটুকু রাখতে পেরেছেন সেটা আমার কাছে এক গভীর প্রাণণা এগিয়ে যাওয়ার পথে। আমার সাম্প্রতিক কাজগুলির মধ্যে আছে একটা উপন্যাস যার মধ্যে কাহিনিসূত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। এটা বেরোতে চলেছে সেইক্স বাররাল থেকে। এর নাম হল Restos Organicos de un Mundo Anterior (পূর্ববর্তী এক পৃথিবীর জৈব অবশেষ)। অন্যদিকে একটা প্রবন্ধের বই আছে La Arte de la Continuidad (ধারাবাহিকতার শিল্প) নামে যা এই সময়ের সাহিত্যতত্বের একটা নমুনা।
প্রশ্ন: তোমার বাবা ‘কানারিও ব্রিতো’ নামে সুপরিচিত একজন ফুটবল খেলোয়াড় এবং দেপোর্তিভো পেরেইরা-র একজন কোচ আর বাররানকিয়্যার ছোট ছোট বাচ্চাদের ট্রেনার। তুমি কি কখনো তোমার বাবার জীবনের এই অতিমানবীয় ওঠাপড়া কখনো কাহিনিবদ্ধ করার কথা ভেবেছ?
পাউল: এর একটা বিবরণ আমি তুলে ধরেছি El proletariado de los Dioses-এর মধ্যে যার শিরোনাম ‘এল মাংগলার ই এল কানারিও’ (বাদাবন এবং ক্যানারি পাখি)। ইন্তারনে-এও এটা পড়তে পারা যায়। এই বিষয়টা ছুঁয়ে গেছি ‘লা উলতিমা দিলিহেন্সিয়া’ (শেষ অধ্যাবসায়)তেও। বাকিটা বিধৃত হয়েছে Restos Organicos de un Mundo Anterior বইটিতে। ওই বইটিতে আমার বাবা একটা প্রধান চরিত্রে আছেন।
প্রশ্ন: কোভিড-১৯ এর ফলে ঘরবন্দী জীবনে কেমন আছ?
পাউল: সবাই যেমন আছে তেমনই আছি আমিও, কখনো যন্ত্রণায়, কখনো নির্লিপ্ততায়, কখনো ক্লান্তি বিরক্তিতে, আবার মাঝে মাঝে মনে হয় লেখক হিসেবে গৃহবন্দী জীবনের এটা একটা বাড়তি বিস্তার ছাড়া আর কিছু নয়। এক এক সময় নিজেকে মনে হয় মৃত্যুদূতের কাছ থেকে পলাতক এক মানুষ যে আসলে তার সেই ধাত্রীমাতার কাছ থেকে পালিয়ে চলে এসেছে যিনি পৃথিবীর পথে পথে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁর দুষ্টু ছেলেদের।
প্রশ্ন: এই সময়ে কোন বই, কী সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ অথবা ডকুমেন্টারি তুমি তোমার পাঠকদের জন্য সুপারিশ করবে?
পাউল: একটা গল্প সংগ্রহ, ডরোথি এম জনসনের লেখা… El Arbol de ajorcado y otros Relatos de la Frontera (ঝুলে থাকা গাছ এবং সীমান্ত বিষয়ক অন্যান্য গল্প), যে বইটির কাছে আজীবন ঋণী থাকব আমি। নরবার্ট এলিয়াসের লেখা একটি দার্শনিক প্রবন্ধের একটা সংকলন Sobre el tiempo (কালের উপরে)। সিনেমার মধ্যে মানুয়েলের বিরিদিয়ানা, উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনার একটা সাম্প্রতিক সিরিজ ‘ এল ওত্রো এরমানো’।