|| মুহাম্মদ এ এইচ খান ||
বিলেতের একমাত্র ব্রডশিট কাগজ ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’ আমি খুঁটিয়ে খঁটিয়ে দেখি এবং এর সাহিত্য সাময়িকী নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করি। প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। গত সপ্তাহে ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’ ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কৃতজ্ঞ স্মরণ’ নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। জানে ই আলম, উদয় শংকর দাস, আলী ইমাম মজুমদার, আহমেদ রফিক, আবুল মোমেন, আবুল কাশেম ফজলুল হক, শাহদীন মালিক, শরিফুজ্জামান, ইকবাল বাহার চৌধুরী এমন আরো অনেকেই তাকে নিয়ে লিখেছেন। লেখকরা কেউ তাকে মানস গঠনের কারিগর বলেছেন, কেউ জাতীয় অধ্যাপক, জাতির বিবেক বলেছেন তো কেউ আবার মানবিক সমাজের অন্বেষণ করেছেন। লেখায় কেউ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেছেন আবার আনিসুজ্জামান তার দীক্ষাগুরু অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে ছাড়িয়ে গিয়েছেন কিনা এই নিয়েও সন্দিহান হয়েছেন। অর্থাৎ স্তুতিতে সবাই আনিসুজ্জামানকে ভাসিয়েছেন।
মৃত লোকের প্রশংসা করতে হয় এটাই নিয়ম। তাছাড়া বিশেষ সংখ্যায় যেহেতু ‘কৃতজ্ঞ স্মরণ’ কথাটা বলা হয়েছে সেহেতু এই সংখ্যার লেখকরা সবাই তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বরণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামে তারা যেভাবে ড. আনিসুজ্জামানের স্তুতি করেছেন পড়ে আমার মনে হয়েছে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তৃতীয় শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের মত একটি চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন, আর অনেকগুলো মানুষ তার পদতলে বসে নানা গুণকীর্তন করছেন। এমন লোকের গুণকীর্তন করতে পারার জন্য নিজেরাও গর্ববোধ করছেন, জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথাও গর্বের সাথে বলছেন! অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যারা সরাসরি ছাত্র ছিলেন তাদের কথা আলাদা। তারা না হয় শিক্ষক সম্পর্কে একটু বাড়িয়ে বলবেন, বলেছেনও- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই তালিকায় আরো অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ আছেন, লেখক আছেন। জ্ঞানীগুণী মানুষদের এই সামন্ত-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ লক্ষ্য করেই আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। কারণ ব্যক্তি স্তুতি আমি খুবই অপছন্দ করি। মনে হয় একজন মানুষের চরিত্র নষ্ট করতে এর থেকে বড় উপায় আর হয় না। বঙ্গদেশে অন্ধ ব্যক্তি স্তুতি যে কত অপদার্থের কপালে জুটেছে তা হিসেবের বাইরে। থার্ড রেইট রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে, এর ফলে এরা ফোর্থ রেইট নেতানেত্রীতে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ পরিণত হয়েছে স্বেচ্ছাচারী দানবে। যে প্রশংসা যার প্রাপ্য নয়, সে প্রশংসা মানুষ হজম করতে পারে না। এটাই মানব প্রকৃতি। তারপরও একেকটা ধূর্ত মানব-মানবীকে অতিমানব কিংবা অতিমানবী বানিয়ে বন্দনা করাই যেনো বাঙালির কাজ। অর্থাৎ কোনো না কোনো দেবতার প্রয়োজন বাঙালির হয়-ই হয়! মৃত বা জীবিত কোন না কোনো দেবতার পুজো ছাড়া যেনো বাঙালির চলেই না। সে পুজো দিবে, দেবতার হয়ে তর্ক করবে, মারামারি করবে। হাতে ক্ষমতা থাকলে দেবতার কোন সমালোচনা করা যাবেনা এই মর্মে আইন করবে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন, জাহেল বা মুর্খ মানুষ দুই প্রকার। প্রথম প্রকারের নাম জাহেলে বাসীত। অর্থ্যাৎ সাধারণ মুর্খ। যে সিম্পলি জানেনা। আমরা অনেকক্ষেত্রেই জাহেলে বাসীত। যেমন করোনা ভাইরাসের নিরাময় কি এটা নিয়ে পুরো মানবজাতি এখনো জাহেলে বাসীত। আরেক প্রকার জাহেল হলো জাহেলে মুরাক্কাব। অর্থাৎ, উচ্চস্তরের মুর্খ। যে কি না নিজের মুর্খতাকেই সঠিক মনে করে। যাকগে, সেসব কথা থাক। আজকে বরং অধ্যাপক আনিসুজ্জামানেই থাকি। আনিসুজ্জমানের প্রশংসা করতে যেমন আনিসুজ্জমান হওয়ার দরকার নেই তেমনি আনিসুজ্জমানের সমালোচনা করতে গেলেও আনিসুজ্জমান হওয়ার দরকার নেই। কেউ কারো মত হয়ও না। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা আছে কিন্তু আনিসুজ্জামানের যে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দর্শন তাতে আমার বিন্দু মাত্র শ্রদ্ধা নেই। এত কথা বলছি এই কারণে যে জাতীয় ব্যক্তিত্ব বলেই কোন কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। তারপরও কখনো কখনো একটু লিখতে হয়। সংশ্লিষ্ট মানুষকে বিব্রত করতে চাই না বলে অমিষ্ট সত্য কখনও কখনও বলি না যথাস্থানে। আবার, হজমও করতে পারি না, অন্যায় হচ্ছে বলে। এই অনুভূতির প্রকাশ কোন ঘৃণাবাদের চর্চা না। বরং এটা হলো বাংলাদেশের সর্বব্যাপী অমানবিক ঘৃণাবাদ ও বিভক্তির বিরুদ্ধে আমার একান্ত মানবিক প্রতিবাদ। তাই আশাকরি লেখাটা সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
আনিসুজ্জামান বাঙালির প্রগতিশীল মানস গঠনের কারিগর শিরোনামে প্রথম লেখাটি লিখেছেন কবি ও সাংবাদিক সারওয়ার-ই আলম। তিনি লিখেছেন, ….’বাংলায় বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।’ আমি লেখকের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। এই ভূমিকা আনিসুজ্জামান পালন না করলেও পারতেন। ড. আনিসুজ্জামান ড. কামাল হোসেনদের ইংরেজিতে লেখা সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তিনি ‘রিপাবলিক’ ধারণার সাথে ‘প্রজা’ ধারণার কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্বেও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ এর অনুবাদ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ লিখে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজা আর দেশের জনগণকে আক্ষরিক অর্থে প্রজায় পরিণত করেছিলেন। তেমনি ‘ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর বা ডেপুটি কমিশনার’ এর বাংলা ‘জেলা প্রশাসক’ করে ডিসিদের জেলার রাজায় পরিণত করেছিলেন। জেলায় জেলায় তাদের রাজত্ব চলছে। ডিসি অফিসগুলো হেরেমখানায় পরিণত হয়েছে। এমন আরো অনেক বিষয়ই আছে যা এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। মূল কথা হলো অনুবাদ কর্মটা তিনি এভাবে না করলেও পারতেন। ড. আনিসুজ্জামানের জায়গায় অন্য কাউকে এ দায়িত্ব দিলে তিনি বরং এ অনুবাদ কর্মটি অর্থাৎ দায়িত্বটি আরো ভালোভাবে পালন করতে পারতেন।
স্মরণ সংখ্যার লেখকরা প্রায় সবাই ড. আনিসুজ্জামানকে মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন। উদয় শঙ্কর দাশ লিখেছেন, ‘… এরপর ১৯৭১ এ শুরু হয়ে গেলো স্বাধীনতা সংগ্রাম। স্যার নিয়েছিলেন সক্রিয় ভূমিকা। আগরতলা হয়ে চলে গেলেন কলকাতা।’ কিন্তু উদয় শঙ্কর দাশ বলেননি কিভাবে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। তবে সে সময়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম- ‘… ড. আনিসুজ্জামান কলকাতায় গড়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে একটি দল। তিনি তাদের নিয়ে ঘুরেছিলেন সারা উত্তর ভারতে। তাঁর লক্ষ্য ছিল নাচ-গান-অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে-বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার পক্ষে জনমত গঠন। এ সময় উত্তর ভারতে জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে ছিল না। তারা মনে করছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যেয়ে ভারতের উচিত হবে না কোনো বড় রকমের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। … জানি না আনিসুজ্জামান তার দল নিয়ে উত্তর ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে জনমত গঠনে কতটা সাফল্য পেয়েছিলেন। কেননা, বাংলা গান উত্তর ভারতে কেউ বোঝে না। সুরের দিক থেকেও পছন্দ করে না। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জনগণমন’ গান পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের আর সব প্রদেশে গাওয়া হয় হিন্দি অনুবাদে। তাই বাংলা গান দিয়ে লোক জাগানো সম্ভব নয় উত্তর ভারতে। আনিসুজ্জামান সাহেব ও তার নাচ-গান-অভিনয়ের সাথীরা ভালোই ছিলেন ভারতে। তারা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে ভালো খেয়েছেন, পরেছেন এবং থেকেছেন ভালো হোটেলে।’ তাহলে বুঝেন ড. আনিসুজ্জ্বামান কেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! ড. আনিসুজ্জামানের শ্বশুর ও বড় বোন জামাই পাকিস্তানিদের দালাল ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তার শ্বশুরের নাম টপ কোলাবরেটরদের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য খুলনার তৎকালীন ডিসি ড. কামাল সিদ্দিকীর কাছে তদবির করতে গিয়েছিলেন।
আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘…..ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ খেতাব দিয়ে সন্মানিত করেছেন। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সান্মানিক ডিলিট উপাধি দিয়েছে।‘ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শেখ হাসিনাকেও সান্মানিক ডিলিট উপাধি দিয়েছে তাতে জাতির কি কোন উপকার হয়েছে? ২০১৪ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত ড. অনিসুজ্জামানকে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করেছে। ‘পদ্মভূষণ’ ভারতের তৃতীয় বেসামরিক সর্বোচ্চ সম্মাননা। ‘র’ এর গ্রিণ সিগনাল না পেলে ও নিতান্ত অন্ধভাবে ভারতের সেবাদাস না হলে ভারত এই পদক কাউকে দেয়না। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী ভারতের প্রতি কেউ সীমাহীন আনুগত্য ও দাসত্বই প্রকাশ না করলে তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আনিসুজ্জামান পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং অসাধু উপায়ে নিজের জন্মস্থান খুলনা দেখিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কাজেই বাংলাদেশ না হোক অন্তত জন্মভূমির জন্য অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিনি যদি তার প্রাণোৎসর্গ করতেন কিংবা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক তিনি যদি সন্মানিত হতেন তাহলে বলার কিছু থাকতোনা। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্যবাদী ভারত সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন, সন্মানিত হয়েছেন। কাজেই এতে বাঙালিদের আহলাদিত হওয়ার মত আমি তেমন কিছু দেখিনা।
ড. আনিসুজ্জামান সাম্রাজ্যবাদী ভারত কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত হয়েছেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে গেছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শেখ হাসিনার ক্যাঙ্গারু ট্রাইবুনালে সাফাই স্বাক্ষ্য পর্যন্ত দিয়েছেন! হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বাংলাদেশের মানুষ কম বেশি সবাই ধর্মভীরু। ড. আনিসুজ্জামান মানুষের এই ধর্ম চর্চা নিয়েও অ্যালার্জি দেখিয়েছেন। বাঙালি সংস্কৃতিকে অত্যন্ত সার্থকভাবে তিনি ইসলামী সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন এবং জীবনভর তিনি ইসলামী সংস্কৃতি ও হিজাবের চরম বিরোধিতা করেছেন। ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশের যে কয়েকজন আত্মস্বীকৃত নাস্তিক অ্যালার্জি প্রদর্শন করেছেন আনিসুজ্জামান ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এই ধারার মানুষের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন এবং বলতে গেলে তিনি তাদের খতিব ছিলেন। আনিসুজ্জামানের ধর্ম পরিচয় নিয়ে মনে হয় আর বেশি কথা বলার দরকার নাই। ধর্মের বিষয় নিয়ে কথা কম বলাই ভালো। তবে ইহ জাগতিক নৈতিকতা যা উনি চর্চা করে গেছেন তা উল্লেখ করলে খুব বেশি বোধহয় অনৈতিক হবে না।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের শিষ্যদের মধ্যে ড. আনিসুজ্জামান সবচেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের দুই শিষ্য ফরহাদ মজহার ও আহমেদ ছফা স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অত্যাবশ্যক ও অবশ্যমান্য প্রিন্সিপলস ১) আইনানুগ বৈধতা (লেজেটিম্যাসি), ২) স্বচ্ছতা (ট্রান্সপারেন্সি), ৩) দায়বদ্ধতা (একাউন্টেবিলিটি), এবং ৪) সুশাসন (গুড গভার্নেন্স) এর জন্য মেরুদণ্ড সোজা রেখে লড়াই করেছিলেন। ফরহাদ মজহার এখনো করছেন। অন্যদিকে ড. আনিসুজ্জামান সকল স্বৈরাচারী সরকারের সাথেই মিলেমিশে ছিলেন। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া সরকারের আমলে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকারের আমলে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে হাসিনা সরকারের আমলে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছিলেন এবং ২০১৮ সালে তিনি শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এমনকি সাম্রাজ্যবাদী ভারত সরকার কর্তৃক তিনি পদ্মভূষণ পদকও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ধর্মেও ছিলেন জিরাফেও ছিলেন। ড. আনিসুজ্জামানকে নিয়ে ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন, “আমাদের অজাতশত্রু গুণে-গৌরবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ড. আনিসুজ্জামান কি জাদুকরী নীতি ও আদর্শে একাধারে ও যুগপৎ বিরোধী রাজনীতিক দলের প্রতিবাদী বিবৃতির লেখক ও স্বাক্ষরদাতা, বক্তা হয়েও সরকারের কাজে-কমিটিতে, রেডিও-টিভিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য ও আস্থাভাজন থাকেন। আবার একাধারে ও যুগপৎ মার্কিন ও রাশিয়ার প্রিয় ও আস্থাভাজন থাকেন তা ভেবে পাইনে। তিনিই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনন্য পুরুষ। তাঁর জনপ্রিয়তাও অসামান্য। তাঁর বক্তৃতার কোন শব্দ বা বাক্যই আজো কারো আপত্তির বা অপছন্দের কারণ হয়নি। ড. আনিসুজ্জামান হচ্ছেন পদ্মপত্র বা কচুপাতার মতো চরিত্রের লোক। জলেতে নামবে, কিন্তু গায়ে জল লাগাবে না।” ড. আহমদ শরীফের এই কথাই প্রমাণ করে আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন চরম সুবিধাবাদী লোক। স্বার্থ হাসিলের জন্য যখন যা করার দরকার হতো তিনি তাই করতেন।
গত ১১ বছর দেশে যে অনিয়ম, লুটপাট , ভোট চুরি , হত্যা , খুন , গুম সংঘটিত হয়েছে সেদিকেই লক্ষ্য করেন। ড. আনিসুজ্জামানকে কখনো এসব বিষয়ে কথা বলতে দেখেছেন? বিশ্বের তাবদ মিডিয়া ও মানবাধিকার সংগঠন গুলি এসব নিয়ে সোচ্চার হলেও তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন! তিনি দেশের সকল অনিয়ম ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সব সময়ই নীরব ছিলেন। অথচ তাঁকে বলা হতো জাতীয় অধ্যাপক অর্থাৎ জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্যবাদী ভারত ও স্বৈরাচারী শেখ পরিবারের প্রতি তার আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন। একজন জাতীয় অধ্যাপক হয়েও জাতির প্রতিটি সংকটকালে, জাতির যে কোন দুর্যোগকালে তিনি নীরব থেকেছিলেন। তিনি তাঁর চোখের সামনে দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার লুন্ঠিত হতে দেখেও মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। ব্যাংক লুট, রিজার্ভ লুট, শেয়ার বাজার লুট, টাকা পাচার, গুম ,খুন, দুর্নীতি, অপশাসন এমনকি দেশের ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতেও তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন। আনিসুজ্জামান তাহলে আসলে কী ছিলেন? শ্রমিকদের ধর্মঘটের পরে যেমন একজন নেগোশিয়েটর লাগে। আনিসুজ্জামান তেমন একজন ঐতিহাসিক নেগোশিয়েটর ছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে মিথ্যা আওয়ামী বয়ান সেই আওয়ামী বয়ানই তিনি সারা জীবন জাতিকে গিলিয়েছিলেন। যেইগুলা আসলে ইতিহাসের ফুটনোটও না। ইতিহাসে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বৈরাচার বলবেন না, শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলবেন না। এই জন্য আওয়ামী ও স্বগোত্রীয় বামদের বাইরের কেউ ড. আনিসুজ্জামানের ইতিহাসকে গনায় ধরে না। ড. আনিসুজ্জামানকেও তারা কেউ পোছেনা।
ড. আনিসুজ্জামানের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো যেই ফ্যাসিবাদের সেবায় তিনি জীবনযাপন করেছিলেন সেই ফ্যাসিবাদী শাসকের করোনা অব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই তিনি শেষ হলেন। বাংলাদেশে যদি সরকারিভাবে যথাযথভাবে করোনার ব্যবস্থাপনা হতো তাহলে হয়তো তিনি করোনায় আক্রান্ত হতেন না। এগুলির বিরুদ্ধে সময় মত প্রতিবাদ করলে হয়তোবা তাঁকে এই ভাবে মরতে হতো না! জানিনা, বাদবাকিদের এখনও এই হুঁশ হবে কি না! হুঁশ না হলে অদুর ভবিষ্যতে তাদের বিদায়ের পর সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আসলে কী ধরণের অপরিসীম ঘৃণা অপেক্ষা করতেছে তা হয়তো তারা জানেন না। করোনা মোকাবেলায় যেসব দেশ আগাম প্রস্তুতি নিয়েছিল সেসব দেশের মানুষ তেমন আক্রান্ত হয়নি। ড. আনিসুজ্জামান যদি জানতেন যে করোনা সংক্রমণে তিনি নিজেও মারা যেতে পারেন তাহলে চীনে যখন করোনা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই মুজিব বর্ষ পালনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলতেন। শেখ হাসিনার অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারকে সতর্ক করতেন, পরামর্শ দিতেন। একজন জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে সরকারকে তিনি দিক নির্দেশনা দিতেন।
যাই হোক, মৃত ব্যক্তির বেশি সমালোচনা করতে নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর যে পান্ডিত্য ও জ্ঞানের কথা স্মরণ সংখ্যার লেখকরা লিখেছেন সেখানে কোন দ্বিমত নেই। সে জায়গায় তিনি অসামান্য প্রতিভাধর একজন মানুষ ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। ড. আনিসুজ্জামানের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। লক ডাউনে পিডিএফ পাঠিয়ে পত্রিকা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী এমাদ ভাইকে ধন্যবাদ জানাই।
লেখক: সম্পাদক, গবেষক, রাষ্ট্রচিন্তক ও বিশ্লেষক
2 Comments
Mohammad Badruzzaman Babul
ধন্যবাদ লেখক মুহাম্মদ এ এইচ খান কে, তার মুল্যবান লিখনির জন্য মরহুম ডঃ আনিসুজ্জামান প্রসংগে।
অাসলেই মৃত ব্যক্তির অালোচনা না করা বা কম করাই ভালো, এটি লেখকও উল্লেখ করেছেন।
তবে ব্যক্তির চেয়ে তার দর্শন বা আদর্শের আলোচনা/সমালোচনা হতে পারে অন্যদের শিক্ষার জন্য, আর সেই ব্যক্তি যদি হন সামাজিক বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ।
আর যেহেতু অন্যান্য জাতীয় পর্যায়ের লেখকেরা লিখেছেন অার তারাও জীবিত অার এদের অনেকেই জালেম শাসক শ্রেণির তাবেদার /দালাল! এজন্যই লিখাটি জনগুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে অনেক সত্য ও তথ্য রয়েছে। অার এজন্য লেখকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কারন, সরকার বা শাসক শ্রেনীর বিরুদ্ধে অনেকেই গোপনে বা প্রকাশ্যে কিছু বললেও লিখতে সাহস করেন না!
অাবারো ধন্যবাদ জানাই লেখককে যে তিনি ডঃ অানিসুজ্জামানের অাদর্শ ও দর্শনের অালোচনার পাশাপাশি মরহুম যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন পণ্ডিত ছিলেন এটিও উল্লেখ করেছেন এবং মরহুমের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। ধন্যবাদ।
এম বি জামান বাবুল
মিডিয়া ও কমিউনিটি একটিভিস্ট, যুক্তরাজ্য।
GB Today
পোস্ট পড়া এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এরকম আরো লেখা পড়তে চাইলে পোর্টালটির গ্রাহক অপশনে ক্লিক করে রাখুন এবং ফেইসবুক ও টুইটারে দয়া করে শেয়ার করুন। জাযাকআল্লাহ।