আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিকভাবে চাঙা হওয়ার চেষ্টা করছে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিও পুনর্গঠন করছে তারা। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে যখন বৃহৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি, তখনই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া পুরোনো মামলা নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ- দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। তবে নেতাকর্মীদের দাবি, এভাবে হয়রানি করেও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা যাবে না জাতীয়তাবাদী শক্তিকে।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বেশ পুরোনো মামলা সচল হয়েছে। নয় বছর আগের অগ্নিসংযোগের এক মামলায় রাজধানীর মুগদার সাত বিএনপি কর্মীর দুই বছর করে সাজা হয়েছে। এক মামলায় আটক হয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন দলের নবীন নেতা ইশরাক হোসেন।
‘বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মামলা রয়েছে ৩১৩টি’
বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মামলা রয়েছে ৩১৩টি।
যুবদলের আগামী কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষপদে আলোচনায় থাকা ইসহাক সরকার জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন ৫-৭টা মামলার হাজিরা থাকে, সপ্তাহে পাঁচদিন এভাবে চলে। আদালতে হাজিরা দিয়ে এসে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেই।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাও কম নয়। ১৯ মামলার আসামি তিনি।
মামলার বিষয়ে জাগো নিউজকে নিপুণ বলেন, মামলা-হামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আমাকে সরানো যাবে না। তিন মাস কারাগারে যে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, দেশের কোনো দলের নারী নেত্রী এমন নির্যাতনের শিকার হননি। কারাগার থেকে বের হয়ে আবারও দলীয় কর্মসূচি পালন করছি।
‘বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে সরকার মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় জড়িয়ে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু তাদের কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না। রাজপথ এবং আইনগত লড়াই আমরা চালিয়ে যাবো এবং ন্যায়বিচার পাবো’
মামলার কারণে কতটা চাপ অনুভব করছেন- জানতে ইসহাক সরকার এবং নিপুণ রায় চৌধুরী দুজনই একই কথা বলেন। তারা জানান, চাপে রাখার জন্য এ ধরনের হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার বাইরে প্রশাসনের চাপ, ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের চাপ রয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ যদি ঠিক থাকে, দলের প্রতি যদি অনুগত থাকা যায় তাহলেই চাপ আর চাপ মনে হয় না। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সবসময়ই প্রস্তুত থাকি।
বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদে আলোচনায় থাকা ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ ২২ মামলার আসামি।
এই বিএনপি নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পরিহার করে যখন থেকে ফ্যাসিজম চর্চা করছে, বিশেষ করে গত ১৪ বছর হামলা-মামলার মাধ্যমে বিএনপির গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে অগণতান্ত্রিকভাবে দমন করে নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে সফল না হয়ে আগামী নির্বাচন ঘিরে তারা অনেক চক্রান্ত শুরু করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো সুনির্দিষ্টভাবে সাক্ষী না থাকা ভিত্তিহীন পুরোনো হয়রানিমূলক মামলাগুলোতে সাজা দিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এবং আগামী প্রজন্মের নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার হীন প্রচেষ্টা। আমরা এতে ভীত নই। আমরা রাজনৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে এসব মোকাবিলা করবো। সর্বোপরি জনগণের আদালতে বিজয় সুনিশ্চিত।
বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, দলটির ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ১০ হাজার মামলা রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাইরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৯১ মামলা, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ৪৫, বেগম সেলিমা রহমান অর্ধশত, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু ১৩৬, উপদেষ্টা পরিষদের আমানউল্লাহ আমান ৯১, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শতাধিক, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১৩০, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল তিন শতাধিক, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ১০১ ও যুবদল নেতা এসএম জাহাঙ্গীর দেড়শতাধিক মামলার আসামি।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, হয়রানি করার জন্যই মামলাগুলো দেওয়া। সাজা দেওয়ার ঘটনা বলে দেয় সরকার সেই অবস্থানেই আছে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যেসব মামলা দেখছি সেগুলো কোনোটা সাক্ষ্যগ্রহণ, কোনোটা অভিযোগপত্র দেওয়ার পর্যায়ে আছে। আসলে মামলা এত বেশি যে কোনটা কোন অবস্থায় আছে বলা মুশকিল। তবে যাদের সাজা হবে তাদের জন্য রাজনীতি কঠিন হবে, এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে সরকার মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় জড়িয়ে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু তাদের কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না। রাজপথ এবং আইনগত লড়াই আমরা চালিয়ে যাবো এবং ন্যায়বিচার পাবো।
এ বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় চক্রান্তমূলকভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অসত্য মামলা রুজু করা হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় করার এক সুপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
‘একই পদ্ধতিতে অন্যান্য নেতার নামে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিত থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার সহধর্মিণী প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা এখনো সচল রাখা হয়েছে। সরকারের এহেন ষড়যন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরম বহিঃপ্রকাশ।’
তিনি বলেন, হঠাৎ করে মামলাগুলো তালিকায় নিয়ে এসে শুনানির দিন ধার্য করা, পুরো প্রক্রিয়াটাই দুরভিসন্ধিমূলক, অশুভ নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা শুনেছি যে, তালিকা তৈরি করেছে সরকার। সেই তালিকা ধরে বিভিন্ন জেলায় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে সেগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য একটা সেল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই সেল দিয়ে দ্রুত মামলাগুলো শেষ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নিজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে, সেই মামলাগুলোতে কী আছে? একটা হচ্ছে—আমি নাকি ময়লার গাড়ি পুড়িয়েছি, সিটি করপোরেশনের গাড়ি পুড়িয়েছি। সেক্রেটারিয়েটের ভেতরে মোটরসাইকেলের পেছনে গিয়ে নাকি বোমা মেরেছি। এসব মামলা আমার বিরুদ্ধে।