মাহফুজুর রহমান মুন্সি, লন্ডন, ২৩ অক্টোবর: জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি একটি অজানা ‘কোয়াসি-মুন’ বা আধা-চাঁদ সদৃশ বস্তু আবিষ্কার করেছেন। নতুন গবেষণা অনুযায়ী, ছোট এই মহাজাগতিক শিলাটি গত ৬০ বছর ধরে পৃথিবীর আশেপাশে ঘুরছিল, কিন্তু কোনো টেলিস্কোপের নজরে আসেনি। নতুন এই মহাজাগতিক বস্তুটির নাম ‘২০২৫ পিএন৭’। এটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তবে পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি অবস্থান করে। পৃথিবীর মতোই ‘২০২৫ পিএন৭’- সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এক বছর সময় নেয়।
কোয়াসি-মুন এমন একটি বস্তু, যা পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি ঘোরে, কিন্তু স্থায়ীভাবে পৃথিবীর উপগ্রহ নয়। এটি ‘২০২৪ পিটি৫’- এর মতো অস্থায়ী ‘মিনি-মুন’-এর থেকে আলাদা। ২০২৪ সালে ‘২০২৪ পিটি৫’-দুই মাস ধরে পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করে এবং ধারণা করা হয় এটি পৃথিবীর আসল চাঁদ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খণ্ড। ‘২০২৫ পিএন৭’- হলো পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি পরিচিত কয়েকটি কোয়াসি-মুনের একটি। এর মধ্যে একটির নাম ‘কামো’ওলেওয়া’, এটিও সম্ভবত চাঁদের খণ্ড বলে মনে করা হয়। চীনের তিয়ানওয়েন-২ মিশনের মাধ্যমে ২০২৭ সালে কামো’ওলেওয়া’ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফেরত আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার তথ্যানুসারে, বর্তমানে পৃথিবীর আশপাশে মোট সাতটি কোয়াসি-মুন রয়েছে। হাওয়াইয়ের হেলেয়াকালা আগ্নেয়গিরিতে অবস্থিত ‘প্যান-স্টারস’- মানমন্দির গত ২৯ আগস্ট ‘২০২৫ পিএন৭’-কে প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ করে। সংরক্ষিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বস্তুটি বহু দশক ধরে পৃথিবীর মতো কক্ষপথে ঘুরছে। স্পেনের মাদ্রিদের কমপ্লুটেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্লোস দে লা ফুয়েন্তে মার্কোস জানান, এত বছর ধরে বস্তুটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চোখ এড়িয়ে গেছে এর ক্ষুদ্র আকার ও ক্ষীণ উজ্জ্বলতার কারণে। তার এই গবেষণাপত্রটি গত ২ সেপ্টেম্বর রিসার্চ নোটস অব দ্য আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি -তে প্রকাশিত হয়।
মার্কোসের মতে, বস্তুটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে আসে প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল (২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩৭ কিলোমিটার) দূরত্বে। গড়ে এটি পৃথিবী থেকে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫৫ মাইল (৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার) দূরে অবস্থান করে। তিনি বলেন, ‘এটি কেবল তখনই শনাক্ত করা সম্ভব, যখন এটি পৃথিবীর খুব কাছাকাছি আসে, যেমনটি এই গ্রীষ্মে ঘটেছিল। এর দৃশ্যমানতার সুযোগ খুবই সীমিত।’ তিনি আরও বলেন, কোয়াসি-মুন নিয়ে গবেষণা সৌরজগতের গঠন ও নিকট-পৃথিবী মহাকাশ সম্পর্কে নতুন তথ্য উন্মোচন করতে পারে। মার্কোস বলেন, ”সৌরজগৎ বিস্ময়ে ভরপুর, তাই আমরা খুঁজে চলেছি। ‘২০২৫ পিএন৭’-এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, কোয়াসি-স্যাটেলাইটের আকারের কোনো ন্যূনতম সীমা নাও থাকতে পারে।”
অস্থায়ী সঙ্গী
গবেষকরা এখনও ‘২০২৫ পিএন৭’-এর আকার নির্ধারণের চেষ্টা করছেন। মার্কোসের ধারণা, এর ব্যাস মাত্র ৩০ মিটার (৯৮ ফুট) হতে পারে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর কক্ষপথে আবিষ্কৃত সবচেয়ে ছোট কোয়াসি-মুন। সময়ক্রমে ‘২০২৫ পিএন৭’- একটি বৃত্তাকার পৃথিবীসদৃশ কক্ষপথ থেকে ‘কামো’ওলেওয়া’-এর মতো ঘোড়ার নাল আকৃতির কক্ষপথে রূপ নেয়। সেসময়ে এটি পৃথিবী থেকে দূরে সরে গিয়ে ১৮ কোটি ৫০ লাখ মাইল (২৯ কোটি ৭০ লাখ কিলোমিটার) দূরত্বে অবস্থান করে। আনুমানিক আরও ৬০ বছর এটি পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে থাকবে, এরপর সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ টানে আবার ঘোড়ার নাল আকৃতির কক্ষপথে ফিরে যাবে। এর গঠন সম্পর্কে এখনও তেমন কিছু জানা যায়নি।
ভিলানোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. টেডি কারেতা বলেন, ‘যা জানা গেছে, তাতে এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রাকৃতিক পাথুরে বস্তু। অনেক সময় পুরোনো স্যাটেলাইট বা রকেটের ধ্বংসাবশেষও এমন কক্ষপথে থাকে, কিন্তু আমরা সাধারণত তাদের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বস্তুর পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারি।’ তিনি আরও জানান, খারাপ আবহাওয়ার কারণে এখনও তিনি নিজে এই বস্তুটি পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি।
মার্কোসের মতে, ‘২০২৫ পিএন৭’- সম্ভবত ‘আর্জুনা অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট’ থেকে এসেছে, যা মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝের মূল অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের মতো নয়। এটি পৃথিবীর মতো কক্ষপথে থাকা ছোট ছোট গ্রহাণুর একটি দল। তিনি পূর্বে ধারণা দিয়েছিলেন, ‘২০২৪ পিটি৫’- নামের ‘মিনি-মুন’-টিও আর্জুনা বেল্টের অংশ হতে পারে, যা মূলত পৃথিবীর চাঁদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওই বেল্টে যুক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, এখন আমরা জানি, চাঁদের সংঘর্ষে উৎক্ষিপ্ত পদার্থও আর্জুনা অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে যোগ হতে পারে।’ তবে এসব ‘কোয়াসি-মুন’ বা ‘মিনি-মুন’ পৃথিবীর কাছাকাছি এলেও কোনো সংঘর্ষের আশঙ্কা নেই।
মার্কোস বলেন, ‘২০২৫ পিএন৭’- পৃথিবীর জন্য কোনো হুমকি নয়।’ তিনি আরও মনে করেন, চীনের তিয়ানওয়েন-২ মিশনের মতো অভিযান যদি এসব কোয়াসি-মুনে পাঠানো যায়, তবে এদের উৎস ও ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। মার্কোস বলেন, ‘এই ধরনের গ্রহাণুগুলোতে পৌঁছানো তুলনামূলক সহজ এবং কম খরচে মানবহীন মহাকাশ মিশনের জন্য দারুণ সুযোগ।’





