কোভিড-১৯ মহামারির ধকল কাটাতে সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হলে দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে।
মঙ্গলবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সরকারের কোভিড-১৯ সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ও ত্রাণ কর্মসূচির প্রাথমিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এমন মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা।
সংলাপে আলোচকরা বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রফতানিমুখী বৃহৎ শিল্প, কৃষি উন্নয়ন, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর একটি বড় অংশ বাস্তবায়িত হবে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান তারল্য সংকট ও মন্দঋণের চাপ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।’
‘দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য প্রণোদনা ঘোষিত হলেও পোশাক শ্রমিকদের একটি বড় অংশ পূর্ণাঙ্গ বেতন ও অন্যান্য ভাতাদি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং চাকরি হারাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ও ঋণ সুবিধা এখনও যথাযথভাবে ভোগ করতে পারছেন না। এর পাশাপাশি, সরকারের বিভিন্ন ত্রাণ কার্যক্রমে বাছাই ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এসব সমস্যার সঠিক সমাধান না হলে প্রকৃত অংশীজনরা প্রণোদনার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন’, বলেন তারা।
সংলাপে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যৌথভাবে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
প্রতিবেদনটি সিপিডির ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা (আইআরবিডি)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রস্তুত করা হয়েছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চলে আসছে। ইন্টারপোল তাদের সাম্প্রতিক একটি বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশকে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আর্থিক প্রতারণার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তালিকায় রেখেছে।
এ অবস্থায় সুশাসনের অভাব ও আইনের শাসন প্রয়োগ না হলে ক্রমবর্ধমান মন্দঋণের চাপ ও তারল্য সংকটের ঝুঁকি নিয়ে সুষ্ঠুভাবে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এতে অসাধু গোষ্ঠীর সুযোগ নেওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে,’ বলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, সরকারের চলমান ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাচ্ছে। প্রকৃত জনগোষ্ঠীর কাছে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পৌঁছে দিতে হলে সুবিধাভোগী বাছাই, ত্রাণ বিতরণ ও ত্রাণের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বিস্তৃত করা জরুরি।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন, গার্মেন্টস শ্রমিক ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ এই প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সুবিধা পাচ্ছে না।
সিপিডির জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ১৫ শতাংশ শ্রমিক তাদের এপ্রিল মাসের পূর্ণাঙ্গ বেতন পেয়েছেন, বাকিরা কেউ আংশিক পেয়েছেন এবং প্রায় ২৭ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক অর্ধেকেরও কম বেতন পেয়েছেন কিংবা একেবারে কিছুই পাননি। প্রায় ৬৩ শতাংশ শ্রমিক তাদের বাসাভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি এবং জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৩৫ শতাংশ শ্রমিক বর্তমানে কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছেন। তারা ব্যাংক থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পাচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরও আন্তরিকভাবে সহযোগিতার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি।
সংলাপে অংশ নেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবীব মনসুর, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক লীলা রশীদ, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, মো. সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
এ ছাড়া জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সভাপতি মির্জা নুরুল গনি শোভন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক চায়না রহমান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেনসহ ব্যবসায়ী, গবেষক, উন্নয়নকর্মীরা অংশ নেন।
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবীব মনসুর বলেন, যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন, তাদের জন্য একটা বিশেষ প্রোগ্রাম বা প্যাকেজ করতে হবে, যেটার মাধ্যমে তাদের সাপোর্ট দেয়া যেতে পারে। সেজন্য একটা ফান্ড করা দরকার এবং এই বাজেটেই সেটা থাকা উচিত। আমাদের হিসাবে এসএমই খাত থেকে প্রায় ৭০ লাখ বেকার হয়ে গেছেন। লকডাউন তোলার পরে রিকশাচলকরা হয় তো রিকশাটা চালাচ্ছে, কিন্তু সেভাবে আয় হচ্ছে না। যারা বাদাম বিক্রি করত তারা হয়তো কাজ শুরু করছে, কিন্তু আগের মতো আয় হচ্ছে না। আমাদের প্রস্তাব প্রায় দেড় কোটির মতো পরিবারকে সাপোর্ট দেয়া দরকার।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ঠিকমতো বিতরণ হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকার্স এবং কিছু ট্রেডবডি নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, প্রতিটি সেক্টরে ঋণের প্রবাহটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা মাসিক মনিটরিং করার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে। টাকা বিতরণ না হলে কোথায় সমস্যা? কোন সেক্টরে সমস্যা? তা নির্ণয় করে, সেখান থেকে উত্তরণের দায়িত্ব হবে এই কমিটির। আমি মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব এটা করা দরকার।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, আমরা কঠিন একটা সময় পার করছি। আমি বরাবরই আশাবাদী একটা লোক। আমি আশা করি, সব যদি ঠিকঠাক থাকে, আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে আমরা আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারব এবং কপাল ভালো থাকলে আমরা আগের থেকেও ভালো করতে পারি।
এ আশার পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে নানারকম বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ইউরোপ ও আমেরিকা কয়েক দিন আগে একটি অনানুষ্ঠানিক জোট ঘোষণা করেছে। একটা বড় ধরনের চীনবিরোধী মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আমরা আশা করছি, ভালো অর্ডার ওখান থেকে স্থানান্তরিত হবে। তবে সেটা কালকেই হবে না, এর জন্য সময় লাগবে। এ বছরের শেষের দিকে গার্মেন্টস খাতের অর্ডারের ক্ষেত্রে আমরা একটা ভালো ফ্লো আশা করতে পারি। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গার্মেন্টগুলোকে টিকিয়ে রাখা।
তিনি বলেন, বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ছয় মাস কারখানাগুলো টিকিয়ে রাখা। কারণ, যদি কারখানা চালু না থাকে, তাহলে আমার সুযোগ তৈরি হলেও কোন বন্ধ কারখানায় কেউ অর্ডার দেবে না, এটা খুবই স্বাভবিক। কারখানা চালু হওয়া বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি, গার্মেন্টস কারখানার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কারখানাগুলো আমরা কীভাবে চালু রাখতে পারব। শ্রমিকদের বেতন, মজুরি আনুষঙ্গিক অনেক বড় খরচ। মাঝারিমানের একটি ফ্যাক্টরিতে মাসে ৪-৫ কোটি টাকা খরচ করতে হয়, কারখানা চালু রাখার জন্য, সরাসরি উৎপাদন খরচের বাইরে।