- ‘এটা ভারত নয়’ মিছিল থামাতে বলায় প্রধানমন্ত্রীকে পুলিশ কমিশনার।
আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: গাজায় ইসরায়েলী আগ্রাসনের ধাক্কা লেগেছে ব্রিটিশ সরকারেও। প্যালেস্টাইন ইস্যুতে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে বরখাস্ত হয়েছেন ব্রিটেনের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান। গত ১৩ নভেম্বর সোমবার তাকে মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ থেকে অব্যাহতির নির্দেশ দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।
কট্টর প্যালেস্টাইন বিরোধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি। আর জেমস ক্লিভারলির স্থানে মনোনীত হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।
এই নিয়ে এবার দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চাকরি হারালেন সুয়েলা। এর আগে লিজ ট্রাসের সরকার থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। সুনাক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সুয়েলাকে পুনরায় নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে সুয়েলার বিরুদ্ধে পুলিশের পেশাগত স্বাধীনতা এবং জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করার অভিযোগ আনার পর চাপের মুখে পড়েন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তখন থেকেই সুয়েলার পদত্যাগের জোরালো দাবি ওঠে। সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানকে বরখাস্ত করতে নিজের দল কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরাসহ বিরোধী দল লেবার পার্টির আইনপ্রণেতারাও সুনাককে চাপ দিচ্ছিলেন।
এই ঘটনার সূচনাটা হয়েছিল গত ১১ নভেম্বর শনিবার। সেদিন প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদে ও ইসরাইল-হামাস সংঘাত নিয়ে লণ্ডনের রাস্তায় প্যালেস্টাইনের পক্ষে বিক্ষোভ করে আট লাখেরও বেশি মানুষ। একই দিন একই স্থানে ইসরায়েলপন্থীরাও বিক্ষোভের চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে প্রতিবাদ মিছিলে কেঁপে উঠা লণ্ডনের সেই সমাবেশে উগ্রপন্থীরা অতর্কিত হামলা চালায়। পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধলে প্রায় ১৪০ জন উগ্রপন্থীকে গ্রেফতার করে লণ্ডন পুলিশ।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্যালেস্টাইনপন্থী বিক্ষোভকারীদের থামাতে অপর একদল বিক্ষোভকারী মিছিলে অতর্কিত হামলা চালানোয় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এ হামলার নিন্দা জানালেও প্যালেস্টাইনপন্থীদের এই বিক্ষোভ ছিল ইসরায়েলের আগ্রাসনের ঘোর সমর্থক সুনাক সরকারের বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলার জন্য বেশ বিব্রতকর। পুলিশ সেদিন ওই বিক্ষোভ ঠেকাতে মাঠে নামা উগ্র ডানদের বাধা দেওয়ায় সুয়েলা মোটেও খুশি হননি। ফলে কট্টর প্যালেস্টাইন বিরোধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান প্যালেস্টাইনের পক্ষে লাখো জনতার এ বিক্ষোভ সমাবেশকে ‘ঘৃণা সমাবেশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এমনকি প্যালেস্টাইনপন্থীদের বিক্ষোভ বন্ধ করে দিতেও তিনি লণ্ডন পুলিশকে অনুরোধ করেন। পুলিশ তার কথায় কর্ণপাত না করলে ব্রিটেনজুড়ে চলা ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান। পুলিশ আন্দোলনকারীদের পক্ষ নিচ্ছে, এমন অভিযোগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সুয়েলার এমন মন্তব্যের পর ওঠে সমালোচনার ঝড়। বিরোধী দলসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে সংঘাত উস্কে দিচ্ছেন সুয়েলা। সেই বিতর্কের জেরেই তার পদত্যাগের দাবি ওঠে ব্রিটেনজুড়ে।
গত সপ্তাহে টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান বলেন, লন্ডনে এবার বিক্ষোভের সময় পুলিশ বামপন্থীদের পক্ষ নিয়েছে। বিক্ষোভের সময় এলেই লণ্ডনের জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের পক্ষ নিচ্ছেন। এবারও তো এমন দেখা গেল। প্যালেস্টাইনপন্থীদের চেয়ে ডানপন্থীদের প্রতি কঠোর ছিল পুলিশ। অর্থাৎ তিনি বলতে চেষ্টা করেন, প্রধানমন্ত্রী সুনাকের প্রশাসন ইসরায়েলপন্থী ও প্যালেস্টাইনপন্থী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পৃথক আচরণ করছে। ব্রিটিশ পুলিশ ইসরায়েলপন্থীদের তেমন কোনো বাধা না দিলেও প্যালেস্টাইনপন্থীদের বিক্ষোভে বাধা দিচ্ছে। সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানের এ সমালোচনা ভালোভাবে নেয়নি বিরোধী দল লেবার পার্টি ও তার নিজের দল কনজারভেটিভ পার্টি।
কট্টর ইসরাইলপন্থী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান গাজায় ইসরাইলী হামলা বন্ধে প্রায় আট লাখ লোকের বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে ঋষি সুনাকের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন এবং প্যালেস্টাইনপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে চলমান উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেন। পুলিশ ও লেবার পার্টি দাবি করে, তিনি পুলিশ–বিক্ষোভকারী সংঘর্ষ উসকে দিয়েছেন। মূলত এরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপে পড়েন প্রধানমন্ত্রী সুনাক। যার ফলে বাধ্য হয়ে সোমবার তাকে বরখাস্ত করেন।
এদিকে জানা গেছে, উগ্র ডানপন্থীদের পক্ষ নিয়ে সেদিনের প্যালেস্টাইনের পক্ষে হওয়া বিক্ষোভ মিছিলকে ঠেকাতে চেয়েছিল সুনাক সরকার। এমনকি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও সেদিন প্যালেস্টাইনপন্থীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশকে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মিছিল থামাতে বলায় লণ্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মার্ক রাওলি সুনাককে জবাবে বলেছিলেন, ‘আপনি এটা করতে পারেন না, এটা ভারত নয়।’ লণ্ডন পুলিশ সেদিন এই বিক্ষোভে বাধা দেয়নি বরং উগ্র ডানদের পাল্টা বিক্ষোভ-সহিংসতা ঠেকিয়ে দেয়। সেদিনের নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য পুলিশের প্রশংসা করছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। সাধারণত পুলিশকে সরকারের সব নির্দেশ পালন করতেই দেখা যায়। ভারতে সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো বড় সমাবেশ পণ্ড করে দেওয়ার দায়িত্বটা পালন করে পুলিশই। হয়তো লণ্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশের কমিশনার মার্ক এদিকটাই ইঙ্গিত করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান ও ঋষি সুনাক উভয়ই সমবয়সী। সুনাকের বয়স ৪২, ব্রেভারম্যানের ৪৩। সুনাকের পূর্বপুরুষরা পাঞ্জাব থেকে এবং সুয়েলার পূর্বপুরুষরা গোয়া থেকে যুক্তরাজ্যে এসে স্থায়ী হয়েছেন। ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তালিকায় সুয়েলার নাম সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকবে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান এর আগেও অভিবাসীদের নিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন।