।। শাহদীন মালিক ।।
সিপিডি আয়োজিত আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৪ দিনব্যাপী আলোচনায় ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সূচনা বক্তব্য শুনেছি এবং ৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে সেই বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রশ্নোত্তর পর্বে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলছিলেন, ষাটের দশকে যে বক্তব্য তিনি এক ঘণ্টায় লিখে ফেলতে পারতেন, সেই রকমের কিছু এখন লিখতে গেলে সপ্তাহখানেক সময় লেগে যায়। কারণ, এখন অনেক ভেবেচিন্তে লিখতে হয়। লেখা দাঁড় করাতে গিয়ে কী লেখা যাবে আর কী লেখা যাবে না, সেই চিন্তা করতেই সময় চলে যায়। এ ধরনের কথা তিনি ইদানীং একাধিকবার বলেছেন। তাঁর তুলনায় আমরা তো নস্যি। বলতে গেলে ভয়ে আমাদের বলা বা লেখা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, এই লেখায় তাঁদের গাত্রদাহ হলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গণতন্ত্রের যা কিছু ছিটেফোঁটা এখনো টিকে আছে, অন্তত সেটুকু জিইয়ে রাখতে ঝুঁকি নিয়ে হলেও কিছু কথা তো বলতেই হবে।
কিছুকাল আগে একটা নামীদামি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরে যাওয়া উপাচার্য তাঁর এলাকায় হাজির হয়েছিলেন ডজন ডজন মোটরসাইকেল আরোহী ও মাইক্রোবাসভর্তি অনেক সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। এই শোডাউনের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতির মাঠে নিজের সরব উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন। অন্য কথায়, রাজনীতি করতে হলে যত বড় করে মাস্তানি দেখানো যায়, ততই বোধ হয় হঠাৎ করে একটি রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা যায়। অবসরে যাওয়া মাননীয় উপাচার্যের শোডাউন বৃথা যায়নি।। ইদানীং এক নির্বাচনে জনগণের কথিত ভোটে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
কয়েক বছর আগে আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না দুর্নীতি, ডাকাতি ও খুনের মামলার আসামিরা অকাতরে রাজনীতিতে আসবেন এবং মনোনয়ন পাবেন। রাজনীতি বদলে গেছে। কেন এমন হচ্ছে? এর একটা সহজাত উত্তর আছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনে গণতন্ত্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয় এবং রাজনীতির মাঠে অপরাধীদের আবির্ভাবের পথ সুগম হয়ে ক্রমান্বয়ে অপরাধীরাই হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ।
অশ্লীল ও অকল্পনীয় নোংরা কথাবার্তার জন্য যে প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক ইতিবৃত্তি আমার জানা নেই। ধারণা করি, ওই নামে যে একজন প্রতিমন্ত্রী আছেন, তা কিছুদিন আগপর্যন্ত হয়তো বেশির ভাগ নাগরিকের অজানা ছিল। হঠাৎ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আমরা তাঁর উপস্থিতি টের পাই, যখন তাঁর আবোলতাবোল ও সাংঘাতিকভাবে অভদ্রজনোচিত কথাবার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বা জনসেবায় বিরাট ভূমিকার জন্য তিনি মন্ত্রী হতে পেরেছিলেন, এমন ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এটা স্পষ্ট যে রাজনীতিতে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করা ছাড়াই হঠাৎ রাজনীতির মাঠে একটা বড় জায়গায় তিনি হাজির হয়ে গিয়েছিলেন। এখন রাজনীতির প্রচলিত ধারণাগুলো সব উল্টে যাচ্ছে।
২.
গত তিন দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং নির্বাচন ঘিরে সহিংস ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণ গেছে এবং আহত হয়েছেন হাজারখানেক। এই নির্বাচনের আরও কয়েকটি ধাপ বাকি। সেই নির্বাচনগুলোতে আরও কিছু মানুষ হতাহত হতে পারে, সেই ভয় রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে এই সব সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহের বিষয়গুলো আলোচনায় বারবার এসেছে। কিন্তু এসব সংঘর্ষ ও হতাহতের পেছনে যে কারণটি মোটেও গৌণ নয়, তা আলোচনায় আসছে না। সেটা হলো ‘শোডাউনের রাজনীতি’। যাঁরা প্রার্থী হচ্ছেন বা হতে চাচ্ছেন, তাঁরা ‘শোডাউনে’ পারদর্শী। দুই শোডাউনে পারদর্শী প্রার্থীর সমর্থকেরা মারামারি করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তাঁদের কাছে আদর্শ খুবই নগণ্য। জনসেবার ধার তাঁরা ধারেন না। তাঁরা যা চান তা হচ্ছে পদ।
দেখা যাচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ভোটে জেতার মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে হানাহানি, মারামারি, চায়নিজ কুড়াল বা দেশি–বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র। অর্থাৎ রাজনীতি ও রাজনৈতিক পদ এখন চলে যাচ্ছে মাস্তান, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের হাতে। অবশ্য যোগ করতে হবে যে কিছু ভালো মানুষ এখনো রাজনীতি করেন, রাজনীতির মাঠে আছেন এবং জনগণের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হতে চান। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এরই ফলে পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রীর মতো বা দুর্নীতি, চাল চুরি, ডাকাতি, খুন ও আরও অনেক অপরাধে অভিযুক্ত লোকজন রাজনীতিতে জায়গা করে নিচ্ছেন। তাঁরা নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এমন অভিযুক্ত অনেকেই মনোনয়ন পেয়েছেন এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমরা দেখেছি এর ফলে কিছু মনোনয়ন বাতিলও হচ্ছে।
আসল কথা হলো, কয়েক বছর আগে আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না দুর্নীতি, ডাকাতি ও খুনের মামলার আসামিরা অকাতরে রাজনীতিতে আসবেন এবং মনোনয়ন পাবেন। রাজনীতি বদলে গেছে। কেন এমন হচ্ছে? এর একটা সহজাত উত্তর আছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনে গণতন্ত্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয় এবং রাজনীতির মাঠে অপরাধীদের আবির্ভাবের পথ সুগম হয়ে ক্রমান্বয়ে অপরাধীরাই হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ। সূক্ষ্ম বা সঠিক হিসাব না করেও সাধারণভাবে ৩০–৪০টি দেশের নাম বলা যায়, যেখানে সরকার কর্তৃত্ববাদী, গণতন্ত্র দুর্বল ও রাজনীতি চলে গেছে দুর্বৃত্তের হাতে। মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশে এই ধারা লক্ষ করা যায়।
আমাদের গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে। মূল প্রতিষ্ঠানগুলো, অর্থাৎ বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, জবাবদিহি, ভোটের অধিকার এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ—এই ধরনের লক্ষ্য অর্জনের মাপকাঠিতে আমাদের অভীষ্ট মুক্তি থেকে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি।
তবে এই ধারার দেশগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের দেশ হচ্ছে আফ্রিকার রাষ্ট্র টোগো। বাপ ছিলেন ৪০ বছর ধরে ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপ্রধান। এরপর বাপকা বেটা, অর্থাৎ ছেলে ‘নির্বাচিত’ হয়ে ক্ষমতায় আছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। অর্থাৎ বাপ–বেটার নির্বাচিত রাজত্ব চলছে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে। আফ্রিকায় এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী দেশের সংখ্যা গোটা বিশেকের কম হবে না। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যে সরকারপ্রধান প্রথম বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তিনি হচ্ছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। ১৯৮৬ সাল থেকে এই বেচারা বারবার নির্বাচিত হয়েই যাচ্ছেন। আগেই বলেছি, এ ধরনের অন্তত ৩০–৪০টি দেশ বিশ্বে রয়েছে।
৩.
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্যে ফিরে আসি। অর্থনৈতিক বিভিন্ন মাপকাঠিতে গত ৫০ বছরে নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সালের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অনেক হিসাবে আমরা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে ছিলাম। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ কিছু মাপকাঠিতে আমরা পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে গিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে মোট জাতীয় উৎপাদন, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক বাণিজ্য, শিক্ষার হার ও নারীর ক্ষমতায়ন। এগুলো আমাদের স্বাধীনতার সুফল।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতায় আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেছে এবং এর অনেক সুফল আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামের সুফল আমরা পাইনি বললেই চলে। আমাদের গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে। মূল প্রতিষ্ঠানগুলো, অর্থাৎ বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, জবাবদিহি, ভোটের অধিকার এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ—এই ধরনের লক্ষ্য অর্জনের মাপকাঠিতে আমাদের অভীষ্ট মুক্তি থেকে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি।
এই পিছিয়ে পড়ার জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে মুরাদ হাসানের মতো ব্যক্তিরা সংবিধানে বিবৃত শপথ নিয়ে এই দেশের মন্ত্রী হচ্ছেন। এই গোছের লোক তিনিই প্রথম বা শেষ নন। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মন্ত্রীর মতো পদে তাঁদের সংখ্যা বাড়বে। কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে আমরা সত্যিকার গণতন্ত্রের পথে কখন যাত্রা শুরু করতে পারব, তা এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর। যত দিন এই যাত্রা শুরু না হবে, তত দিন একজনের পদত্যাগে খুব বেশি কিছুর পরিবর্তন হবে না।
ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক