ঢাকা অফিস: বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও এখনো থামছে না রিজার্ভের ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভের পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় কমছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য না থাকার কারণে প্রতি মাসে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের মতো ঘাটতি থাকছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাজারে ডলারের যে অভাব রয়েছে সেটা আংশিক পূরণ করার জন্য প্রতি মাসে এক শ’ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক বিক্রি করছে। এভাবে বিক্রি চলতে থাকলে রিজার্ভ কমতেই থাকবে।’
‘আর এটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলতে গেলে বলতে হবে যে, সেটা আসলে শূন্যের নিচে নামার সুযোগ নাই!’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নভেম্বরে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফ এর প্রস্তাবিত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভ ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ আসলে কত?
চলতি বছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২.২২ বিলিয়ন ডলার এবং সর্বশেষ নভেম্বরে রিজার্ভ ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই ১১ মাসের মধ্যে শুধু জুন মাসেই মোট রিজার্ভের পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় কিছুটা বেড়েছিল। বাকি মাসগুলোতে ক্রমান্বয়ে রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার কমেছে।
এদিকে গত জুন মাস থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফের নির্ধারিত হিসাব পদ্ধতি যা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল-সিক্সথ এডিশন বা সংক্ষেপে বিপিএম৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গণনা শুরু হয়।
জুন মাসে এই পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪.৭৫ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বরে এটি ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এই ছয় মাসে রিজার্ভ প্রায় প্রতিবারই আগের মাসের তুলনায় কমেছে।
বলা হচ্ছে, বিপিএম অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ যে ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি দেখানো হচ্ছে সেটি আসলে আরো কমবে। কারণ এর থেকে আইএমএফের এসডিআর খাতে থাকা অর্থ, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ এবং আকুর বিল পরিশোধ বাবদ অর্থ বাদ দিলে রিজার্ভ আরো কমে আসবে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমান সময়ের সমস্যা হচ্ছে সরকারের অনেক অপরিশোধিত বিল রয়েছে- যেগুলো এখনো শোধ করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো পুরোটা শোধ করা হলে রিজার্ভ হয়তো অনেক কমে যাবে।’
তবে এক্ষেত্রে দ্বিমত প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দু’টি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একটা হচ্ছে গ্রস বা মোট, অর্থাৎ যে পরিমাণ বিদেশী সম্পদ হাতে আছে, যা নভেম্বরে ২৫.১৬ বিলিয়ন। আরেকটা হচ্ছে বিপিএম৬ অনুযায়ী হিসাব যা ১৯.৫২ বিলিয়ন।
তিনি বলেন, ‘এখন আপনি যদি এর থেকে আবার আরো কিছু বাদ দিতে চান, তাহলে সেটার বেসিসটা কী? লায়াবিলিটিস (দায়) তো আমার কত লায়াবিলিটি আছে, সেটা কি আমি সব হিসাব করব? আইএমএফ এর কাছে যে ডিপোজিটটা আছে সেটা কি আমার টাকা না?’
মেজবাউল হক মনে করেন, আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাবের পরও মানুষকে আসলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ আইএমএফর পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। ‘তারপরও কেন প্রশ্নটা আসছে?,’ বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অবশ্য বলেন, ব্যাংকে যে অর্থ থাকে তা হিসাবধারীর নিজের টাকা হলেও তার যে দায় আছে সেগুলো ব্যবহার করা যায় না। ‘তাই ব্যবহারযোগ্য টাকাটাই আসলে হিসাবধারীর মূল অর্থ বলে বিবেচিত হয়। একই পদ্ধতি রিজার্ভের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য,’ মন্তব্য তার।
রিজার্ভে ঘাটতি কেন?
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রিজার্ভের পরিমাণ গড়ে প্রতি মাসে এক বিলিয়ন করে কমার কারণ হচ্ছে ডলারের আয় ও ডলারের ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। পর্যাপ্ত যোগান না থাকার কারণে আমদানি কমালেও তা রিজার্ভ ধরে রাখতে সহায়ক হয়নি।
বাংলাদেশে ২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কোভিডের পর ডলারের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছিল। তবে সেসময় তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি চালু ছিল। ফলে রফতানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ চালু ছিল। এই কারণে রিজার্ভ তখন বেড়েছে।
তিনি বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করলে সব কিছু কেনার প্রবণতা বাড়ে। তখন রিজার্ভ খরচ হওয়া শুরু হয়। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পণ্যের সাপ্লাই-চেইন ব্যাহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বেশি দামে পণ্য কেনার কারণে রিজার্ভের উপর চাপ পড়ে।
‘নরমাল সময়ে যে ফার্টিলাইজার ২০০-২৫০ ডলার, সেই ফার্টিলাইজার আমরা কিনলাম হচ্ছে ১০৫০ ডলার দিয়ে। রিজার্ভের রিকোয়ারমেন্ট তখন বাড়ল।’
এর পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সুদের হার দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর কারণেও বাংলাদেশে রিজার্ভে টান পড়েছে বলে জানান মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের পার্থক্য হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদে যে ঋণ নিয়েছিল লোকসান কমাতে সেগুলো খুব দ্রুত শোধ করার চেষ্টা করেছে।
এর ফলে একদিকে রিজার্ভের ওপর যেমন টান পড়েছে, অন্যদিকে আবার লায়াবিলিটি পেমেন্ট বা ঋণের পরিমাণ কমে এসেছে।
‘লায়াবিলিটি পেমেন্ট কমতে কমতে সেপ্টেম্বরে কিন্তু আমাদের ৫০ মিলিয়নে দাঁড়াবে, এক্ষেত্রে কিন্তু একটা বড় ধরনের পজিটিভ জিনিস চিন্তা করছি,’ বলেন মেজবাউল হক।
ঘাটতি ঠেকানোর উপায় কী?
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধের জন্য যে পরিমাণ ডলার ব্যয় হয়, তার তুলনায় যদি যোগান না বাড়ে তাহলে রিজার্ভের ওপর টান থাকবে।
এটাকে সামাল দেয়ার দু’টি বিকল্প আছে।
একটা হচ্ছে, চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতাকে সামাল দেয়ার জন্য ডলারের বিনিময় হার ছেড়ে দেয়া। অর্থাৎ বিনিময় হার যে পর্যায়ে উঠলে চাহিদা কমবে, সেটিকে সে পর্যায়ে উঠতে দিতে হবে। এতে ডলারের দাম বেড়ে গেলে ডলার কেনার প্রবণতা কমবে। আর আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বেশি দাম মেলায় প্রবাসী ও রফতানি আয় বাড়বে। সব মিলিয়ে চাহিদা কমে যোগান বাড়বে। এটাই ডলার সঙ্কট সামাল দেয়ার সবচেয়ে টেকসই উপায় বলে মনে করেন তিনি।
আর দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে, ডলারের যোগান বিভিন্ন উৎস থেকে বাড়ানো যা বাংলাদেশ বর্তমানে চেষ্টা করছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চিন্তা করতে হবে যে কিভাবে তহবিলের ‘হার্ড ফ্লো’ বাড়িয়ে ভারসাম্য আনা যায়।
সরকার এখন স্বল্পমেয়াদে নানা ডিল বা চুক্তি করছে। যেটি পরিশোধ করতে গেলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে যাচ্ছে। এখান থেকে বের হতে হলে ঋণদাতাদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজেটেও কিছু সংকোচনমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ২৩’ অর্থবছরে সরকার টাকা ছাপানোর যে পদক্ষেপ নিয়েছিলো সেটি থেকে সরে আসতে হবে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এ চাপটি আবার আসবে। তখন এটি ধরে রাখা গেলে সেটি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নির্বাচনের পর পরিবর্তন?
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন চলতি হিসাব এখন অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ একটা অবস্থায় চলে এসেছে। বছরখানেক আগেও এই হিসাব ঋণাত্মক ছিল। আমদানি কমিয়ে আনার মাধ্যমে চলতি হিসাবে ভারসাম্য ফেরানো হয়েছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক।
এছাড়া সুদের হার আমানতের ক্ষেত্রে ৬% এবং ঋণের ক্ষেত্রে ৯% এর জায়গা থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বাড়ানোর নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণের সুদের হার এখন সর্বোচ্চ ১১.১৮ শতাংশ হতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ মনসুর বলেন, সুদ-হার বাড়ানোর পর হয়তো ডলারের মজুদে একটা ভারসাম্য আসতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এরমধ্যে আইএমএফ এর দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হলে সেখানে ৬৭০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাথে পাঁচ শ’ মিলিয়ন ডলার নগদ সহায়তা ছাড় করানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ সেটা পাওয়ার আশা রয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি থেকেও একই ধরণের অর্থায়নের যোগানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এছাড়া ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-আইডিবি এবং বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সূত্র যেমন সৌদি আরবের কাছ থেকে দুই শ’ কোটি ডলারের মতো সহায়তা, জাপান, জাইকার মতো উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তা ছাড়া গত অর্থবছরে রফতানি আয়ের যে নয় বিলিয়ন ডলার আসেনি, তার সিংহভাগ এই অর্থবছরে নির্বাচন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা শেষ হয়ে গেলে, জানুয়ারির পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে এই ডলারও ফেরত আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই সব অর্থ পাওয়া গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আট-নয় মাসের মতো একটা সময় পাওয়া যাবে। একইসাথে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও বাংলাদেশ আশাবাদী।
এরই মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো বড় বড় অর্থনীতিতে সুদের হার ও মুদ্রাস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। সুদের হার কমলে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যে আর্থিক খাতে যে বড় ঘাটতি আছে সেটা পাল্টে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকের একটা পূর্বাভাস আছে যে মার্চের মধ্যে তাদের মুদ্রাস্ফীতির হার দুই শতাংশের মধ্যে চলে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির হার এরইমধ্যে ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে। তারা মনে করছে, খুব দ্রুতই এই হার আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই এবং এটি আরো কমে আসবে।
এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজার আবার সক্রিয় হবে এবং বাংলাদেশ এখন যে সুদের হার বাড়িয়েছে সেটি কার্যকর হবে।
সে সময় ডলার প্রবাহও স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের জুন নাগাদ সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি