- গুলি, বোমা ও ক্ষুধায় মরছে ফিলিস্তিনি শিশুরা।
- সরকারি অবহেলা ও পুষ্টিহীনতায় মরছে বাংলাদেশি শিশুরা।
লণ্ডন, ২৪ মার্চ: ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলার বড় শিকার শিশুরা। গুলি-বোমার পাশাপাশি সেখানে শিশুরা মারা যাচ্ছে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতেও। ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের বাধার কারণে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে গত পাঁচ মাসে ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। যেসব ব্যক্তি এসব শিশুর হত্যার কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা জোর দিয়ে বলেছেন, টার্গেট করা শিশুগুলো ছিল নিরস্ত্র এবং তারা ইসরাইল রাষ্ট্র বা এর নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের হুমকিও তৈরি করছিল না। ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি সৈন্যদের চোরাগোপ্তা হামলা, ড্রোন হামলা এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় এই শিশুরা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া এই যুদ্ধে গাজায় প্রায় ২০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গত কয়েক দিনে ২০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পানিস্বল্পতা ও ক্ষুধায় উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে আরও ৪ শিশু মারা গেছে। এ নিয়ে কয়েক দিনে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ২৪–এ গিয়ে ঠেকেছে। এর আগে উত্তর গাজার আল-শিফা হাসপাতালে ২ শিশুর মৃত্যু হয় বলে গত বুধবার জানিয়েছিল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গাজায় এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল নিউট্রিশন ক্লাস্টার গত মাসে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, গাজার ৯০ শতাংশ ৬ থেকে ১৮ মাস শিশু খাবারের সংকটে রয়েছে। এ ছাড়া গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ানো নারীরা ভুগছেন গুরুতর খাদ্যসংকটে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৫ বছর বয়সি শিশুদের ৯০ শতাংশই কোনো না কোনো ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়েছে। উত্তর গাজার একমাত্র শিশু হাসপাতাল কামাল আদওয়ান হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ইমাদ দারদোনাহ বলেছেন, ‘যা সরবরাহ আছে তাতে অর্ধেক শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে। আমাদের কাছে শিশুদের দেওয়ার মতো কিছু নেই। আমরা এখন তাদের শুধু স্যালাইন বা চিনির দ্রবণ দিতে পারছি। এই সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত হয় তা হলে মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দেবে। যা শিশুর মানসিক বিকাশে দীর্ঘ সময়ে প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাবে। ফলে এক পর্যায়ে এসব শিশুরা অকাতরে মারা যাবে।’
এদিকে বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার মত যুদ্ধাবস্থা না থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে দেশের নাগরিকদের গড় আয়ু যেমন কমেছে তেমনি শিশুমৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। নবজাতক, এক বছরের কম বয়সী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু—তিন ক্ষেত্রেই মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিগত পাঁচ বছরের হিসাবেই এমন চিত্র উঠে এসেছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবনে রোববার এক অনুষ্ঠানে বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনে (২০২৩) এই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। বিবিএস বলছে, ২০২২ সালে দেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল হাজারে ২৫ জন, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭। পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২১। অন্যদিকে এক মাসের কম বয়সী নবজাতকের মৃত্যুহার হঠাৎ বেড়ে গেছে। প্রতি এক হাজার জীবিত নবজাতকের মধ্যে ২০ জন মারা যায়। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬। পাঁচ বছর আগে ছিল ১৫। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩৩ জন। ২০২২ সালে ছিল ৩১ জন। পাঁচ বছর আগে ছিল আরও কম, ২৮ জন। শিশুমৃত্যুকে একাধিক বয়সসীমায় দেখা ও পর্যালোচনা করা হয়। যেমন নবজাতকের (২৮ দিনের কম বয়সী) মৃত্যু, এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু। তবে সাধারণভাবে শিশুমৃত্যু বলতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক তুলনার সময় এই বয়সসীমাকে ব্যবহার করা হয়। এর হিসাব হয় প্রতি হাজারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশে প্রতিবছর ২৪ হাজারের বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে। অপুষ্টি, বায়ুদূষণ ও কম জন্ম–ওজন নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। দেশে ৫ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। ৫০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে আছে।
এছাড়া গর্ভকালীন পুষ্টির ঘাটতিজনিত কারণে অনেক মৃত শিশুর জন্ম হচ্ছে। দিনে গড়ে ৩৭ মৃত শিশুর জন্ম হচ্ছে। দেশে নবজাতক মৃত্যুর দুই–আড়াই গুণের বেশি জন্ম হচ্ছে মৃত শিশু। সাধারণত মায়ের গর্ভে ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ করার পর কোনো শিশু মারা গেলে সেটিকে মৃতজন্ম বা মৃত প্রসব বলা হয়। এ সময়ের আগে গর্ভে শিশুর মৃত্যুকে গর্ভপাত বলা হয়। তবে কোনো কোনো সংজ্ঞায় ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভে থাকার পর মৃত শিশুর জন্ম হলে মৃতজন্ম বলা হয়। দেশে বিদ্যমান মাতৃসেবা কর্মসূচি সঠিকভাবে কাজ করলে বছরে ৮৩ হাজার শিশুর অধিকাংশই পৃথিবীর বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারত। সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে চার বছর ধরে নবজাতক মৃত্যুর হার বাড়ছে। তবে ২০২২ সালে তা হঠাৎ করে লাফিয়ে বেড়েছে। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত মোট ৫৮৬টি সরকারি হাসপাতালে ১০ হাজার ৫৩৩ নবজাতক (২৮ দিন পর্যন্ত বয়স) মারা গেছে। বেসরকারি হাসপাতালে ও বাড়িতে প্রসবের সময় কত নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে এবং কত শিশু মৃত অবস্থায় জন্ম নিয়েছে, তার হালনাগাদ তথ্য সরকারের কাছে নেই।
শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এনআইসিইউয়ের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান জানিয়েছেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মা পুষ্টি না পেলে গর্ভের সন্তান অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়। দেশে নবজাতক মৃত্যুর প্রধান প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে অপরিণত অবস্থায় শিশুর জন্ম, সেপসিস (রক্ত, ফুসফুস, মস্তিষ্কে জীবাণুর সংক্রমণ), নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য সংক্রমণ, হৃদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক, নাড়ি, ফুসফুস, স্বায়ুরজ্জুতে জন্মগত ত্রুটি। এ ছাড়া শিশু জন্মের পর কাঁদতে না পারলে শ্বাসরোধ হয়, ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন যায় না এবং এতে শিশুর খিঁচুনি হয়। তিনি বলেন, নবজাতকের মৃত্যুরোধে মায়ের প্রসব–পূর্ব সেবা ও হাসপাতালে প্রসব করানোর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। একজন মা গর্ভধারণের পর তাঁকে নিবন্ধন করে সরকারি নজরদারিতে আনতে হবে।
বিবিএস প্রতিবছরই ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ প্রকাশ করে থাকে। বিবিএসের প্রতিবেদনে শিশুমৃত্যু কেন বেড়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। শিশু মৃত্যুহার গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসূচক। শিশুমৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অর্থ দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আটবার প্রসব–পূর্ব সেবা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৬০ শতাংশ গর্ভবতী চারবারও প্রসব–পূর্ব সেবা পান না। দেশে এখনো ৩৩ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে। অতিঝুঁকিপূর্ণ নবজাতক ও শিশুদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সব হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মিডওয়াইফ নেই।
২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছিল জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তাতেও বলা হয়েছিল, দেশে শিশুমৃত্যুর হার ৩১। শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সার্কভুক্ত প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের মধ্যে পিছিয়ে আছে। এমনকি আফ্রিকার কোনো কোনো দেশ থেকেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ।
উল্লেখ্য, কোনো ভূখণ্ডের যদি ২০ শতাংশ মানুষ অতিমাত্রায় খাদ্যসংকট, ৩০ শতাংশ পুষ্টিহীনতা এবং এক হাজার জনে দুজন অনাহারে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়, তাহলে সেই অবস্থাকে ওই অঞ্চলের জন্য দুর্ভিক্ষ বলা হয়। দুই দশকে মাত্র দুইবার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালে সোমালিয়ায় এবং ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়। সেই পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশ।