ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ২-এর ৯১১টি দোকান উচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। করপোরেশনের বর্তমান মেয়র বলছেন এসব দোকান অবৈধ। সাবেক মেয়র বলছেন আইনগতভাবে এসব দোকানকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। সাবেক মেয়রের সময়ে দোকানগুলো যেসব কর্মকর্তার স্বাক্ষরে বৈধ হয়েছে, বর্তমান মেয়রের সময়ে সেই কর্মকর্তারাই ‘অবৈধ’ বলে সেসব দোকান উচ্ছেদ করছেন।
জানা গেছে, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ২-এর ব্লক-এ, বি ও সি-তে এবং বিভিন্ন তলায় পরিত্যক্ত গ্যাপে এক লাখ ২০ হাজার ৬৩১ দশমিক ৩৬ বর্গফুট জুড়ে ৫৫৫টি দোকান ২০১২ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ীভাবে তৎকালীন প্রশাসক খলিলুর রহমানের সময়ে প্রতি বর্গফুট জায়গা মাসিক ২০ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২৬ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়ে করপোরেশনের সার্ভেয়ার সৈয়দ রুমান ও মুহাম্মদ মুরাদ হোসেন বরাদ্দ গ্রহিতাদের কাছে দখল হস্তান্তর করেন। একই বছরের ৩১ মে সেই বরাদ্দ আদেশ বাতিল করেন পরের প্রশাসক। বিষয়টি নিয়ে তখন মার্কেট সমিতি আদালতে মামলা করে। মামলার কারণে তখন এসব দোকান উচ্ছেদ করতে পারেনি প্রশাসন। মামলাটি এখনও চলমান।
আবেদন নিষ্পত্তির জন্য আদালতের নির্দেশ
এ অবস্থায় মার্কেট কমিটির সভাপতি দোলোয়ার হোসেন দিলু ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বাতিল হওয়া সেসব দোকান থেকে ভাড়া আদায় ও ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের আবেদন করেন। আবেদনটি দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন ছিল। পরে আবেদনটি সিটি করপোরেশনকে আমলে নেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করেন তিনি। আদালত তার আবেদনটি আদেশ প্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার জন্য সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশের পর বিষয়টি সিটি করপোরেশনের সপ্তদশ ‘করপোরেশন সভায়’ উত্থাপন করা হয়। সভায় কাউন্সিলররা প্রস্তাব করেন, বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী মার্কেট বা দোকান গড়ে উঠেছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব দোকান থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করা হয়। কিন্তু আদায়কৃত অর্থ করপোরেশন তহবিলে জমা হয় না। উক্ত অস্থায়ী মার্কেট বা দোকানের ভাড়া ও ট্রেড লাইসেন্স ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে মার্কেটগুলোকে বৈধতা দিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে ভাড়া আদায় ও ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
আদালতের আদেশ ও করপোরেশনের বোর্ডসভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বিষয়টি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার অ্যাট-ল তৌফিকুর রহমানের কাছ থেকে আইনগত মতামত চান। মতামতে তিনি জানান, ‘যেহেতু ডিএসসিসি কর্তৃক বোর্ডসভায় সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটের বিষয়ে অনুমোদিত প্রস্তাব ও এ সংক্রান্ত রিট পিটিশনে প্রদত্ত আদেশের বিষয়বস্তু একই এবং অভিন্ন এবং আইনানুযায়ী বাস্তবায়নযোগ্য বলে প্রতীয়মান এবং যেহেতু এটি বাস্তবায়নে আইনি প্রতিবন্ধকতা আছে বলে নজরে আসে না; সেহেতু উক্ত আবেদন বাস্তবায়ন করা হলে তা বিচারাধীন রিট পিটিশনটির আদেশের আলোকে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে বলে মনে করি।’
তার মতে, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সরবরাহকৃত তথ্য অনুযায়ী এটা প্রতীয়মান যে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ২-এর ভুক্তভোগী দোকানদারদের দাবিও ন্যায়সঙ্গত ও ডিএসসিসি কর্তৃক গৃহীত ও অনুমোদিত সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক প্রদত্ত আদেশের কারণে আইনানুযায়ী বাস্তবায়নযোগ্য। অস্থায়ীভাবে বরাদ্দকৃত কম-বেশি ৭৮৮টি দোকানসহ অনুমতিহীন নির্মিত সকল দোকানের হালনাগাদ ভাড়া গ্রহণ ও ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের আবেদন বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলেও আমি মনে করি।’
কারিগরি কমিটি
হাইকোর্টের আদেশ, বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত ও আইনগত মতামতের পাওয়ার পর একটি কারিগরি দিক বিবেচনায় প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মার্কেটের লোক চলাচলের প্যাসেজ, বাথরুম, লিফট, সিঁড়ি এবং আলো-বাতাস ঢোকার জায়গায় যেসব দোকান তৈরি করা হয়েছে সেসব দোকান বাদ রেখে অবশিষ্ট দোকানগুলো নম্বর চিহ্নিত করে মতামত প্রদানের জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ডিএসসিসির অঞ্চল-৪-এর নির্বাহী কর্মকর্তা, সম্পত্তি কর্মকর্তা, অঞ্চল-৪-এর সহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী (বাজার সার্কেল) ও বাজার শাখার উপ-কর কর্মকর্তা। এদের সবাই এখনও ডিএসসিসিতে কর্মরত।
মার্কেটের লোক চলাচলের প্যাসেজ, বাথরুম, লিফট, সিঁড়ি এবং আলো-বাতাস ঢোকার জায়গা রেখে দোকানগুলোর নকশা প্রণয়ন করে কমিটি। তাতে দেখা যায়, ব্লক এ-এর বেইজমেন্টে ৩৫টি, নিচতলার ভেতর সাইটে ৫৫টি, বাইরের সাইটে ১২৩টি, দ্বিতীয় তলায় ৪৪টি, তৃতীয় তলায় ৩৫টি, ৪র্থ তলায় ১৬টিসহ মোট ৩০৮টি দোকান রয়েছে।
ব্লক বি-এর বেইজমেন্টে ৪২টি, নিচতলার তর সাইটে ৫৮টি, বাইরের সাইটে ১২৬টি, দ্বিতীয় তলায় ২৯টি, তৃতীয় তলায় ২৮টি, ৪র্থ তলায় ৬টি, পঞ্চম তলায় ৩টিসহ মোট ২৯২টি দোকান রয়েছে। ব্লক সি-এর বেইজমেন্টে ৫২টি, নিচতলার ভেতর সাইটে ৫৪টি, বাইরের সাইটে ১০৫টি, দ্বিতীয় তলায় ৫২টি, তৃতীয় তলায় ২৭টি, ৪র্থ তলায় ২১টিসহ মোট ৩১১টি দোকান রয়েছে। সব মিলিয়ে গত বছরের ৩১ জুলাই মার্কেটটিতে ৯১১টি দোকানের নকশা অনুমোদন দেয় এই কমিটি। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে বকেয়া ভাড়া ও ট্রেড লাইসেন্স ফি পরিশোধসহ ব্যবসা করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
৯১১টি দোকান বৈধ না অবৈধ?
আদালতের নির্দেশ ও বোর্ডসভার অনুমোদনের পরেও এসব দোকানকে অবৈধ বলছে ডিএসসিসির বর্তমান প্রশাসন। সংস্থাটির সাবেক প্রশাসন বলছে, আদালতের নির্দেশেই করপোরেশনের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সভা ‘করপোরেশন সভায়’ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা অবৈধভাবে ব্যবসা করলেও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে তাদের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
যাদের স্বাক্ষরে অনুমোদন, উচ্ছেদের নেতৃত্বে তারাই!
ডিএসসিসির যেসব কর্মকর্তা এই দোকানগুলোর অনুমোদন, নকশা প্রণয়ন বা ভাড়া আদায়ের নেতৃত্বে ছিলেন সেসব কর্মকর্তাই এখন দোকানগুলোকে অবৈধ অবহিত করে উচ্ছেদে নেমেছেন। তাদের অনেকেই বদলি হয়ে গেলেও এখনও রয়েছেন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন, সম্পত্তি কর্মকর্তা মুনিরুজ্জামান, রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ অনেকেই। এখন বর্তমান ও সাবেক প্রশাসন একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
ডিএসসিসির বাজার শাখা-২-এর উপ-কর কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান, অঞ্চল-৪-এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মাজেদ মিয়া, মার্কেট নির্মাণ সেলের সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, অঞ্চল-৪-এর সহকারী প্রকৌশলী (পুর) মো. মাহেব হোসেন, সিনিয়র সহকারী সজিব ও সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান, অঞ্চল-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলামের সাইকার সংশোধিত নকশায় এসব দোকানের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব কর্মকর্তা এখনও ডিএসসিসিতে কর্মরত। অথচ কর্তৃপক্ষ দোকানগুলোকে অবৈধ বললেও এর অনুমোদনদানকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
পথে বসেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
ডিএসসিসির বর্তমান প্রশাসনের সিদ্ধান্তে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ থেকে উচ্ছেদ হওয়া ৯১১ জন ব্যবসায়ী উচ্ছেদ হয়ে পথে বসেছেন। তাদের অভিযোগ, মার্কেট সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু এই বরাদ্দের সময় প্রত্যেক ব্যবসায়ী থেকে টাকা নিয়েছেন।
জানতে চাইলে উচ্ছেদ হওয়া ব্যবসায়ী আসাদুর রহমান বলেন, আমরা করপোরেশনকে ভাড়া দিয়েই ব্যবসা করছি। কোর্ট আমাদের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য আদেশ দিয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে বকেয়া টাকা নেওয়ার পর এখন সিটি করপোরেশন আমাদের অবৈধ বলে উচ্ছেদ করছে। আমরা এখন পথে বসে ভিক্ষা করার ছাড়া আরও কোনও উপায় দেখছি না। এই করোনাকালে আমরা কোথায় যাবো?
মো. আলম নামে অপর ব্যবসায়ী বলেছেন, সিটি করপোরেশন ফুটপাত থেকেও একজন ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ করতে হলে শতবার পুনর্বাসনের কথা বলেন। কিন্তু আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে দেওয়া হলেও এ নিয়ে কোনও কথা নেই। আমাদের পরিবার চলবে কী করে? তিনি আরও বলেন, যদি আমরা অবৈধ হয়ে থাকি তাহলে কেন আমাদের বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়েছে। কেন ৮ মাসের বকেয়াসহ ভাড়া নেওয়া হয়েছে। তাহলে আমাদের টাকা ফেরত দেওয়া হোক।
ডিএসসিসি যা বললো
অনুমোদনের পর ব্যবসায়ীদের থেকে ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করেছে ডিএসসিসি। তবে বরাদ্দপত্রের অন্যতম শর্ত ছিল করপোরেশন বা সরকারের প্রয়োজনে যেকোনও সময় জায়গার দখল ছাড়তে হবে। এ বিষয়ে কোনও মামলা কিংবা ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না। আর এই শর্তের বলেই গত ৮ ডিসেম্বর থেকে এসব দোকানিকে উচ্ছেদ করছে ডিএসসিসি।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২-এর ৯১১টির মতো মূল নকশাবহির্ভূত দোকান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু দোকান সাময়িক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। বরাদ্দের শর্তে রয়েছে, করপোরেশন চাইলে যেকোনও সময় এসব দোকান উচ্ছেদ করতে পারবে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা এখন সেসব দোকান উচ্ছেদ করছি।
ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই এসব দোকান উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এর বেশি বক্তব্য আমার নেই।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, এসব দোকান অবৈধ। যারা অবৈধভাবে দখল করে দোকান তুলেছেন তারা কাকে টাকা দিয়েছেন সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। যাদের অনুমোদন আছে তারাই এখানে ব্যবসা করবেন। আমরা সেটি নিশ্চিত করবো। পর্যায়ক্রমে আমরা সিটি করপোরেশনের সব মার্কেট থেকে অবৈধভাবে গড়ে তোলা সব দোকান উচ্ছেদ করবো।
যা বললেন সাবেক মেয়র
এদিকে এসব দোকানকে বৈধ বলছেন দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি এই উচ্ছেদ অভিযান অবৈধ বলে দাবি করছেন। খোকন বলেন, আদালতের নির্দেশ ও করপোরেশন সভার মাধ্যমে আমরা এসব দোকানকে বৈধতা দিয়েছি। এতে সিটি করপোরেশন ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভাড়া পেয়েছে। এই অর্থ করপোরেশনের তহবিলে জমা হয়েছে। আমি সাবেক মেয়র হিসেবে মনে করি, হঠাৎ করেই এভাবে উচ্ছেদ করা আইনসিদ্ধ নয়।