পশ্চিমবঙ্গ ডেস্ক: বাংলাদেশে যেমন কোটা আন্দোলন পরিণতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গড়িয়েছে তেমনি পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে কলকাতায়।
ভারতের কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ যখন শুরু হয়েছিল, তার কদিন আগেই পড়শি বাংলাদেশে ঘটে গেছে গণঅভ্যুত্থান। দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। পতন হয়েছে সরকারের।
ঢাকার ওই আন্দোলনে যেসব স্লোগান শুনেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, তারা সেসব শ্লোগান দিচ্ছেন এখন। যেমন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ!’
জনতার সঙ্গ নিয়েছে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস।
জুনিয়র ডাক্তাররা এদিন বিক্ষোভ মিছিল করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সদর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, অন্যদিকে বিজেপি নেতারা ধর্নায় বসেছিলেন আরজি কর হাসপাতালের কাছে শ্যামবাজারে।
গতকাল বুধবার বিকেলে বিজেপি একটি মিছিল করে, যেখানে অনেকটা বাংলাদেশের আন্দোলনের শ্লোগানের ধাঁচে প্ল্যাকার্ড ছিল, ‘দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও প্রাক্তনরা কলেজ স্ট্রিটে জড়ো হন। কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের বড় মিছিল যায় কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের দিকে। মিছিলকারীদের পথ রোধ করে পুলিশ। সেই ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা হলে গ্রেফতার করা হয়।
ক্রীড়া জগতের মানুষও পথে নেমেছিলেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান দিয়ে। বুধবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আরও একাধিক মিছিল-জমায়েত-প্রতিবাদ হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবাদী চিকিৎসকদের কর্মবিরতি শেষ করে কাজে ফিরতে বললেও আরজি কর মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আজ বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো ও রাজ্য সরকারের যে ‘স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ জমা দেওয়ার কথা, সেটা দেখে তারা পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করবেন।
শুধু কলকাতা নয়, শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, প্রতিবাদ হচ্ছে ভারতের অন্যান্য শহরেও। ডাক্তারদের প্রতিবাদ। অব্যাহত প্রতিবাদ।
‘বাংলাদেশ পারলে আমরা পারব না?’
কলকাতার প্রকাশক দীপায়ন ধর বলেন, ‘আরজি করের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে এখন যে আন্দোলন চলছে তা কিছুটা তো নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ছাত্রদের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তবে এখন যেভাবে আন্দোলন হচ্ছে সেটা দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’
কলকাতার প্রতিবাদীদের একাংশ বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের দুটি আন্দোলনের সব থেকে বড় মিল হল রাজনৈতিক পতাকা ছাড়া সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়া।
‘রাতের রাস্তা দখল’ কর্মসূচিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন অদিতি রায়। তার ভাষায়, ‘রাতের রাস্তা দখল কর্মসূচির একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে প্রথম এই আন্দোলন হয়েছিল। এই যে উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগান, সেটা কিন্তু ওই আন্দোলনেরই স্লোগান ছিল। কিন্তু ঠিকই, সেই ইতিহাস হয়ত অনেকেই জানেন না। তাদের একটা বড় অংশকে সেদিন রাতে পথে নামতে সম্ভবত বাংলাদেশের আন্দোলনই উজ্জীবিত করেছে।’
তিনি বলছেন, যেভাবে সাধারণ মানুষ প্রায় রোজই কোনো দলীয় পতাকা ছাড়া, দলমত নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে, তার পথ দেখিয়েছে বাংলাদেশই। তারা তো দেখিয়েছেন যে, এভাবেও সম্ভব! অনেকেই ভেবেছেন যে, বাংলাদেশ পারলে আমরা কেন পারব না?’
পুঞ্জীভূত ক্ষোভ
দীপায়ন ধরের কথায়, ‘কলকাতার একটা প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটে কর্তব্যরত অবস্থায় এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা তো মানুষকে ক্ষুব্ধ করেইছে, তবে এর বাইরেও জনমানসে একটা ক্ষোভ দানা বাঁধছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ উগরে দেওয়ার একটা জায়গা খুঁজছিলেন মানুষ। সেটাই এই ঘটনার প্রতিবাদের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশেও তো সেটাই ঘটেছে।’
শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত এবং পাকিস্তানে যে আন্দোলন হচ্ছে, সবগুলির ধাঁচ অনেকটা একরকম বলে মনে করছেন তিন-দেশের রাজনীতির ওপরেই নজর রাখা কলকাতার তথ্যচিত্রকার সৌমিত্র দস্তিদার।
তিনি বলেন, ‘তিনটি দেশের আন্দোলনের মূল সুরটা যদি দেখেন, সবই কিন্তু অচলায়তন ভাঙ্গার চেষ্টা, এবং সবক্ষেত্রেই একেবারে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন। সব জায়গাতেই এমন বহু মানুষ রাস্তায় নামছেন, যাদের একটা বড় অংশ তরুণ এবং এদের অনেকেই কোনো দিন কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে একটা স্বতঃস্ফূর্ত জন জাগরণ। কোন দল কী করবে, কী দাবি তুলবে, সেটার অপেক্ষায় মানুষ বসে থাকছে না।’
তার কথায়, ‘এইসব আন্দোলন থেকে যে সিস্টেম বদলের আওয়াজ উঠছে, রাজনৈতিক দলগুলির চেনা আখ্যানের বাইরে গিয়ে, সেটা অবশ্য দেখিয়েছে বাংলাদেশের ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলনই।’
কী বলছে তৃণমূল কংগ্রেস
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সম্প্রতি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সে দেশের আন্দোলনকারীরা সরিয়ে দিতে পেরেছে—এটা দেখে কলকাতার আন্দোলনকারীরাও উৎসাহিত হচ্ছে।’
তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিৎ মণ্ডল বলছেন, ‘বিরোধীদলগুলো যে রাজনীতি করবে এই নারকীয় ঘটনা নিয়ে, তা তো জানা কথা। কিন্তু তার বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠছে, তা আগে নজরে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘যে ঘটনার বিচার চাওয়া হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যার তদন্ত চলছে, বা গ্রেপ্তার, সবই কিন্তু মমতার সরকারের পুলিশ করেছে। সিবিআই তো তদন্তভার পেয়েছে দশ দিনের বেশি হয়ে গেল। কোনো অগ্রগতি কি তারা করতে পেরেছে? তাহলে মমতার পদত্যাগ কেন চাওয়া হবে? সিবিআই যে মন্ত্রকের অধীন, তার মাথায় যিনি বসে আছেন, সেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া উচিত।’
সাধারণ মানুষও যে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাচ্ছে তা নজরে আসছে সামাজিক মাধ্যমের নানা পোস্টে এবং চায়ের দোকানের আড্ডায়ও।