হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সহিংসতার ঘটনার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোট গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এসময় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় ৬ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে নরসিংদীর ৩, কক্সবাজারে ১ জন, চট্টগ্রামে ১ জন ও কুমিল্লায় ২ জন রয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে এসব ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এসব ইউনিয়নের মধ্যে ২৬টিতে ভোট নেয়া হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। ভোটগ্রহণ শেষে শুরু হয় গণনা। এর মধ্যে সহিংসতার জেরে তিনটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সংঘাত-সহিংসতায় রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। প্রায় দেড় কোটি ভোটারের এই ইউনিয়নগুলোতে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর পর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগও এসেছে। ইউপি নির্বাচন নিয়ে কিছু দিন ধরেই সংঘাতের বিস্তার ঘটছিল দেশে; তাতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কঠোর হওয়ার বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও প্রাণহানি ঠেকানো যায়নি। ভোট চলাকালীন ভোটকেন্দ্রে ঢুকে জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
গতকাল ভোরের দিকে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল বাঁশগাড়ীতে নির্বাচনী সহিংসতায় তিনজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন-বাঁশগাড়ি এলাকার হেকিম মিয়ার ছেলে মো. সালাহউদ্দিন, একই এলাকার জাহাঙ্গীর এবং দুলাল মিয়া। রায়পুরা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সত্যজিত কুমার ঘোষ এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, বাঁশগাড়ি ইউপিতে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন আশরাফুল হক। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মোবাইল ফোন প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাকির হোসেন।
এ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গত বুধবার সন্ধ্যায় দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সারা রাত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। ভোরে দুই পক্ষের মধ্যে আবার সংঘর্ষ হলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সালাহউদ্দিন। পরে জাহাঙ্গীর ও দুলাল মিয়ার মৃত্যু হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের তেতৈয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। ওই ওয়ার্ডের দুই মেম্বার প্রার্থী শেখ কামাল ও আবু বক্কর ছিদ্দিকের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুতু নামে শেখ কামালের এক কর্মী মারা যান। এছাড়া আহত হয়েছেন আরো ৭ জন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে দুই ইউপি মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মোহাম্মদ শফি (৫৫) নামে একজন নিহত হয়েছেন।
একই ঘটনায় আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়নের আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাহুরখলা ইউনিয়নের খিলারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সহিংসতায় দুইজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। মেম্বার প্রার্থী ও বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে এসব হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন-উপজেলার বাহুরখলা ইউনিয়নের হিরার চর গ্রামের মৃত মুদাফর আলীর পুত্র সানাউল্লাহ ডালি (৬০) ও একই উপজেলার মানিকচর ইউনিয়নের বল্লবের কান্দি গ্রামের মোবারক হোসেনের পুত্র শাওন আহমেদ (২৫)। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মেঘনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সালাউদ্দিন মোল্লা। গুলিবিদ্ধ অন্যদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এসব জেলায় প্রাণহানি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া, ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও ভোট বর্জনের খবর পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জের এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে একটি কেন্দ্রের বাইরে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ৬৯ নম্বর পশ্চিম মাসদাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ওই ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়ার অভিযোগে ফেনীর ফুলগাজীর আমজাদ হাট ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ভোট বর্জন করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ ইনু) সমর্থিত মশাল প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. সুরুজ্জামান। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ৬ নম্বর রাতইল ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রে নৌকা কেন্দ্র দখল করে প্রতীকের সমর্থকদের ব্যালট পেপারে সিল দেওয়ায় অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে জামালপুরের মেষ্টা ইউনিয়নের বুখুঞ্জা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বক্স ছিনতাইযের ঘটনায় কেন্দ্রটির ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। বুখুঞ্জা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আসাদুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ইউপি ভোটে ‘একটু ঝগড়া ঝাঁটি’ হয়েই থাকে। ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে ৭টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের খবর পাওয়া গেছে। তবে সার্বিক তথ্য এলে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে ভোটের সংঘাত নিয়ে ইসির কোনো প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে মাদারীপুরের কালকিনিতে ভোট শুরুর কিছুক্ষণ পরই আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বৃহস্পতিবার সকালে সাহেবরামপুর ইউনিয়নে আন্ডারচর এলাকায় ভোট গ্রহণ শুরুর কিছুক্ষণ পরই আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় দুই পক্ষ গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সাহেবরামপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আন্ডারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। জানতে চাইলে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সাহেবরামপুরে সংঘর্ষের পরই আমরা সেখানে যাই। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পুলিশ দুর্বল থাকায় এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে।
পরবর্তী সময়ে আমরা ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে সরিয়ে অন্য একজনকে দায়িত্ব দিই। আর অন্য যে কেন্দ্রগুলোয় ঝামেলা হয়, সেগুলোতে সমাধান হয়েছে। দেশের দশম ইউপি নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউপির তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তালিকা থেকে একটি ইউপি বাদ দেওয়া হয়। স্থগিত করা হয় সাতটি ইউপির ভোট। এছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাঁচটি ইউপির সবাই নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৮১ জন, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৭৩ জন ও সাধারণ সদস্য (মেম্বার) পদে ২০৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ইসির যুগ্ম-সচিব এসএম আসাদুজ্জামান এসব তথ্য জানান। বিনা ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। ১৮টি জেলার ২৮টি উপজেলায় এসব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এই উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে কোনো ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে এক হাজার ৩ ইউপির ভোট হবে। আর চতুর্থ ধাপে ৮৪০ ইউপিতে আগামী ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।