ঢাকায় বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার ভারতের ডিপ্লোম্যাটিক এবং সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্টের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকার। সকল প্রতিবেশী গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে নয়াদিল্লির দাপট সবচেয়ে বেশি। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন পরিস্থিতি বাংলাদেশে ভারতের জায়গা নষ্ট করছে এবং নয়াদিল্লিকে দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত হতে বাধ্য করছে।
এক্ষেত্রে দুটি বিষয় রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মধ্যে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ভারতপন্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পুনঃনির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে একটি প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্নকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। এই মার্কিন আল্টিমেটাম স্পষ্টতই স্বৈরাচারী ও দমনমূলক হাসিনা শাসনের লাগাম টেনে ধরতে এবং বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোবল বাড়াতে দেওয়া হয়েছে, যে দলটি ভারতের গুডবুকে নেই। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানপন্থী জামায়াত-ই-ইসলামী ১০বছর পর প্রথম সমাবেশ করেছে যা নির্বাচনী দৌড়ে নয়াদিল্লির জন্য অপ্রত্যাশিত নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।
হাসিনা কেন ভারতের পছন্দ সেই কারণ স্পষ্ট: নিঃসন্দেহে ২০০৯ সাল থেকে নয়াদিল্লি যা কিছু চায় তা তিনি সরবরাহ করে চলেছেন। সেটা ট্রানজিট সুবিধাই হোক, উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহীদের তাড়ানোই হোক কিংবা নূপুর শর্মা কর্তৃক নবী মুহাম্মদ এবং অমিত শাহ কর্তৃক মুসলিম বাংলাদেশিদের অপমানের প্রতিক্রিয়ায় ‘স্ট্রেইট ডিপ্লোম্যাটিক ফেইস’ বহাল রাখাই হোক। এমনকি নতুন ভারতের প্রতি আনুগত্যের লিটমাস টেস্ট হিসেবে গৌতম আদানির কাছ থেকে তিনি তাপবিদ্যুৎও কিনছেন! নয়াদিল্লি তাই হাসিনার চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদ নিশ্চিত করে তাকে পুরস্কৃত করতে চায়, যা নিঃসন্দেহে ভারতের জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে এবং অবশ্যই হাসিনার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করবে। কিন্তু এর অর্থ হবে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণকে উপেক্ষা করা যা বাংলাদেশকে এক-দলের, এক-নেতার রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
অন্যদিকে, ওয়াশিংটন বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ বিরোধীদের আবেদনকে এখন আর উপেক্ষা করছে না।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি এবং জামায়াতের উদ্ধারকারী সংকেতের জবাব দিয়েছে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশে নিজেকে জড়িয়েছে, যার অনেকটাই ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের কারচুপির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির তীব্র বিরোধিতা করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করলে যেকোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে। স্পষ্টতই, আমেরিকা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চায়। দেশটি চায় ভারতের প্রিয় আওয়ামী লীগ তার বিরোধীদের, মুক্ত সংবাদপত্র এবং সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্বদের উপর গুন্ডামি করা ও বুলডোজার চালানো থামাক।
হাসিনা সরকার এতোটাই খারাপভাবে ধাক্কা খেয়েছে যে তারা এই ভয় করছে- ওয়াশিংটন হাসিনার ছেলে, উত্তরাধিকারী এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি সজীব ওয়াজেদ জয়ের মার্কিন ভিসা প্রত্যাহার করে একটা উদাহরণ তৈরি করতে পারে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাব (আধাসামরিক বাহিনী, হাসিনা নিজ শাসনকে স্থায়ী করার জন্য যার উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল) এর কমান্ডারদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এটি সত্যিই খুব বড় একটি ধাক্কা হবে। উপরন্তু, ২০২১ এবং ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি। র্যাব কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং “গুম” কমে যাওয়া নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে মার্কিন তিরস্কারের প্রভাবের সাক্ষ্যই বহন করে।
এর বিপরীতে, ভারত তার সব ডিম হাসিনার ঝুড়িতে রেখে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোত্রা খোলাখুলিভাবে তাকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ভারত “হাসিনা এবং তার নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে”। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অতিথি হিসেবে সেপ্টেম্বরে জি-২০ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানোর পর কোত্রা ঢাকায় উক্ত বিবৃতি দেন। এর আগে জানুয়ারিতে, ভারতের সাবেক জুনিয়র পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম জে আকবরের কাছে বাংলাদেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার কিনা জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “শেখ হাসিনা সম্পর্কে ভারতে আমাদের নিজস্ব বোঝাপড়া রয়েছে। আমরা মনে করি, তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন, তার পিতা যেমন স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।”
গত মাসে ঢাকায় সমাবেশ করতে জামায়াত-ই-ইসলামিকে হাসিনা প্রশাসন কর্তৃক এগিয়ে যেতে দেওয়ার বিষয়টি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাগ্রস্ত করলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিলের হুমকির সরাসরি ফলাফল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচন্ড চাপের সুবিধাভোগী জামায়াত, পাকিস্তানের সাথে এতোটাই ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে যে নয়াদিল্লি দলটিকে সেই পুতুল হিসেবে বিবেচনা করে যার সুতা আইএসআই এর লোকজন রাওয়ালপিন্ডিতে টেনে নিয়ে যায়। দলটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা লাভে বাংলাদেশকে দাস বানানোর জন্য প্রকাশ্যে ভারতকে অভিযুক্ত করে থাকে এবং পাকিস্তানের সাথে তার আদর্শিক ও রাজনৈতিক সখ্যতা গোপন কিছু নয়। নির্বাচনের আগে মার্কিন সমর্থনে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে দলটির প্রত্যাবর্তন ভারতীয় স্বার্থে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র পর জামায়াত বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।
যদিও বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব খাটানোর জায়গা রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক সক্রিয় ভূমিকার বিষয়ে নয়াদিল্লি নীরব। উল্টোদিকে, চীন ঢাকার পক্ষ নিয়ে কটূক্তি করেছে এবং বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেছে।
হাসিনা সরকার নয়াদিল্লির কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশা করার অধিকারী হলেও সেগুলো বাস্তবসম্মত নয়। সম্প্রতি জানুয়ারিতে, কঠিন এক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে ভারতীয় প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বরফ গলাতে কোনো কাজে লাগে নি। বাংলাদেশের রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জাম বহনকারী একটি রাশিয়ান জাহাজ মোংলা বন্দরের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু, মার্কিন কর্তৃপক্ষ ঢাকাকে জানায় যে জাহাজটি নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত হওয়ায় এটিকে ভিড়তে দেওয়া উচিত নয়।
ঢাকা দ্রুত ‘বড় ভাই’ ভারতের সহায়তা চায়। জাহাজটিকে হলদিয়ার দিকে ঘুরিয়ে বার্থ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি ঘোষণা করেছিলেন যে “জাহাজটি ভারতে এলে কোনও সমস্যা হবে না”। স্পষ্টতই, মোদি সরকার ঢাকাকে বাধ্য করতে চেয়েছিল মালামালগুলো হলদিয়ায় অফলোড করে সড়কপথে রূপপুরে প্রেরণ করতে। কিন্তু ওয়াশিংটন শক্ত অবস্থান নিলে ভারতকে পিছিয়ে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত, ওই জাহাজটি হলদিয়ায় মালামাল না রেখেই রাশিয়ায় ফিরে যায়। এই গল্প থেকে শিক্ষনীয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বাস করে। এমনকি ভারতের মতো মিত্রদেরও এই বিষয়টি মানতে শিখতে হবে সেটা তারা পছন্দ করুক বা না করুক।
[ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট এস এন এম আবদির লেখাটি দেশটির ইংরেজি ভাষার দৈনিক পত্রিকা ফ্রি প্রেস জার্নালে গত ১০ জুলাই ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]