।। মোস্তফা তারিকুল আহসান ।।
লোকসংগীত লোকজ সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় আধার; মৌখিক সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে নিঃসন্দেহে লোকসংগীত জনজীবনের সার্বিক চরিত্র ধারণ করে। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিকাশে লোকসংগীতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সাধারণ পেশাজীবি বা গোষ্ঠীগত মানুষ তাদের সহজ জীবনভাবনা সহসা সচকিতভাবে গান আকারে পরিবেশন করলে তাকে আমরা লোকসংগীত বলি। তবে দৃশ্যত লোকসংগীতকে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ এর গায়কি বা সুর দিয়েই শুধু জাত বিচার করা সম্ভব নয়। এর নেপথ্যে থাকে একজন ব্যক্তির বা সম্প্রদায়ের বা জাতির দীর্ঘকালীন জীবনযাপন, জীবনধারা ও বিশ্বাস-বোধের ইতিহাস যা তার সংস্কৃতির মৌল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এর সঙ্গে আরো জড়িয়ে থাকে আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক রূপভেদ এবং এই বৈশিষ্ট্যই তাকে অন্য লোকসংগীত থেকে আলাদা করে।
সে-কারণে লোকসংগীত হলো কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের লোকসমাজের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। লোকসমাজের মানুষের আচার আচরণ ও মনোভাবের পরিস্ফূটন ঘটে লোকসংগীতে। তাই অঞ্চলগতভাবে একেক অঞ্চলের মানসিকতা লোক সংগীতাঞ্চলের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব, আঞ্চলিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক তথ্যাবলী পরিপূরণে এ জাতীয় কাজ করা জরুরি। তবু ফোকলোরবীদের দৃষ্টিকোণ থেকে লোকসংগীতের সঠিক তাৎপর্য এতে খুবি বেশি স্পষ্ট হয় না।
আমেরিকান গবেষক ব্রান্ডভ্যান্ড বলেছেন, folksongs consist of words and music that circulate orally in traditional variants among members of a particular group. Like other kinds of oral traditions, folksongs have come from several soureces, have appeared in many different media, and have sometimes been lifted out of folk circulation for various professional or artistic uses. But all of those that qualify as true folksongs have variants found in oral transmission. (Brunvand, 1968)|
লোককবি ও গায়কেরা যে গান রচনা করেন ও পরিবেশন করেন তা শুধু শ্রোতার মনোরঞ্জনের জন্য করা হয় না বরং এক ধরনের দার্শনিক প্রজ্ঞা তারা প্রচার করতে চান যা ঐতিহ্যবাহী প্রচল ধারণার সঙ্গে কখনো কখনো মেলে, কখনো মেলে না। শ্রোতারা গানের ভাবার্থ সবসময় বোঝে না, তবে না বুঝলেও গানের গায়কি ও পরিবেশনা তাদের মুগ্ধ করে। ফোকলোরে প্রতিটি উপাদানের ক্ষেত্রে এই পরিবেশনা খুব জরুরি।
লোকসংগীত বা লোকগান সাধারণ মানুষের সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত এবং এর সঙ্গে অন্বিষ্ট থাকে সেই জনপদের জীবনধারা সংস্কৃতি লোকদর্শন ও সামগ্রিক আচার আচরণের নির্যাস। সংগীত ও গানের মধ্যে যে গঠনগত পার্থক্য আছে লোকসংগীত ও লোকগানের মধ্যে তা আরো কম। ফোকলোরের ফর্ম বা জনরা বিবেচনা করলে লোকসংগীতের কাঠামো কয়েকটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে সমন্বিত করে। একজন লোককবি বা গায়ক নিজেই তার গানে সুরারোপ করেন, যন্ত্রসংগত করেন, আর এ লোকগানের সঙ্গে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষ; তারাই তার মূল ভোক্তা। যে সহজ জীবনবোধ নিয়ে লোকগান তৈরি হয় তা যে সামষ্টিক জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত তা আলাদা করে না বললেও চলে। একজন চারণ কবি লোকগানের স্রষ্টা যিনি তার সময়ের জনমানস গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেন।
বৃহৎ বাংলার লোকগানের যে বৈভব ও বৈচিত্র্য তা এ অঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে সনাক্ত করে খুব গভীরভাবে। একইসঙ্গে এসব গানের মধ্যে বাঙালির মৌলিক চিন্তাধারার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। শাশ্বত বাঙালির যাপিত জীবনজাত বিশ্বাস বোধ দর্শনের একটা সংহত প্রকাশ আমরা বাংলা গানে পাই। বিহার থেকে শুরু করে উত্তর বঙ্গ, আসাম বর্তমান বাংলাদেশ বিবেচনায় আনলে আমরা লক্ষ্য করবো আমাদের সামগ্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ যার প্রধান অঙ্গ মানবতা ও মানবিকতা তা বাংলা গানে গভীরভাবে সংযুক্ত। জাতপাতহীন অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাঙালি হওয়ার শিক্ষা আমরা বাংলার লোকসংগীতে পেয়ে যাই সহজভাবে। বলা সঙ্গত যে, বাঙালি সত্তার মূল বৈশিষ্ট্য আমরা লোকগানে পাই। অজস্র প্রকার মানুষ, তাদের পেশা ও দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে আমরা লোকগানের বিচিত্রপথের সন্ধান পাই। সাধারণ মানুষের চিন্তাবিভূতি ধর্মবোধ লোকজ্ঞান নিয়ে এক লোকদর্শন বা লোকসভ্যতার সংহত রূপ আমরা পাই এ গানের মাধ্যমে। একইসঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতির মূল সোপানও এই গান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমেরিকা ও ইউরোপে এথনোমিউজিলোজিকাল এপ্রোচ নিয়ে যে গবেষণা চলে সেটি আমাদের এখানে চালু করতে পারলে আমাদের লোকসংগীতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সবার কাজে প্রতিভাত হতো যেখানে সংস্কৃতি ধর্ম জীবনধারার ব্যাখ্যায় লোকসংগীতকে কেন্দ্রে রাখা হয়।
মূলত এ অঞ্চলের মানুষের পেশা ও জীবিকার নানা ধরন ও প্রকরণ প্রতিফলিত হয় বাংলার লোকগানে। মূলত জীবন ও জীবিকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা অনুষঙ্গ এবং সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ হাসি কান্না প্রেম বিরহ লোকগানের মূল বিষয় হলেও এক গভীর জীবনাকাক্সক্ষার সহযোগে লোকদর্শনের যোগ এখানে লক্ষ্য করা যায়। লোকগান একক পরিবেশনা হিসেবে সবসময় বিবেচনা করা যায় না; অনেকসময় এর সঙ্গে যুক্ত থাকে লোকনৃত্য ও লোকনাটক। বাংলার জনপদে আধুনিক নাগরিক বিনোদনের ব্যাপক প্রসার হওয়ার আগে লোকগানের যে বিস্তার ছিল সেটি এখন নেই, তবে এখনো লোকগান সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে আছে। বাংলার লোকগানের সুর গায়কি বিষয় বিবেচনা করলে লোকগানের মৌলিকত্ব ও বৈচিত্র্য নিয়ে গভীরভাবে নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
বাংলা লোকগানের ভাবশক্তি এবং এর সুরের বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্য নিয়ে ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়; আমাদের এই জনপদের সাধারণ মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনাভিজ্ঞতা দিয়ে যে অসাধারণ গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন, যা আমাদের হৃদয়ের গহীনে স্থান করে নিয়েছে তার মাহাত্ম্য সত্যি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ তাদের দর্শনজাত অভিজ্ঞতাকে একজন প্রকৃত কবির মতো বাণীবদ্ধ করে চলেছেন। কী অসীম তাদের শক্তি, কী অসীম তাদের সম্ভাবনা এবং সাধারণ মানুষ বলেই তারা আমাদের মাটির সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে চিনতে পেরেছিলেন, জানতে পেরেছিলেন তাদের আকাক্ষার স্বরূপ। প্রকৃতির মতো সহজ সরল তাদের গানের মর্মবস্তুও সহজ এবং মানুষই আছে তাদের সকল ধ্যান-ধারণার মর্মমূলে। ভারতীয় জীবনধারার সহজ লোকায়ত বৈশিষ্ট্য তারা প্রজন্ম পরম্পরায় পেয়ে গেছেন আর তা বিনিময় করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। সমাজের অনিয়ম, অসমতা, বর্ণবিভাজন, ধর্মীয় বিভেদ, শাস্ত্রীয় ধর্মের কঠোর নিয়মনীতি এসব লোককবিকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। নানা পেশার বর্ণের মানুষের, সমাজ-সংস্কৃতির বহু প্রসঙ্গে কিংবা আচারে হাজারো রকম গানের সৃষ্টি হয়েছে এই বাংলায়।
তবে শ্রমজীবি মানুষ বা পেশাজীবি মানুষ তাদের প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে যে গান তৈরি করে তার সুর ও গায়কী সাধারণ হলেও তা হৃদয়ে মিশে যায়। জন্ম মৃত্য শোক বা যে কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে গান তো বাধা হয়, তবে প্রাকৃতিক নানা বিষয় নিয়েও গান বাধা হয়। আমরা ধারণা করতে পারব না যে, গ্রামের মেয়েরা তাদের সন্তান স্বামি বা নিজের বিরহ বা পরকীয়া বিষয় নিয়েও অসাধারণ সব গান তৈরি করেছেন। এই শক্তি তাদের স্বভাবজাত। সংগীত শাস্ত্রকারেরা এই গানের তাল লয় সুর নিয়ে একটু নাসিকা কুঞ্চিত করতে পারেন, তাতে এসব গানের রচয়িতা বা ভোক্তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ তারা নিজেকে শিল্পি বলে দাবিও করেন না। তাদের গান কীভাবে প্রচার হচ্ছে, কারা শুনছে, কারা এসব নিয়ে গবেষণা করছে তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। এই হলো সত্যিকার লোকসংগীতের মূল প্রবণতা। গ্রামের মেয়েরা নানা কাজের সময় গান গেয়ে থাকে। নিজের তৈরি নিজের সুর করা গান। কৃষিজীবি মেয়েরা কৃষিকাজ বা গৃহের কাজের সময় গান করেন, কখনো এককভাবে, কখনো সমবেতভাবে। সন্তানকে গর্ব করে যেমন মা গান বাঁধেন, আবার সন্তান মারা গেলেও বিরহিনী মা গান বাঁধেন। বিয়ের সময় গান গাওয়ার যে রীতি সে তো অভাবনীয়! এমনকি হলুদ কোটার সময়ও মেয়েরা গান করেন। এখন একটু কম দেখা যায়, তবে নাগরিক সভ্যতা সবটা গ্রাস করতে পারেনি। পাবনা অঞ্চলের একজন রমণী হলুদ কোটার সময় এই গান গাইছেন:
‘হোলদী কোটা জামাই মোটা
আর হোলদী কোটপো না
মেয়া বিয়্যা দেবো না
মেয়া আমার সুন্দরী
জামাইয়ের মুহে চাপদাড়ী
গাছের পর বাওইয়ের বাসা
মেয়ার বাপের বড় আশা
মেয়া দিব সাজাইয়া
টাকা দিব বাজাইয়া
এত যুতি রাজী অও
আতে আতে কবুল কও।’
কি সহজ সরল কথা অথচ সাধারণ একজন মায়ের ভেতরের কথকতা বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছ নদীর ধারার মতো। আমরা জানি এভাবে একজন মাঝি গান গায়: ‘ও নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে…।’
বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে এভাবে রয়েছে হাজার রকমের গান। গবেষকদের ধারণা বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার প্রকারের লোকসংগীত রয়েছে। উত্তরবঙ্গের লোকসংগীত ভাওয়াইয়া, ভাটি অঞ্চলের ভাটিয়ালি আমাদের প্রাণের গান। লোকগানের আরেক বড় কেন্দ্র হলো ময়মনসিংহ অঞ্চল। মৈমনসিংহ গীতিকার জন্মভূমি নেত্রকোনার কেন্দুয়া। সেখানে পরবর্তীকালে বিখ্যাত লোককবি উকিল মুনশি ও জালাল খাঁর জন্ম। কোন উপলক্ষে এখানে গানের জন্ম হয় তা ভাবতে অবাক লাগে! একজন চোর যখন চুরি করতে যায় তখন সেও বধূর সাথে গানে মত্ত হয়। তার একটা অর্থ আমরা সহজে অনুমান করতে পারি, এই বাংলা শুধু নদীর দেশ নয়, গানেরও দেশ, লোকগানের দেশ। আব্বাস উদ্দীন গেয়েছিলেন: ‘ওকি একবার আসিয়া, সোনার চান মোর যাও দেখিয়া রে…।’ সেই গান আজো সবার মুখে মুখে ফেরে, নতুন প্রজন্ম সেই গান গেয়ে বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছে দিচ্ছে। আমাদের কৃষক মাঝি মাল্লার থেকে শুরু সকল পেশার মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হয় আমাদের লোকজ ধারার গান।
লোককবিরা আমাদের সমাজের নানা ছবি বর্ণনা করেছেন গানে। তা করতে গিয়ে গানের চরিত্রের সাথে নাটক ও নৃত্য যুক্ত করেছেন অনেক সময়। বিচিত্রভাবে প্রকাশিত বাংলা লোকসংগীত নিয়ে, তার সামগ্রিক রূপবৈচিত্র্য নিয়ে ফোকলোর গবেষকেরা যে কাজ করেছেন তা অনেকটা হতাশাব্যঞ্জক। কারণ লোকগানের পরিবেশ-প্রেক্ষিত, গঠন, সুরবৈচিত্র্য এবং এর নেপথ্যসংযোগ নিয়ে কেউ বেশি ভাবেননি। এমনকি আমাদের অজস্র সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যার গভীরে কী কী প্রপঞ্চ যুক্ত, তার সমাধান যে অনেক ক্ষেত্রে লোককবিরা তাদের গানে বলেছেন, তা আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। আমাদের জাতীয়তা, ধর্মীয় শঠতা, সাম্প্রদায়িক সমস্যা এগুলো থেকে মুক্তির উপায়ও আমরা পেতে পারি তাদের এসব গানের মধ্য থেকে।
বাংলায় ধর্ম বিস্তারের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শাস্ত্রীয় ধর্ম ধীরে ধীরে লোকায়ত ধর্মের স্রোতে এসে মিশেছে। শাস্ত্রীয় ধর্মের কট্টরপন্থী নীতির কারণে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে মূল ধারা থেকে সরে এসেছে। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্রও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম প্রতিটি ধর্ম এ দেশের সংস্কৃতিকে আত্মীকরণ করে লোকায়ত ধারার সাথে মিশে গেছে। বাউলরা বৈষ্ণব সুফিবাদের তত্ত্ব গ্রহণ করে নিজেদের মতো একটি মতবাদ তৈরি করেছে। বাউলরা যেমন মানবতাবাদী, তেমনি অসাম্প্রদায়িক। এই চেতনা বাংলার প্রায় সব লোকগানে রয়েছে। যদিও বাংলা লোকগানে আঞ্চলিক জীবনের নানা বৈচিত্র্য, রসসঞ্চার গভীরভাবে প্রোথিত। অন্যদিকে বাউলও এক প্রকার ধর্মীয় সঙ্গীত তবে এ ধর্ম হলো মানবধর্ম, প্রচলিত ধর্ম নয়। স্বাভাবিকভাবে ধর্মীয় তত্ত্ব নিয়ে গান গাইলে তা সাধারণত গান হিসেবে কারো পছন্দ হওয়ার কথা নয়।
মানবতা যে বাংলা লোকগানের বড় বিষয় সেটা আলাদা করে না বললেও চলে। বাংলার লোককবিরা বেশির ভাগই কোনো না কোনো লোকধর্মের অনুসারি এবং তাদের নিজস্ব সেই লোকধর্মের মূলতত্ত্ব প্রচার করতে তারা গানের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। সে হিসেবে একে ধর্মসংগীতও বলা হয়। তবে বাংলার লোকসংগীত এই তত্ত্বকে নিয়েও গানের যে মহিমা প্রকাশ করে তা সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে প্রবলভাবে যদিও বেশিরভাগ শ্রোতা গানের তত্ত্ব বোঝেন না। ধর্মসংগীতকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়: একটি হলো আচারমূলক ধর্মসংগীত, অন্যটি হলো লৌকিক ধর্মসংগীত। গুরুশিষ্য পরম্পরায় যে সংগীত নিজস্ব সাম্প্রদায়িক সীমার মধ্যে থেকে গান তৈরি করে বা প্রচার করে তাকে বলা হয় আচারমূলক ধর্মসংগীত। আর যা গুরুশিষ্য বা সম্প্রদায় নিরপেক্ষ থেকে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করে তাকে লৌকিক ধারার গান বলা হয়। বাউল গানে এই দুই ধারা বিদ্যমান। অর্থাৎ শিষ্য না হয়েও, তার আচারমূলক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ না করেও বাউল আঙ্গিকের গানে কেউ আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। বাণী তাকে কম স্পর্শ করে, তবে সুর তাকে নিয়ে যায় গভীরে।
মানবতা বাউল গানের প্রধান অঙ্গ। পরকাল নয় ইহকালই তাদের কাছে যেমন বড়, তেমন ঈশ্বরের চেয়েও তারা মানুষকে বড় করে দেখেছেন। তাদের যে দেহকেন্দ্রিক সাধনা তার মূলে রয়েছে মানবকে বড় করে দেখা। বাউলরা মনে করে মানবের মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের অবস্থান। মানব দেহের মধ্যে আত্মারূপী এই ঈশ্বরের উপলব্ধি এবং তার নিয়ত সান্নিধ্য সুখের অনুভূতি বাউল সাধকের প্রধান লক্ষ্য। আত্মারূপী এই ঈশ্বরকে সহজ কথায় ‘মনের মানুষ’ বলা হয়। সে-কারণে মানবকে সেবা করলে ঈশ্বরকে সেবা করা হয়। মহাত্মা ফকির লালন বলেছেন: ‘এমন মানব জনম আর কি হবে,/ মন যা কর ত্বরায় করো এই ভবে/ অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের তুল্য কিছু নাই…’
জালাল খাঁ বলেছেন: ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ/ এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে?/ মানুষ ভজ কোরান খোঁজ /পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে…।’
এই মানবতাবাদের স্বরূপ যদিও আপাতভাবে একটু ভিন্ন মনে হতে পারে, তবে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে বাউলের মানবপ্রীতির মধ্যে কোনো খাদ নেই। তারা মানুষকে মর্যাদা দিয়েছে, মানবজীবনকে গুরুত্ব দিয়েছে গভীরভাবে। তাদের সাধনা আত্মকেন্দ্রিক মনে হতে পারে, তবে প্রকৃতপক্ষে তারা মানবতার জয় গান গেয়েছেন। বাংলার এক প্রাচীন লোককবি গেয়েছিলেন: ‘নানান বরণ গাভীরে তার একই বরণ দুধ/ জগত ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’ এই গানে একই সঙ্গে মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
বাংলা লোকগানের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ। এই বঙ্গ ভূ-খণ্ডের মানুষ কখনো সাম্প্রদায়িক ছিল না। প্রাচীনকাল থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সব ধর্মের লোক একসাথে বাস করেছে ভাই ভাই হিসেবে। আমাদের জাতিগত চরিত্রে সাম্প্রদায়িকতা নেই। সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ সবচেয়ে বেশি সামাজিক ও অসম্প্রদায়িক। এমনকি ধর্মপরিবর্তনের সময়ও খুব স্বাভাবিকভাবে তা সম্পন্ন হয়েছে। প্রবল প্রতাপের ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা মুসলিম ধর্মের কিছু অত্যাচার বাংলায় লক্ষ্য করা গেছে সত্য, তবে তার থেকে বড় সত্য সাধারণ মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। বিশেষভাবে প্রতিবাদ এসেছে লোককবিদের গানের মধ্য দিয়ে। বাংলা লোকগানের প্রায় প্রতিটি কবি এই চেতনার কথা বলেছেন। বাউল কবিদের মধ্যে এই চেতনা গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। তার কারণ সমাজের অত্যাচারি মোল্লা মাওলানাদের বিরূপ নজরে পড়েছিলেন বাউলেরা। তারা জানতেন জাত পাত ধর্ম মানুষকে অন্য মানুষ থেকে পৃথক করে দেয়। লালন সাঁই থেকে শুরু করে পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, হাছন রাজা, রাধারমন, করিম শাহ, বিজয় সরকার প্রমূখ লোককবিরা তাদের গানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেছেন অজস্রবার। লালন এ ক্ষেত্রে সবার অনুকরণীয় হতে পারে। লালন গেয়েছেন: ‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা…।’
লালনের এই মর্মবাণী বুঝতে কষ্ট হয় না। জাতের নামে মানুষের মধ্যে যে বিভেদ সেই বিভেদই মানব সন্তানের প্রধান সমস্যা। সেজন্য লালনের শিষ্যরাও জাত-পাতের ওপর তীব্র আঘাত করেছেন। লালন সেই সমাজ দেখতে চান যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একাসনের মানুষ হবে। এ কারণেই তিনি বলেন: ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে?/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে।’
পাঞ্জু শাহ জাত নিয়ে বেশ রাগত স্বরে গেয়েছেন: ‘জেতের বড়াই কি?/ ইহকাল পরকালে জেতে করে কি।/ আমার মন বলে অগ্নি জ্বেলে দিই জেতের মুখি,/ এক জেতের বোঝা লয়ে/ চিরকাল কাটালাম মানি মানুষ হয়ে/ মানের গৌরব, কুলের গৌরব/ ধন্ধবাজি সব দেখি। হিন্দু মুসলমানের বোঝা মাথায় করে রয়,/ কার বা জাতে কেবা দেখে ঘরে এলে চিহ্ন কি?’
বাউলের এই কথায় স্পষ্টত সব ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য বাউলেরা প্রচলিত ধর্মবোধে বিশ্বাসী নন, তবে শাস্ত্রীয় ধর্মের অত্যাচারে তিষ্ট হয়ে এ রকম মন্তব্য করেছেন। লালনের আরেক শিষ্য দুদ্দু শাহ জাত-পাত নিয়ে তাঁর গানে বলেছেন: ‘আগে মানুষ পরে ধর্ম জাতির নির্ণয়।/ ধর্ম জাতি আগে হলে শিশু-বালক কেনা জানতে পায়।/ দর্শন শ্রবণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার গুণ।/ দেখে শিশু হিন্দু যবন আর খ্রিষ্টানে/ বিচার আচার হিংসা-ঘৃণা উদয় হয় মনে,/ এসব জন্মগত নয়…।’
দুদ্দু শাহর এই যুক্তি হয়তো খাঁটি, তবে তা ধার্মিকেরা মানবেন না। মানলে জগতে মানুষের মধ্যে ভেদরেখা থাকতো না। একজন মানুষ অন্যজনের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠতো না, মারতে উদ্যত হতো না, বা হত্যা করতো না।
যে মানবতার গান গেয়েছেন বাংলার লোককবিরা, কখনো তারা পরোক্ষে বলেছেন, বলেছেন সাধনপন্থার রূপকে, তবু সাধারণভাবে স্পষ্ট করেও তারা বলেছেন মানবতার কথা, মানবমুক্তির কথা, জাত-পাতহীন এক অসাম্প্রদায়িক মানবসমাজের কথা। এই বাংলাকে সত্যিকার অর্থে তারা ভালোবেসেছেন, ভালোবেসেছেন বাংলার মানুষকে। তাদের হৃদয়নিষিক্ত গানের বাণী আজ আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য খুব জরুরি। তাদের গানের বাণী বুকে করে আমরা গৌরবময় বাঙালি জাতি হিসেবে সত্যিকার অর্থে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি। বাংলার অজস্র প্রকার লোকসংগীতকে গুরুত্ব দিয়ে এর তাৎপর্য ধারণ করলে আমরা বাংলার চিরায়ত রূপ চিনতে পারবো। সাধারণ মানুষ তাদের সরল চিন্তা নিয়ে যে মানবতার অসমতার গান গেয়েছেন সেটা আমাদের অন্যতম সম্পদ। এই সম্পদকে জাতির মননে নিষিক্ত করতে পারলে আমরা সত্যিকার অর্থে বাঙালি ও মানুষ হতে পারবো।