কমিউনিটি নিউজ ডেস্ক: আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষার স্বীকৃতি অনেক আগেই পাওয়া গেছে। এবার বাংলা ভাষার পালকে আরও একটি নতুন পালক যুক্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ব্যস্ততম পাতাল রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে অন্যতম পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত হোয়াইটচ্যাপেল রেলওয়ে স্টেশন। সম্প্রতি এ রেলওয়ে স্টেশনের নাম বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ব্যস্ততম হোয়াইটচ্যাপেল রেলওয়ে স্টেশনটির নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় দেখা যাচ্ছে। স্টেশনের একাধিক প্রবেশদ্বারে বাংলা বর্ণমালায় ‘হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশন’ লেখার পাশাপাশি প্রবেশ পথে ‘হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনে আপনাকে স্বাগত’ লেখা শোভা পাচ্ছে। ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন ও স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় স্টেশনটির নাম বাংলায় লেখা হয়েছে।
১৮৭৬ সালে হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনটি নির্মিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে ইস্ট লন্ডন রেলওয়ে (ইএলআর, এখন ইস্ট লন্ডন লাইন) ওয়াপিং থেকে লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশন পর্যন্ত উত্তরে প্রসারিত হয়েছিল। ২০০৭ ইং সাল থেকে ২০১০ ইং সাল পর্যন্ত স্টেশনের নিম্ন অংশটি পুনঃনির্মাণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন পূর্বের পূর্ব লন্ডন লাইনটিকে রূপান্তরিত করা এবং লন্ডন ওভারগ্রাউন্ড পরিষেবার জন্য স্টেশনটিকে প্রস্তুত করা হচ্ছিলো। একইসাথে হিথ্রো বিমান বন্দরের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনে চালু হতে যাওয়া কুইন এলিজাবেথ লাইনের সংযোগ থাকার কথাও বলা হয়েছিল। এর পেছনে প্রাথমিকভাবে ১১০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচের কথা অনুমান করা হয়েছিল। অর্থাৎ ক্রসরেলের জন্য স্টেশনটি সম্প্রসারণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। সেই পরিকল্পনামত স্টেশনের সংস্কার কাজ চলছিল। সংস্কার কাজ চলার সময়েই প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে এই পুনর্নির্মিত স্টেশনের নাম বাংলায় রাখার দাবি ওঠেছিল। সংস্কার কাজের কিছুটা অগ্রগতি হলে ২০১৬ ইং সালের জানুয়ারি মাসে স্টেশনের একেবারে শেষ প্রান্তে একটি অস্থায়ী প্রবেশদ্বার খোলা হয়েছিল। শুধু প্রবেশদ্বার নয়, পুরনো স্টেশন প্ল্যাটফর্মগুলিও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। সংস্কার কাজের আরও কিছু অগ্রগতি হলে ২০২১ সালের ২৩শে আগস্ট সেই অস্থায়ী প্রবেশদ্বারটি বন্ধ করে পুনর্গঠিত মূল প্রবেশদ্বারটি পুনরায় খোলা হয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারীর আগে প্রতিদিন প্রায় ৫৪ হাজার যাত্রী এই পথে যাতায়াত করতেন। স্টেশনটির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনও এলিজাবেথ লাইনটি খোলার বাকি আছে এবং ওভারগ্রাউণ্ড প্ল্যাটফর্মগুলিতেও কিছু কাজ চলছে। পুরো কাজ শেষ হতে ৮৩১ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই বসন্তে এলিজাবেথ লাইন খুলে গেলে এবং ক্রসরেল পরিষেবাগুলি পরিবেশিত হলে প্রতিদিন বাঙালি ছাড়াও ভিন্ন ভাষাভাষী ও জাতিসত্তার যাত্রী সংখ্যা ৯৫০০০ এ উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের ব্যস্ততম এই স্টেশনের নাম বাংলা ভাষায় হওয়ায় বাঙালি ও বাংলা ভাষার সম্মানে আরও একটি মাত্রা যোগ হলো। বহু ভাষাভাষীর এই দেশে বাংলা ভাষা পরিচিতি পেলো একটি উন্নত বহুজাতিক পরিমণ্ডলে। এই বর্ণ যারা পড়তে পারেন না, তাদের কাছেও এখন দ্রুত এই ভাষা, এই ভাষার মানুষ ও তাদের শক্তি এবং সামর্থ্যের কথা পৌঁছে যাবে। স্টেশনে লেখা বাংলা বর্ণগুলো যুগ যুগ ধরে বাংলা ও বাঙালির শক্তি ও সামর্থ্যের জানান দেবে। নতুন প্রজন্ম বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হবে।
যেভাবে বাংলায় নামকরণ হলো ‘হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশন’
পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সব’চে ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যস্ততম হোয়াইটচ্যাপেল এলাকাকে বলা হয় যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষা এবং বাঙালিদের আঁতুড় ঘর। এই হোয়াইটচ্যাপেলেই বাঙালিদের প্রাণের বাংলা টাউন। এই হোয়াইটচ্যাপেলেই বাঙালিদের জাগো নারী সেন্টার, ইস্ট লন্ডন মসজিদ,পাশেই আলতাব আলী পার্ক, পার্কে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গৌরবের শহীদ মিনার। তার পরেই যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের রাজধানীখ্যাত ব্রিকলেইন, ব্রিকলেইন মসজিদ, কবি নজরুল সেন্টার। আশেপাশের বেশিরভাগ দোকানপাটের মালিক বাঙালি, দোকানের নামও বাংলা, পরিস্কার বাংলা হরফে লেখা। পূর্ব লন্ডনে বাঙালিদের ‘আদি ঠিকানা’ হোয়াইটচ্যাপেল যেনো প্রবাসে এক টুকরো বাংলাদেশ। সেই গৌরবগাঁথার অংশ হিসেবেই প্রবাসী সচেতন বাঙালি সমাজ বিশেষ করে স্থানীয় সাংবাদিক, কাউন্সিলর, সলিটরস, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে এই স্টেশনটির নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখার দাবী ওঠেছিল। স্টেশনটির সংস্কার কাজ চলার সময়েই বাংলা হরফে নাম লেখার বিষয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে ক্যাম্পেইন করছিলেন। ২০২১ সালের ২৩শে আগস্ট পুনর্গঠিত মূল প্রবেশদ্বারটি খুলে দেওয়া হলে ১৭ই ডিসেম্বর স্থানীয় সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহর শ্বশুর শ্যাডওয়েলের বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী এই দাবি জানিয়ে লন্ডন মেয়র, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল মেয়র, স্থানীয় এমপি ও ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন (টিএফএল) অথরিটি বরাবর লিখিত আবেদন করেছিলেন। স্থানীয় প্রবাসী বাঙালিদের দীর্ঘদিনের দাবি ও তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় স্টেশনের নাম লেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনের নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল এর সমুদয় খরচ বহন করেন।
এ বিষয়ে কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘একই আবেদনে আমার শ্বশুর শ্যাডওয়েলের কেবল স্ট্রিটের একটি বাসস্টপে বসার বেঞ্চ ও যাত্রী ছাউনির অনুরোধও করেছিলেন। তাঁর সেই অনুরোধও রাখা হবে বলে এক চিঠিতে জানিয়েছে টিএফএল।’ তিনি লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সেই চিঠির একটি কপি প্রদর্শন করেন, এবং এর সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সকল প্রবাসী বাঙালিদের তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রতিক্রিয়ায় লিখিত আবেদনকারী আবদুল কাইয়ূম চৌধুরী বলেন, ‘অনেক আগে থেকে ভারতীয় অধ্যুষিত সাউথহল স্টেশনের নামটি হিন্দিতে লেখা আছে, যা দেখে আমার মনে হতো, কেন বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় স্টেশনের নাম বাংলায় থাকবে না। সে কারণেই আমি চিঠি লিখেছিলাম।’
পূর্ব লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ায় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জন বিগস লন্ডন মেয়র, সকল কাউন্সিলর ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।