।। মাহফুজুর রহমান ।।
কথায় আছে প্রদীপের নিচেই নাকি অন্ধকার থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো গোটা বিদ্যুতের সেক্টরটাই অন্ধকার। বিদ্যুতের যে সাময়িক ঝলকানি দেখছেন তা নিকশ কালো অন্ধকার হয়ে গ্রাস করছে দেশের সম্পদ। লুট করা হচ্ছে লক্ষ কোটি টাকা।
বর্তমান সরকারের ১৪ বছরে মেয়োদে গ্রাহক পর্যায়ে এ পর্যন্ত ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এছাড়া পাইকারি র্পযায়ে বাড়ানো হয়েছে ১২ বার। ২০০৬ সালে প্রাহক পর্যায়ে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকরীদের ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ বিল দিতে হতো ৩ টাকা। আর বর্তমানে ২০২৩ সালে এসে গ্রাহক পর্যায়ে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকরীদের ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা। দ্বিগুনেরও বেশী। অবশ্য জনগণের পকেট কাটার জন্য অনেক ধাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৬০০ ইউনিটের উপরে ব্যবহারকরীদের গুনতে হবে ইউনিটপ্রতি ১৩ টাকা ২৬ পয়সা করে।
ভাবছেন বিদ্যুৎ তো পচ্ছি। কিন্তু ভোজবাজির মতো এই আলোর ঝলকানি নিভে যেতে সময় লাগবেনা। যা ইতিমধ্যেই টের পতে শুরু করেছে দেশের জনগণ। ভোজবাজি দেখিয়ে জনগনের পয়সা লুটে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ লুটেরা চক্র। এই সরকার ক্ষমতায় বসার পর বিদ্যুতের স্থায়ী সমাধানের পথে না হেটে বেসরকারী খাত থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। আর কেপাসিটি চার্জের নামে কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এটি ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া নামে পরচিতি। বাংলাদেশ বদ্যিুৎ উন্নয়ন র্বোড (পিডিবি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
কোম্পানীগুলোর সঙ্গে সরকারের করা ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী, সক্ষমতার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন বা কেনা না হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট হারে অর্থ (ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধ করতে হবে। এই ৯০ হাজার কোটি টাকা সেই অর্থ, যা কোম্পানীগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই পেয়েছে। শুধু তাই নয় কুইক রেন্টালের নামে কুইক পয়সা কামানোর বিরুদ্ধে যাতে কনো ব্যবস্থা না নেয়া যায় সেই জন্য ২০১০ সালে বিশেষ দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে সকল প্রকার দায় মুক্তি দেয়া হয় এই লুটেরা চক্রকে।
২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীসংকট মোকাবেলার কথা বলে দুই বছরের জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেটা ছিল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম আমল। এরপর চার দফায় এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ২০১২ সালে ২ বছর, ২০১৪ সালে ৪ বছর, ২০১৮ সালে ৩ বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫ বছরের জন্য আইনটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর ফলে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটি কার্যকর থাকার কথা। ভাবছেন সরকার যারা পরিচালনা করছেন তাদের এতো কি ঠেকা এই দূর্নীতি ও দূর্নীতিবাজদের রক্ষা করা। কুইক রেন্টালের নামে ভারা ভিত্তিক শীর্ষ দশ কম্পানীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী কেপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা নিয়েছে সামিট পাওয়ার। এবার আশুন দেখি এই সামিট পাওয়ারের সাথে কারা জড়িত। সামিট পাওয়ারের চেয়ারম্যান হলেন মোহাম্ম্দ আজিজ খান । কে এই আজিজ খান? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ফারুক খানের ভাই মুহাম্মদ আজিজ খান। সরকারের ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে বাণিজ্য এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফারুক খান। সামিটের যাত্রা শুরু হয় ট্রেডিং কোম্পানী হিসেবে। পরে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবসায় এসে অত্যান্ত ভালো করে প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায় তাদের দ্রুত অগ্রগতি হয়।
আন্তর্জাতিক ব্যবসা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে ৩৪ নম্বরে আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। ফোর্বসের হিসেবে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ৯১০ মিলিয়ন ডলার। মিস্টার খান সেই অর্থে বাংলাদেশের প্রথম ডলার বিলিওনিয়ার, অর্থাৎ ডলারের হিসেবে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ‘শত কোটিপতি’। কিভাবে আজিজ খান এই অবস্থানে পৌঁছালেন? তা নিশ্চেই বুঝতে পেরেছেন।
আজিজ খানের মেয়ে আয়শা আজিজ খান হলো এই সামিট পাওয়ারের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও সিইও । সত্য মিথ্যা জানি না সম্প্রতি ফেসবুকে জয় আর তার মধ্যে কি সব ফ্রেন্ড ট্রেন্ড সম্পর্ক আছে এসব নিয়ে অনেক আলোচনা আছে।
এতোক্ষন আপনারা বোয়াল মাছের কথা শুনছিলেন এবার চলেন এই খাতে হাঙরের সন্ধান আপনাদের দেই। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানি যেখানে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। তারা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। তাছাড়া জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির গড্ডা প্রকল্পের মতো পৃথিবীতে এ রকম আর কোনো নজির আছে কি না সন্দেহ। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আদানি ওয়াচ’ নামক ওয়েবসাইটে ‘ইজ বাংলাদেশ’স ইলেকট্রিসিটি কন্ট্রাক্ট উইথ আদানিস লিগালি ভয়েড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গড্ডা থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি দামে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এটি এরই মধ্যে বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে। এজন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) আদানির সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে চাইলেও এক জন অতি দরদী মহামনবী দেশের সম্পদ তাদের হাতে তুলে দিতে পেরেই নিজেকে ধন্য মনে করছেন। ভারতের অন্য সংস্থা বা দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এই আদানি গ্রুপ হলো আর.এস.এসের প্রধান পৃষ্ঠপোশক। ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই আদনি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এক ঝটিকা সফরে দেখাও করেছেন। এই বিদ্যুতের বিষয়েই তাদের সাথে কথাও হয়েছে।
প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক, দেশে কনো স্থায়ী বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ না নিয়ে কুইক রেন্টাল বা ভারত কিংবা আদানি থেকেই কেনো বিদ্যুৎ আমদানী করতে হবে।
মাহফুজুর রহমান- লেখক, সাংবাদিক