জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমার সুবিধা বাতিল করা হতে পারে। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাত ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে না।
অর্থাৎ এ দুই খাতে বিনিয়োগ করলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা সরকারি অন্যকোন সংস্থা অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বর্তমানে চার পদ্ধতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ (কালো টাকা সাদা) করা যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ (ই) ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যেকোনো খাতেই কালো টাকা বিনিয়োগ করা যায়।
আবাসন খাতের জন্য ১৯ বিবিবিবিবি নামে আয়কর অধ্যাদেশে আলাদা একটি ধারা আছে। এ ধারা অনুযায়ী, এলাকাভিত্তিক নির্ধারিত হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা যায়। ১৯ ডিডি ধারা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করা যায়। ১৯ এএএএএএ ধারা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আবাসন খাত ও পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের ‘বিশেষ’ সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেন। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন ২৮৬ জন, জমিতে এক হাজার ৬৪৫ জন, ফ্ল্যাটে ২ হাজার ৮৭৩ জন ও নগদ অর্থ প্রদর্শন করেন ৭ হাজার ৫৫ জন।
চলমান ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। কিন্তু আবাসন খাত ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে শক্ত দাবি তোলায় বাজেট পাসের আগে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
চূড়ান্ত বাজেটে অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) সুবিধা বহাল রেখে ১০ শতাংশের পরিবর্তে নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে পুঁজিবাজারে কালো বিনিয়োগের সুযোগ পান।
এমন সুবিধা দেওয়া হলেও এবার জরিমানা দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগে সাড়া পড়েনি। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মোট ২ হাজার ২৯৩ জন কালো টাকা ও রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি-ফ্ল্যাট প্রদর্শন করেছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এ থেকে সরকার ২ কোটি টাকা আয়কর পেয়েছে। সব মিলিয়ে এনবিআর এপ্রিল পর্যন্ত ১৫৩ কোটি টাকা আয়কর পেয়েছে।
এদিকে দেশের শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে। প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) থেকে এ দাবি জানানো হয়।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এ সুযোগ দেওয়া হয়। ৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে এ থেকে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়।
পরে এ সুবিধা বহাল থাকায় প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা।
এরপর ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ১৯৯৭-২০০০ পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের ৭ বছর অর্থাৎ ২০০১-০৭ পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭-০৯ পর্যন্ত এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও ২০১৩-২০ পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা।