।। জিয়াউল হোসেন চৌধুরী ।।
প্রায় এক যুগ আগের ঘটনা। আমি তখন ইংল্যান্ডের সাউথহ্যাম্পটনে ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক সেন্টারে কর্মরত। একদিন দক্ষিণ মেরু থেকে সমুদ্র অভিযান শেষে পোর্টসমাউথ বন্দরের দিকে ফেরা ক্যাপ্টেন জেমস কুকস গবেষণা জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটা ই–মেইল পেলাম। তাদের কথার সারমর্ম হলো, গবেষণা কার্যক্রম শেষে ফেরার সময় তাদের হাতে দুটো অর্ধব্যবহৃত ‘মারকিউরিক ক্লোরাইড’-এর বোতল রয়েছে এবং ওই বোতল দুটি আমি আমার ল্যাবে সংরক্ষণ করলে তারা কৃতার্থ হয়। জবাবে আমি সবিনয় জানালাম, যদিও আমার ‘ডেঞ্জারাস গুডস’ পরিবহনের সনদ রয়েছে, কিন্তু সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। তাদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার রাসায়নিকটি গ্রহণ করলাম।
আধুনিক যুগে আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেসব দ্রব্যের সংস্পর্শে কিংবা কাছাকাছি আসি, তার বেশির ভাগই কোনো না কোনো রাসায়নিক উপাদান এবং যথেষ্ট নিরাপদ। কিন্তু এমন হাজারো রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা অরক্ষিত অবস্থায় সাধারণের কাছাকাছি রাখা নিরাপদ নয়। এমনকি বিশেষজ্ঞদের পক্ষেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতীত হুটহাট করে কোনো রাসায়নিক সামগ্রীর বিপদ আঁচ করা সমূহ কঠিন। সুতরাং এই সব শিল্পজাত পণ্য বা রাসায়নিক দ্রব্য কী, আদৌ তা জীবন এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক কি না, তা সেসব পণ্যের সংস্পর্শে কিংবা কাছাকাছি আসার আগেই তা জানার অধিকার সংশ্লিষ্ট কর্মী এবং জনগণের রয়েছে। সীতাকুণ্ড বিএম কনটেইনার ডিপোতে সম্প্রতি সংঘটিত দুর্ঘটনার পর পুরো জাতি জেনে গেছে, অব্যবস্থাপনায় রক্ষিত ‘বিপজ্জনক পণ্য’ কী মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কিন্তু এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটল, তাদের কি সবার জানার দরকার ছিল না এই ‘বিপজ্জনক পণ্য’ কী? বিষয়টা তাদের সবার জানা থাকলে, তাদের জানানো হয়ে থাকলে এত বড় ট্র্যাজেডি আমাদের দেখতে হতো না।
বিপজ্জনক দ্রব্য হলো ভৌত এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত উপাদান বা বস্তু, যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হলে, মানবস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা এবং/অথবা অবকাঠামোর জন্য একটি সম্ভাব্য বিপদ তৈরি করে। জাতিসংঘের মডেল আইন অনুযায়ী, বিপজ্জনক পণ্যের ৯টি শ্রেণি রয়েছে এবং শ্রেণিসমূহ বিপজ্জনক পণ্যের দ্বারা তৈরি বিপদের প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। শ্রেণিগুলো হচ্ছে—১: বিস্ফোরক, ২: গ্যাস, ৩: দাহ্য তরল, ৪: দাহ্য কঠিন পদার্থ, ৫: অক্সিডাইজিং এজেন্ট এবং জৈব পার–অক্সাইড, ৬: টক্সিন এবং সংক্রামক পদার্থ, ৭: তেজস্ক্রিয় উপাদান, ৮: ক্ষয়কারী, ৯: বিবিধ বিপজ্জনক পণ্য।
লেখাটা যেহেতু সীতাকুণ্ডের কনটেইনার টার্মিনালের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা, পাঠকের হয়তো অক্সিডাইজিং এজেন্টের ভয়াবহতা নিয়ে জানার আগ্রহ থাকতে পারে। এটা সত্য ‘হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড’ অক্সিজেন সরবরাহ করে আগুনে ঘি ঢালার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে যেকোনো অগ্নিকাণ্ডে এবং পানি দিয়ে সে আগুন নেভানোর চেষ্টা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের জারে রাখা বিস্ফোরক তরল পদার্থ উত্তাপ কিংবা তীব্র বেগে আসা হুশপাইপের পানির চাপ সহ্য করতে পারার কথা নয় বরং ফোমিং এজেন্ট হতো এ ক্ষেত্রে কার্যকর। কোনোক্রমে একটি প্লাস্টিকের কৌটার বিস্ফোরণ মানে ভয়াবহ চেইন বিক্রিয়া ঘটবে মুহূর্তেই। তবে অগ্নিনির্বাপণ কর্মীর শুধু হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড সম্বন্ধে জানলে যথেষ্ট ছিল না, কারণ ওইখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম রাসায়নিকও গাদাগাদি করে রাখা হয়ে থাকতে পারত বা ছিল। যেটা হয়তো ফোমিং এজেন্ট দিয়ে নেভানো সম্ভব ছিল না।
আবার এমন সব রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে, যার সংস্পর্শে পানি আনলে মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এই যেমন ধরুন ধূমায়মান সালফিউরিক অ্যাসিড অথবা সোডিয়াম ধাতু। শুরুতে বলছিলাম মারকিউরিক ক্লোরাইডের কথা। মারকিউরিক ক্লোরাইড জলজ প্রাণীকুলের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। তবে এটা বিস্ফোরক নয়। চিন্তা করুন, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের পাশে মারকিউরিক ক্লোরাইডের একটি কনটেইনার থাকলে কী অন্য রকম বিপদ হতে পারত! বিস্ফোরণে ফেটে যাওয়া মারকিউরিক ক্লোরাইড যদি ফায়ার সার্ভিসের পানিতে ধুয়ে গিয়ে নদী কিংবা সমুদ্রে গিয়ে পড়ত, কিংবা জীবন হরণকারী গ্যাসীয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ত বাতাসে গ্যাসীয় বিপজ্জনক পণ্যের জার থেকে! এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতাকে সামনে রেখে হয়তো অনেক অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিংবা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব চালু হয়ে থাকতে পারে। রাসায়নিক দ্রব্য সম্পর্কে পাঠকের মনে অযথা ভয় ধরিয়ে দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা আশা করি, বিস্ফোরণসম্পর্কিত ফরেনসিক তদন্তে এই ভয়াবহতার সঠিক কারণ বের হয়ে আসবে। এ ধরনের বিস্ফোরণের তদন্তের সক্ষমতা উন্নত দেশের এবং জাতিসংঘের কিছু সংস্থার বিশেষ করে ওপিসিডব্লিউর রয়েছে। আশা করি, সরকার আলামতগুলো সংরক্ষণ করবে, যতক্ষণ না একটি সক্ষম বিস্ফোরণ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা অকুস্থল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা না হচ্ছে।
যেটা বলছিলাম, সব রকমের বিপজ্জনক পণ্য একই জায়গায় একইভাবে সংরক্ষণ করে রাখলে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত কর্মীর জন্যও সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি, সীতাকুণ্ডের কনটেইনার টার্মিনালে নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কিছুই ছিল না। তারপরও শুধু ভৌত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণ এবং পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে উৎপাদন, পরিবহন এবং সংরক্ষণের পুরোপুরি ‘চেইন অব কাস্টডির’ সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হটলাইন ব্যবস্থা। আমি একসময় অ্যাকোয়া রিজিয়ার (মারাত্মক শক্তিশালী অ্যাসিড) চৌবাচ্চায় হাত ডুবিয়ে কাজ করতাম, অবশ্যই সঠিক প্রতিরক্ষামূলক দস্তানা ও কাপড় পরে। আমার হাতের কাছেই থাকত একটা লাল বোতাম, যাতে যেকোনো বিপদ আঁচ করলেই লাল বোতামে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তাপ্রহরী এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে খবর চলে যায় মুহূর্তে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দে সব রকম বিপজ্জনক কাজ করা সম্ভব।
বিপজ্জনক পণ্য চালানোর জন্য অবশ্যই একটি ‘বিপজ্জনক পণ্য নোট’ (ডিজিএন) বা বিপজ্জনক পণ্যের জন্য একটি ঘোষণাপত্র সম্পূর্ণ থাকতে হবে। ডেঞ্জারাস গুডস নোট (ডিজিএন) হলো একটি পরিবহন নথি, যা বাহক, গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ এবং প্রক্রিয়াজাতকারীর কাছে সংশ্লিষ্ট পণ্যের প্রকৃতি, পণ্যের পরিমাণ এবং অন্যান্য হ্যান্ডেলিং নির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা দেয়। স্থল ও জলপথে একই বিপজ্জনক পণ্য নোট ব্যবহার করা হয়। সরবরাহকারী বা জাহাজে তোলার জন্য কনটেইনার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তাদের গন্তব্যে বিপজ্জনক পণ্য নিরাপদে পরিবহনের জন্য দায়ী। উৎপত্তি, ট্রানজিট ও গন্তব্য দেশগুলোর জন্য সঠিক ডকুমেনটেশনসহ সব পণ্য সঠিকভাবে ঘোষণা করা, প্যাক করা ও লেবেল করা উচিত। বিপজ্জনক বস্তুর পরিবহন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) এবং এডিআর (ইউরোপীয় সড়ক পরিবহনসংক্রান্ত) এবং আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) মতো সংস্থাগুলোর দ্বারা নির্ধারিত পরিবহন-নির্দিষ্ট নিয়মগুলো পণ্যের মালিক মেনে চলতে বাধ্য হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা থাকা দরকার। ডিজিএন নোট ব্যবহার না করার মানে হচ্ছে, আইন উপেক্ষা করা, যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিপজ্জনক পণ্যগুলোর ওপর অনুপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ মানবস্বাস্থ্য ও অবকাঠামোর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
যদি মোড়কে আবদ্ধ সামগ্রী সম্পর্কে সহজেই সুস্পষ্ট ধারণা না পাওয়া যায় এবং দ্রব্যটি প্রস্তুতকারী কিংবা পরিবহনকারীর জানা না যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ঘটে। এ ক্ষেত্রে শুধু শুল্ক কর্তৃপক্ষ নয়, যেমন ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা যদি জানতেন কনটেইনারের ভেতরের দ্রব্য সম্পর্কে, তাহলে মুহূর্তেই সীতাকুণ্ডের কনটেইনার টার্মিনালের অগ্নিকাণ্ডে এত ফায়ার ব্রিগেড কর্মী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন না। তা ছাড়া বিষাক্ত কিংবা বিস্ফোরক সামগ্রীর সংস্পর্শে আসা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি দ্রুত সঠিক চিকিৎসা নিতে পারতেন। উপরন্তু চিকিৎসার খরচ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনে অক্ষম শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ, শারীরিক অক্ষমতার ক্ষতিপূরণ, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতিপূরণ আদায় সহজ হতো এবং এটা তাঁর অধিকার। বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনসংশ্লিষ্ট শ্রমিক এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যদি বিপজ্জনক দ্রব্যটির সংরক্ষণ এবং পরিবহনের পদ্ধতি ঠিকমতো বুঝতে পারেন, তাহলে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় যথাযথ সুরক্ষিত থাকার ব্যবস্থা পণ্য সংরক্ষণকারী কিংবা পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায়ও করে নিতে পারবেন।
বিপজ্জনক বস্তু পরিবহনে সরকারি তদারক সংস্থা কিংবা মালিক ও পরিবহন সংস্থা দায়িত্বে অবহেলা করলে এবং তাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য কিংবা পেশাগত সুরক্ষা পাওয়ার জন্য শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন থাকা জরুরি। বিপজ্জনক সামগ্রীর সংস্পর্শে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির যথোপযুক্ত ইনস্যুরেন্সের আওতাভুক্ত হওয়া তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুততার সঙ্গে বিনা মূল্যে পেশাগত উপদেষ্টার সহায়তা পাওয়াটাও তাঁর আইনগত অধিকার। এ জন্য দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে গিয়ে কীভাবে যে কেউ চাইলে নিরপেক্ষ স্বাধীন ঝুঁকি নির্ণায়ক (ইনডিপেনডেন্ট রিস্ক অ্যাসেসর) ও দুর্ঘটনার আইনজীবীর (অ্যাকসিডেন্ট লয়ার) সহায়তা নিতে পারে, সে জন্য অবশ্যই আলাদা সরকারি তহবিল থাকা জরুরি। অন্যথায় আদালতের স্বপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ ছাড়া উপায় নেই। উপরোক্ত সুপারিশগুলোর সমন্বিত বাস্তবায়ন না হলে তদারক সংস্থা, সরকারি কর্মচারী ও মালিকপক্ষের যৌথ কারসাজির হাত থেকে সাধারণের কোনো আশু নিস্তার দেখি না।
ড. জিয়াউল হোসেন চৌধুরী একজন চার্টার্ড কেমিস্ট এবং গ্রিন কেমিস্ট্রি (ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার কমানোসংক্রান্ত বিষয়) পিএইচডি। বর্তমানে আটলান্টিক টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, আয়ারল্যান্ডে পোস্টডক হিসেবে কর্মরত। ইমেইল: chowdhury.mohammed@itsligo.ie