প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি-অতীতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকজন বাংলাদেশকে চিনতো না। আর যারা চিনতো তাদের কাছেও বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই বিশ্ব সভায় বাংলাদেশের সুনাম বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিচয়, সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে পর্যন্ত পৌঁছেছে।
মজার বিষয় হলো-বিশ্বসভা তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে শেখ হাসিনার পরনের কাপড় খুলে দিয়েছে তারই দলের সনামধন্য এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। হাসিনার দাবিকৃত ইজ্জতের ছিটেফাটাও বাদ রাখেনি।
হাসিনার এই দুর্নীতিবাজ এমপি পাপুল দীর্ঘদিন ধরেই মানবপাচার ও অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তার অপকর্ম নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেশের ভেতরও তার অপরাধ-অপকর্ম নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ও প্রশাসন এনিয়ে রহস্যজনক নিরবতা পালন করে আসছে। কথিত তদন্তের কথা বলে হাসিনার অনুগত প্রতিষ্ঠান দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদও চুপ আছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছিলেন-এমপি পাপুলের বিষয়ে তদন্ত হবে। কিন্তু তদন্ত আর হয়নি।
শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন-অন্য দেশের সরকার প্রধানরাও বুঝি তার মতো দুর্নীতিবাজ এমপি-মন্ত্রীদেরকে আশ্রয় দেন। তার ধারণা ছিল কুয়েত সরকার মানবপাচার ও অর্থপাচারকারী এমপি পাপুলকে গ্রেফতারের আগে কমপক্ষে একবার হলেও তাকে ফোন করবে। সে দেশের আইন যে তার নিজস্ব গতিতে চলে সেটা মনে হয় হাসিনার জানা ছিল না।
জানা গেছে, কুয়েতের সিআইডি অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশি এমপি পাপুলকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। অবশেষে শনিবার রাতে মুশরিফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার বাসা থেকে দেশটির ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট তাকে গ্রেফতার করে।
কুয়েতে হাসিনার এমপি পাপুল গ্রেফতারের খবর দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশের পরই সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে যায়। দেশে এখন আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে কুয়েতে গ্রেফতার এমপি পাপুল।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ বলছেন-এটা নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে দুর্নীতি ও অপকর্মের দায়ে বাংলাদেশের কোনো সংসদ সদস্য বিদেশে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনা দেশের সম্মান শেষ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকজন এখন বুঝবে যে, বাংলাদেশের এমপি-মন্ত্রীরা সবই দুর্নীতিবাজ। তারা বলছেন, এমপি পাপুল বিশ্ব সভায় তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে হাসিনার পরনের কাপড় খুলে দিয়েছে। হাসিনা দীর্ঘদিন ধরেই এমপি-মন্ত্রীদের সকল অপরাধ-অপকর্ম ঢেকে রেখেছিল। তা এখন প্রকাশ করে দিয়েছে এমপি পাপুল।
বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে গিয়েছিলেন শ্রমিক হিসেবে, আজ তিনি সেই দেশে দুটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), নিজ দেশে ব্যাংকের পরিচালকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। আলিশান বাড়ি-গাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। শুধু কি সম্পদশালী? কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই এখন সংসদ সদস্য। নিজে স্বতন্ত্র থেকে সংসদ সদস্য এবং স্ত্রী কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য। আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এই ব্যক্তি হচ্ছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। যাঁর বিরুদ্ধে কুয়েতে মানবপাচারের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে দেশটির গণমাধ্যমে।
এমপি কাজী শহীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের এক সভায় অনুসন্ধানের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সভায় দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের সই করা একটি চিঠির বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয় যেখানে এমপি কাজী শহীদের বিরুদ্ধে কমিশন খেয়ে ব্যাংকঋণ বরাদ্দসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারে তথ্য পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। দুদক পরিচালকের চিঠির সঙ্গে ১৭৪ পাতার একটি নথির ফাইলও যোগ করা হয়েছে বলে কমিশনের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য চলতি সপ্তাহেই দুদকের একজন কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সভায় জানানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, কাজী শহীদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থপাচার ও ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন বাণিজ্য করার অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে কমিশনে।
সম্প্রতি কুয়েত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির বরাত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশটির পত্রিকা আল কাবাস ও আরব টাইমস। প্রতিবেদনে এই সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ করা না হলেও এ বিষয়ে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলই ওই সংসদ সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংসদ সদস্যসহ তিনজনের চক্রটি অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে পাঠিয়ে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে বলে কুয়েতের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়।
লক্ষ্মীপুরে আকস্মিক উদয়
কাজী শহীদের বিরুদ্ধে কুয়েতে মানবপাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ আর দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকা লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের একাংশ) আসনেও বেশ আলোচনা চলছে। রাজনীতির বাইরে থাকা ‘ভাগ্যবান’ এ দম্পতি টাকার বিনিময়ে কেন্দ্র ও জেলা আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মীকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে রেখেছেন বলেও আলোচনা আছে। যদিও লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তাঁকে ‘নব্য হাইব্রিড’ আখ্যা দিয়ে একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত হলেও তা অদৃশ্য কারণে বাস্তবায়ন হয়নি।
লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা শহীদ ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি স্থানীয় একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে সংবাদকর্মীদের নিয়ে মতবিনিমিয় করেন। জন্মের পর তখনই প্রথম এসেছেন জানিয়ে রায়পুরকে জেলায় রূপান্তর করাসহ একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাক্কি বিল্লাহর হাত ধরে তিনি কিছু দান-খয়রাত করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে ‘দানবীর’ ও ‘মানবতার সেবক’ হিসেবে প্রচার চালান তাঁর অনুসারীরা।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটগত কারণে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে মনোনয়ন দেয়। তখন শহীদ স্বতন্ত্র (আপেল প্রতীক) প্রার্থী হন। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মোহাম্মদ নোমান নাটকীয়ভাবে গাঢাকা দেন। তখন অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন শহীদ। এরপর শহীদ এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে নিজের স্ত্রী সেলিনা ইসলামের জন্যও বাগিয়ে নেন কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের এমপির পদটিও। সেলিনা কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।