সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: উত্তর ভারতের তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এ মুহূর্তের সেরা রাজনৈতিক জল্পনা তাঁকে ঘিরে। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আরেকবার তিনি বিজেপির হাত ধরতে চলেছেন কি না, সেই জল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। নীতীশ যদিও নির্বাক।
বিহার-নরেশ নীতীশ কুমার নতুন বছরের রাজনৈতিক জল্পনার শীর্ষে হলে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন বিরোধীশাসিত রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও ঝাড়খন্ডের হেমন্ত সোরেন। তাঁদের নিয়ে জল্পনার কারণ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) একের পর এক সমন জারি হওয়া। জমি বেচাকেনায় অনিয়মের তদন্তে হেমন্তকে ইডি মোট সাতটি সমন জারি করেছে, আবগারি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেজরিওয়ালকে পাঠিয়েছে তিনটি সমন। দুই মুখ্যমন্ত্রীই সেই সমন অগ্রাহ্য করেছেন।
দুই মুখ্যমন্ত্রীরই অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই তাঁদের বিরুদ্ধে ইডির এই চক্রান্ত। বারবার সমন অগ্রাহ্য করায় ইডি কি তাহলে দুই মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করবে? প্রশ্নটি প্রবলভাবে উঠে এসেছে। আইন অনুযায়ী, পরপর তিনটি সমন অগ্রাহ্য করা হলে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা ইডির রয়েছে।
নীতীশকে নিয়ে জল্পনা জোরালো হয় গত বছর ২৯ ডিসেম্বর জেডির (ইউ) সভাপতির পদ থেকে লালন সিং ইস্তফা দেওয়ায়। সভাপতির দায়িত্ব নেন নীতীশ নিজেই। বিহারের রাজনীতিতে এ নিয়ে কানাঘুষা চলছিল কিছুদিন ধরেই। লালনের ওপর নীতীশ অসন্তুষ্ট ছিলেন বিহারের শরিক দল আরজেডির সঙ্গে ‘মাত্রাছাড়া দহরম মহরমের দরুন’। লালুপুত্র ও রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবও কিছুদিন ধরেই মন্ত্রিসভার বহর বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। নীতীশ চাইছেন না মন্ত্রিসভায় আরজেডির প্রভাব আরও বাড়াতে।
বিহার-নরেশ নীতীশ কুমার নতুন বছরের রাজনৈতিক জল্পনার শীর্ষে হলে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন বিরোধীশাসিত রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও ঝাড়খন্ডের হেমন্ত সোরেন।
‘‘কয়েক মাস ধরে লালুর সঙ্গে নীতীশ দেখা করেননি। গত মাসে চারটি সরকারি অনুষ্ঠানে নীতীশের সঙ্গে মঞ্চে থাকার কথা থাকলেও তেজস্বী গরহাজির ছিলেন। ৬ জানুয়ারি ব্যক্তিগত সফরে তেজস্বীর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। লালন-বিদায়ের পর সেই সফর তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীর দূরত্ব বৃদ্ধি কিছুদিন ধরেই চর্চায়।‘‘
রাজনৈতিক জল্পনায় সর্বশেষ সংযোজন নীতীশকে ‘ইন্ডিয়া’জোটের আহ্বায়ক করার প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য কংগ্রেসের উদ্যোগ বানচাল হয়ে যাওয়া। গত বুধবার ওই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নীতীশের অনাগ্রহ ও অন্য কয়েকটি শরিকের তোলা প্রশ্নের কারণে সেই বৈঠক বাতিল করে দিতে হয়।
বিহারের বিজেপি নেতারা এই জল্পনায় তাঁদের মতো করে ইন্ধন জোগাতে শুরু করেছেন। নীতীশ যদিও নির্বাক। ‘ইন্ডিয়া’জোট নিয়েও কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। রাজনৈতিক ভাষ্য, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সলতে পাকানোর কাজ তিনি শুরু করলেও সেই গুরুত্ব পাচ্ছেন না। আজ পর্যন্ত তাঁকে জোটের আহ্বায়কও করা হয়নি। অথচ মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেউ কেউ তুলে দিয়েছেন।
নীতীশের রাজনীতি এবং ঘনঘন শিবির বদলের ইতিহাস লোকসভা ভোটের মুখে এই জল্পনাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। ২০১৬ সালে জেডির (ইউ) তৎকালীন সভাপতি শরদ যাদবকে সরিয়ে তিনি দলের ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন। বিহারে আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে মহাজোট গড়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। ২০১৭ সালে সেই জোট ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন এনডিএতে। পরে বিজেপিকে ছেড়ে আবার আরেকবার হাত ধরেন আরজেডি-কংগ্রেসের। এখন তাঁর দলের লেখচিত্র নিম্নমুখী হলেও বিজেপি তাঁর সঙ্গ পেতে আগ্রহী। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে নীতীশকে সঙ্গে নিয়েই বিজেপি রাজ্যের ৪০টির মধ্যে ৩৯টি আসন জিতেছিল। সেই ধারা বজায় রাখতে হলে নীতীশের সাহচর্য বিজেপির প্রয়োজন।
কী করবেন ৭২ বছর বয়সী নীতীশ কুমার? ‘ইন্ডিয়া’জোটের আহ্বায়কের পদ পেয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন, নাকি বিজেপির হাত ধরে নতুনভাবে শুরু করবেন রাজনৈতিক জীবনের সম্ভবত শেষ অধ্যায়? জল্পনা প্রবল।
এমনই জল্পনা কেজরিওয়াল ও হেমন্ত সোরেনকে ঘিরেও। দিল্লিতে আবগারি মামলায় ইডি আগেই গ্রেপ্তার করেছে আম আদমি পার্টির (এএপি) রাজ্যসভা সদস্য সঞ্জয় সিং ও উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াকে। দুজনের কেউই এখনো জামিন পাননি। সিবিআই এর আগে কেজরিওয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তখন থেকেই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে চলেছেন। ইডি সমন জারির পর সেই আশঙ্কা আরও বেড়েছে। তিনটি সমনই তিনি বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অগ্রাহ্য করেছেন। যেমন পরপর সাতটি সমন অগ্রাহ্য করেছেন হেমন্ত সোরেন। রাজনৈতিক জল্পনা, ভোটের আগে বিরোধী দলের দুই মুখ্যমন্ত্রীকেই ইডি গ্রেপ্তার করবে।
ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রীর ঠিকানা যে কারাগার হতে চলেছে, সেই জল্পনা উসকে দিয়েছেন রাজ্যের গোন্ডা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত বিজেপির সদস্য নিশিকান্ত দুবে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, হেমন্ত সোরেন কারাগারে গেলে ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলাবেন তাঁর স্ত্রী কল্পনা সোরেন, ঠিক যেভাবে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন লালু প্রসাদের স্ত্রী রাবড়ি দেবী।
নিশিকান্তের ওই মন্তব্যের পেছনে ছিল ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) বিধায়ক সরফরাজ আহমেদের পদত্যাগ। ইস্তফা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা গৃহীত হয়। সরফরাজ বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর হাত শক্ত করতেই তাঁর পদত্যাগ। নিশিকান্ত বলেন, সেটা করা হয়েছে হেমন্ত জায়া কল্পনার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিশ্চিত করতে। কারণ, হেমন্ত শিগগিরই জেলে যাবেন।
‘ইন্ডিয়া’ জোট এখনো নিজেদের মধ্যে আসন-ভাগাভাগি চূড়ান্ত করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রের জট কবে কাটবে, ঠিক নেই। এই অবস্থায় নীতীশ কুমারের দোদুল্যমান এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও হেমন্ত সোরেনের গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা জোট-ভাগ্য অনিশ্চিত করে তুলেছে। পাশাপাশি বিজেপি স্থির করে ফেলেছে, পরবর্তী ভোটে তাদের আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রা। লোকসভা ভোটের আগে তাদের নতুন স্লোগান, ‘তিসরি (তৃতীয়) বার মোদি সরকার, আব কি বার (পরের বার) ৪০০ পার।’
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি একা জিতেছিল ২৮২ আসন, এনডিএ জোট ৩৩৬টি। ২০১৯ সালে বিজেপি জেতে ৩০৩ আসন, এনডিএ ৩৫৩। এবারের লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির হ্যাটট্রিকসহ ৪০০ আসন।