।। রিভিউ বাই বেঙ্গল টাইগার ।।
বইয়ের নাম: স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ; লেখকঃ পিনাকী ভট্টাচার্য; পৃষ্ঠা: ৪৭৩; প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: হরপ্পা ইউকে; মূল্য: ২০ পাউন্ড।
ভূমিকাঃ পিনাকী ভট্টাচার্য পেশায় একজন চিকিৎসক ও বর্তমান সময়ের তুমুল পাঠক প্রিয় লেখক এবং ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট। সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে তার করা বিভিন্ন মন্তব্য তাকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে। লেখালেখির জন্য বৃটিশ সরকার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তখন জেলে পুরেছেন। লেখালেখির জন্য বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার পিনাকী ভট্টাচার্যকে দেশ ছাড়া করেছেন। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী সদস্য পরিচয় দিয়ে আদালতের নির্দেশ ছাড়া, ওয়ারেন্ট ছাড়া পিনাকীকে গ্রেফতার করার জন্য তারা রাতের অন্ধকার তার বাসা বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। তাকে না পেয়ে তার ফেইসবুক আইডির উপরে বার বার আক্রমণ করেছে, আইডি রিপোর্ট করে ডিজেবল করে দেয়া হয়েছে। পিনাকী মারা গেছেন এই মর্মে ভূয়া ডকুমেন্ট সাবমিট করে বার বার তার আইডি মেমোরিয়ালাইজেশন স্ট্যাটাস করে দেয়া হয়েছে! পিনাকীর ওয়েব সাইট ব্লক করে দেয়া হয়েছে। তার উপরে শারীরিক আক্রমণের চেস্টা করা হয়েছে। তার বইয়ের প্রকাশককে গুম খুন করার হুমকি দিয়ে বাংলাদেশে তার বইয়ের প্রকাশনা বন্ধ করেছে। কেনো করেছে? কারণ আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগারদের রচিত ইতিহাসে অনেক সত্য উপেক্ষিত ও বিকৃত করে দেখানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার আর রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে। তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, প্রীতিলতা, মাষ্টারদা সূর্যসেন, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম, ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জিয়াউর রহমান, জেনারেল ওসমানীসহ সকল সেক্টর কমান্ডাররা, মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের সাহায্যকারীরা উপেক্ষিত হয়েছেন। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করে দলীয় লোকদের তারা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিচ্ছেন। ইংরেজদের মত ইতিহাসে ভেজাল দিয়ে জাতিকে অন্ধকারে রেখে, বিভেদ সৃষ্টি করে বাঙালি জাতিকে চিরস্থায়ী শাসন ও শোষণের বন্দোবস্ত তারা করেছেন। অতীতের ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে ক্ষমতাসীন হয়ে তারা একই ভুল আবার করছেন এবং ইতিহাসের মধ্যে তাদের সকল অতীত অপকর্মকে ইতিমধ্যে জায়েজ করে ফেলেছেন। নিজ দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থ মাথায় রেখে নতুন করে তারা ইতিহাস রচনা করেছেন। পিনাকী তার এই বইয়ে তাদের সেই অপ্রকাশিত সত্যগুলো তুলে ধরেছেন। খুঁজে খুঁজে ইতিহাসের সত্য ঘটনাগুলো বের করে এনেছেন। পান্ডোরার বাক্স তিনি খুলে দিয়েছেন। এটাই কারণ। যাই হোক, অনেক সময়ই রাষ্ট্রের চিন্তাশীল মানুষ, দার্শনিক কিংবা মহান স্বাধীনচেতা লেখকদের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী, রাজা বা শোষকদের নিষ্ঠুর বৈরীতা বা রক্তচক্ষুর মোকাবিলা করতে হয়েছে। বহু সুপরিচিত লেখকের অনেক মহান সৃষ্টি সংশ্লিষ্ট দেশের শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছে। হোমারের কালজয়ী সৃষ্টি ওডিসীর পঠন নিষিদ্ধ ছিল। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের মতামত, তাঁর সময়ের তাঁর দেশের শাসকগোষ্ঠী আক্রমণ করেছিলো। কিন্তু মজলুমের কণ্ঠস্বর জালেমের সকল নিপীড়ক যন্ত্রের চাইতে শক্তিশালী। পিনাকীর যে বইটি নিয়ে এত কান্ড, এত জুলুম, আশার কথা সেই বইটি যুক্তরাজ্য থেকে হরপ্পা প্রকাশনী প্রকাশ করেছে। বইটি পিনাকী ভট্টাচার্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম পর্বে নানা নিপীড়ক বাহিনীর হাতে প্রাণদানকারী এবং আহত ও পঙ্গু হয়ে জীবনদানকারী নারী-পুরুষের স্মৃতির বেদীমূলে উৎসর্গ করেছেন। স্বাধীন দেশের ইতিহাস রচনা করা ও সঠিক ইতিহাস প্রকাশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই কারণে যে স্বাধীনতা মানে আরো অনেক কিছুর সাথে একটা নতুন রাষ্ট্র গঠন। এই রাষ্ট্র গঠন মানে শুধু সংবিধান রচনা নয়, একটা কালেক্টিভ কালচার গড়ে তোলা। দু:খজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত আমরা কোন কালেক্টিভ কালচার গড়ে তুলতে পারিনি। কেন পারিনি তা বুঝতে হলে আমরা স্বাধীনতার পরে কী কী করেছিলাম সেটার পর্যালোচনা দরকার। পিনাকী তার এই বইয়ের মাধ্যমে সেই দুরুহ কাজটিই করেছেন। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে এদেশের মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরে সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ কি পেয়েছিল এদেশের মানুষ? নাকি মোহভঙ্গ হয়েছিল? নিজ গৃহেই হয়েছিল পরবাসী? এসবেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এ সময়ের তুমুল পাঠকপ্রিয় লেখক ও গবেষক পিনাকী ভট্টাচার্যের ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ বইয়ে।
সার সংক্ষেপঃ পিনাকী ভট্টাচার্য তার ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ‘ বইয়ের প্রথম খন্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল বিশেষ করে ১৯৭২-১৯৭৫ সালের প্রায় সকল ঘটনা তুলে এনেছেন। ৪৭৩ পৃষ্টার বইটিকে তিনি বাইশটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। ‘পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ‘ অধ্যায় দিয়ে পিনাকী তার প্রথম অধ্যায়ের লেখা শুরু করেছেন এবং শেষ অধ্যায়ে ‘শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড‘ দিয়ে পিনাকী তার ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ বইয়ের প্রথম খন্ডের লেখা শেষ করেছেন। বইয়ের ভূমিকায় পিনাকী নিজেই জানিয়েছেন, ”বাংলাদেশের ইতিহাসের যে বয়ানগুলো হাজির আছে, তার সিংহভাগ উদ্দেশ্যেমূলক ও খন্ডিত। এই খন্ডিত ইতিহাসে বেশির ভাগ সময় ভীরুরা ‘নায়ক’ আর বীরেরা ‘ভিলেন’ বা ‘খলনায়ক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।” বইয়ের প্রথম খন্ডে তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ খ্যাত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে পিনাকী প্রবেশ করেছেন। ইতিহাসের পাতায় পাতায় পিনাকী সেই দিনগুলো দেখে নিয়েছেন সেই সাথে পাঠকদেরও নিমন্ত্রণ করেছেন। পিনাকী তার ভূমিকার শেষ লাইনে ‘ অতীতের ভুলগুলো জেনে আগামী প্রজন্ম নতুন এক ভবিষ্যত বাংলাদেশ গড়ে তুলবে- এটাই হোক সবার আকাঙ্খা’ এই কথা বলে মুছে দেয়া আর ভুলিয়ে দেয়া সেই ইতিহাসের জগতে পাঠককে স্বাগত জানিয়েছেন। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে খুব সহজভাবে গল্পের মতো করে আত্মসমর্পণের ঘটনাটি পিনাকী উপস্থাপন করেছেন। যথাযথভাবে তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছেন এবং যথাস্থানে ছবি সন্নিবেশিত করেছেন। যুদ্ধরত দুই পক্ষের মধ্যে বিজয়ী এবং পরাজিতের মানসিকতা এরকম আত্মসমর্পণের সময় কেমন হতে পারে তার একটা আবহ দিয়েছেন। জেনারেল ওসমানী কেন উপস্থিত থাকলেন না তারও একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। আজকালকার দিনে ইংরেজিতে ইতিহাসের বই যেমন করে লেখা হয় অর্থাৎ গল্পের মতো করে – সাধারণ মানুষদের চোখে সময়টাকে বুঝতে পারার চেষ্টা করা; পিনাকী ভট্টাচার্য সেই পথে হেঁটেছেন। বইয়ের পুরো ৪৭৩ পৃষ্ঠা জুড়েই তিনি তার এই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে তিনি স্বাধীনতার পর ভারতপন্থীদের অতিরিক্ত আস্ফালন, বাংলাদেশের ১১০টি শহরে পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার উর্দুভাষীকে হত্যা, ধর্ষণ আর তাদের সহায় সম্পদ লুন্ঠন ও শরনার্থী শিবিরে প্রবীণ মুসলিমদের বিপরীতে প্রবীণ হিন্দুদের উল্লাস এবং একান্ত স্থুল স্বার্থ চেতনা ও ব্যক্তিগত শত্রুদের রাজাকার আখ্যা দিয়ে নির্বিচারে মেরে ফেলে তাদের সহায় সম্পত্তি দখল করে নেওয়ার উপর আলোকপাত করেছেন। সেই সাথে উর্দুভাষী বিহারী নেতা যিনি মুক্তিযুদ্ধে পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানপন্থী বিহারী রাজাকারদের কাছ থেকে পালিয়ে বেচেছিলেন সেই মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে ফেরার পথে কিভাবে শত্রুজ্ঞানে প্রকাশ্যেই হত্যা হলো; ‘পাক ফ্যাশন টেইলার্স‘ নামের যে দোকান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা সেলাই করা হয়েছিলো সেই দোকানের অবাঙালি দর্জি মোহাম্মদ হোসেন, নাসির উল্লাহ ও আবদুল খালেক মোহাম্মদীর কী পরিণতি হলো; কিভাবে বিহারীরা বাঁচতে চাইলে ঈদগাহে জড়ো হও বলে সব নিরস্ত্র বিহারীকে ঈদগাহ মাঠে জড়ো করে তাদের উপর নির্বিচারে গুলি ছুড়ে হত্যা করা হলো- তা তুলে ধরেছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ পরিচ্ছদে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন লুটপাট ও তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের গুম হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছদে স্বাধীন বাংলাদেশের লেজেগুবরে প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধের সিক্সটিনথ ডিভিশন ও পল্টন ময়দানে চার যুবককে দুষ্কৃতিকারী অভিযোগে আটক করে বিদেশী টেলিভিশন ক্যমেরার সামনে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে কাদের সিদ্দিকীর হত্যা করা এবং ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে বিচার না করে ‘কাদের, তুই চারজনকে মেরেছিস, চারশ লোক মারলেও আমি তোকে কিছু্ই বলতাম না‘ বলে শেখ মুজিব কিভাবে তার অনুসারীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন তা চিত্রসহ সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একটা জাতীয় সরকার গঠনের দাবীকে অগ্রাহ্য করে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যে সংহত ও ব্যাপকভিত্তিক ঐক্য সূচিত হতে পারতো অঙ্কুরেই তা যেভাবে বিনষ্ট করা হয়েছিলো; স্বাধীন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেরণা সঞ্জাত একমূখী শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয় আকাঙ্খা ও দাবীর দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে শেখ মুজিব যেভাবে জাতীয় চিন্তাও বোধ ক্রমশ বিভাজিত করেছিলেন; অবাঙালিদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার কথা বলে যেভাবে তিনি পার্বত্য চট্রগ্রামে স্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করেছিলেন; সকল নিয়ম কানুনকে বৃদ্বাঙ্গলি দেখিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি যেভাবে উর্দু দৈনিক পাসবান দখল করে নাম বদল করে বাংলার বাণীর মালিক হয়েছিলেন; আফতাব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা কিভাবে পুরনো ঢাকার ‘জনতা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজেস‘ দখল করে নিয়েছিলেন; যুদ্ধের নয় মাস অন্ধকারে থেকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের ক্যারিজেস হোটেলে সাংবাদিক সন্মেলনে কি বলবেন না বলবেন সে ব্যাপারে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদকে ফোন করে কি কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন; কিভাবে তিনি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত মেনে নিয়েছিলেন এবং ‘মুজিববাদ‘ নামের অন্ত:সারশূন্য কায়েমি গোষ্ঠীর গণবিরোধী ভয়ঙ্কর তৎপরতা ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের পূর্ব পাকিস্তান বিভাগের সাংবাদিক সিরাজুর রহমান এবং ইতালিয়ান সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের বর্ণনা দিয়েছেন। শুধু তাই না, পিনাকী ভট্রাচার্য তার বইয়ে ‘কিউ আর কোড‘এর মাধ্যমে সেই ভিডিও সাক্ষাৎকার দু‘টিসহ এমন অসংখ্য প্রামাণ্য চিত্র পাঠকদের সরাসরি দেখার ব্যবস্থা করেছেন। বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছদে রণাঙ্গন থেকে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশে কিভাবে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন; পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা মাঠের সক্রিয় যুদ্ধে অংশ না নিয়েও কিভাবে স্বাধীনতার বীর পুরুষ হিসেবে নিজেদের জাহির করেন; কিভাবে তারা সশস্ত্র প্রহরীসহ ঘোরাফেরা করেন তার সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন। তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে তিনি সেই সময়ে বীরাঙ্গনাদের অবস্থা তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্ষিতা নারীরা স্বাধীন দেশে সবচেয়ে বেশী অপমান আর অসন্মানের শিকার হয়েছেন। স্বয়ং শেখ মুজিব দুঃখজনকভাবে ধর্ষিতা নারীদের এবং যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে অসন্মানজনক কথা বলেছেন। ‘ওইসব দূষিত রক্ত আমি বাংলার মাটিতে রাখতে চাই না। ওদের বিদেশে পাঠিয়ে দিন’বলে নির্মম মন্তব্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ধর্ষিত নারীদের শেখ মুজিব একদিকে ‘মা’ আর ‘বীরাঙ্গনা’ বলে সম্বোধন করেছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্ষণে জন্ম নেয়া যুদ্ধ শিশুদের বিষয়ে তিনি এমন অমানবিক, অনৈতিক ও অসংবেদনশীল মন্তব্য করেছেন। একবার মা ডাকা, আবার আরেকবার তাদের সন্তানদের “দূষিত রক্ত” বলা এই দুই অবস্থানের মধ্যে যে বৈপরীত্য সেটাই বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান ও মনোভাবকে ফুটিয়ে তুলেছিলো বলে পিনাকী কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। পিনাকী জানিয়েছেন, শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্ষিতা নারীদের সন্তানদের ‘দূষিত রক্ত‘ বলে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার মনোভাব ব্যত্ত করলে সমাজে একটা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের উপরে সেই সময়ে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্তের ‘অরণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী‘ সিনেমার পোষ্টারের ট্যাগ লাইনে, ‘লাঞ্ছিত নারীদের মর্যাদা দাও, নিষ্পাপ শিশুদের গ্রহণ কর….‘ বলে আহ্বান জানানো হয়েছিলো। এই আহ্বান যে শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে ছিলো তা পরিষ্কারভাবেই বুঝা গিয়েছিলো। এই সকল ধর্ষিতা তরুণী ও কিশোরীদের তখন সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশে নিয়োগ না দিয়ে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা, মমতা ও শ্রদ্বা প্রদর্শনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলো। বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছদে পিনাকী ভট্রাচার্য স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের অর্ন্তধান রহস্যের জট খুলেছেন। ১৯৭২ সালের ২৫শে জানুয়ারি ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সন্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা দেন- ‘বুদ্বিজীবি হত্যাকান্ডের নীল নকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্বের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় স্থান নেয়া অনেক নেতার কু-কীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। আগামী ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেসক্লাবে ফিল্ম-শো প্রমাণ করে দেবে কার কী চরিত্র ছিলো‘। রহস্যজনকভাবে ৩০ জানুয়ারি সকালে তার কাছে একটা ফোন এসেছিলো। টেলিফোনে জহির রায়হানকে বলা হয়েছিলো, আপনার ‘বড় দা‘ শহিদুল্লাহ কায়সার মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি ‘বড় দা‘ কে বাচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাচাতে পারবেন। জহির রায়হান তার নিজের গাড়ি নিয়ে মিরপুর গিয়েছিলেন এবং শহিদুল্লাহ কায়সারের মত তিনি নিজেও চিরদিনের মত নিখোঁজ হয়েছিলেন। জহির রায়হানকে দুনিয়া থেকে গায়েবকারীরা জহির রায়হানের সাথে তার গাড়ির তালা ভেঙ্গে তার ডায়েরি, নোটবুক, কাগজপত্রের ফাইল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় চিত্রায়িত অব্যবহৃত মূল্যবান ফিল্ম ফুটেজসহ বুদ্বিজীবি হত্যাকান্ডের তদন্ত কমিটির সমস্ত প্রামাণ্য তথ্য গায়েব করে দিয়েছিলেন। জহির রায়হানের বড় বোন এ নিয়ে হইচই করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাকে একদিন ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে বেশি হইচই করলে তুমি নিজেও নিখোঁজ হয়ে যাবে।‘ মুজিব বাহিনীর সদস্যরাই যে এই কাজ করেছিলেন পিনাকী ভট্রাচার্য তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে তা বইয়ে তুলে ধরেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যা দু:খজনকভাবে কেনো জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়নি; দেশে হাত ধোয়া দিবস পর্যন্ত আছে, অথচ কেনো গণহত্যা দিবস নাই-ি সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ষীবাহিনী গঠনের পূর্ব পরিকল্পনা ফাঁস করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছদে ৭ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান তার ‘বীর উত্তম‘ খেতাব কেনো ব্যবহার করেননি; সেই সময়ের রাজনৈতিক সরকারের পদক দেওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছদে স্বাধীনতা বিরোধী বলে কুখ্যাত খুনি দালালদের জনরোষ থেকে বাচানোর জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার পর থেকেই কিভাবে প্রচেষ্টা চালানো শুরু করেন; দালালদের বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালতের দাবী উপক্ষো করে কিভাবে দালাল অধ্যাদেশ ১৯৭২ জারি করেন; সেই আদেশ অনুযায়ী আসামির ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করার অধিকার রাখলেও ফরিয়াদীকে কিভাবে অন্য কোন আদালতে বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন; থানার ওসি যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না বলেন, তবে অন্য কারো কথা বিশ্বাস করা হবেনা, অন্য কারো অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার হবেনা ট্রাইব্যুনালে, অন্য কোন আদালতেও মামলা দায়ের করা যাবেনা- এই মর্মে কিভাবে এমন অদ্ভুত আইন করেন; কিভাবে ছাত্রলীগ, যুবলীগকে থানা পুলিশে, রক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ দেন; কিভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের চাকরিতে প্রমোশন দেন; কুখ্যাত খুনি জেনারেল টিক্কা খানের পিএস অনু ইসলামকে কিভাবে গণভবনে চাকরি দেন; মোনায়েম খানের এডিসি ব্রিগেডিয়ার মশরুলকে কিভাবে শেখ মুজিব নিজের এডিসি পদে নিয়োগ দেন; পাকিস্তান আমলে তাজ উদ্দিন আহমেদের উপর নজরদারীর জন্য গঠিত টিম ‘৩০৩‘ এর সদস্য সিএসপি মতিউল ইসলামকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কিভাবে অর্থ সচিব পদে নিয়োগ দেন; রাজাকার বাহিনীর উপপ্রধান লে. কর্ণেল ফিরুজকে কিভাবে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব পদে নিয়োগ দেন; মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মির গোলাবারুদ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা লে. মোদাব্বের ও লে. ফরিদ কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশের উচ্চপদ লাভ করেন, আখাউড়া ও তেলিয়াপাড়া এলাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে শহীদ করা পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন হাকিমকে কিভাবে শেখ মুজিব তার সেনাপুলিশের প্রধান করেন; পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ঢাকার প্রধান এয়ার কমোডোর আমিনুল ইসলামকে কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান করেন; এমনকি যে কোর্টে দালালির অভিযোগে রাজাকার, আলবদরদের বিচার হবে-সেই কোর্টে কিভাবে রাজাকার সর্দারকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন; দালাল আইনে সরকারের হাতে যে বিপুল ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলো সেই ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে কিভাবে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা বেপরোয়াভাবে অত্যাচার, নির্যাতন ও ব্ল্যাকমেইলে মেতে উঠেন- সেই বিষয়ে পিনাকী ভট্রাচার্য রেফারেন্সসহ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। পঞ্চম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে ১৯৭৩ সালের ৩০শে নভেম্বর কিভাবে একটি আকস্মিক সরকারি ঘোষণায় দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন সকল আটক ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন; শহীদ পরিবারের সন্তানেরা কিভাবে তাদের খেদ প্রকাশ করেন- সেই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাকিস্তানের ‘গণপরিষদ‘ দিয়ে এখতিয়ার বর্হিভূতভাবে কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিলো; ‘গণপরিষদ‘ সদস্যদের শতকরা নব্বইজনই স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত না থেকেও কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা বনে গিয়েছিলো; মুক্তিযুদ্বের চেতনা ও আকাঙ্খার কোনো প্রতিফলন না ঘটিয়ে কিভাবে পাকিস্তানী ও ব্রিটিশ আইন-ই বহাল রাখা হয়েছিলো; সংসদীয় পদ্বতির সংবিধান ও সরকার ব্যবস্থা হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে কিভাবে একচ্ছত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলো; স্বাধীনতার মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার কিভাবে যুদ্ধশেষে সংবিধান রচনার সময় রাতারাতি পাল্টে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিলো; সেই থেকে কিভাবে সেক্যুলার এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের পারস্পরিক সন্দেহ ও বিরোধ-বিভেদ আর অনৈক্যের যাত্রা শুরু হলো; মাওলানা ভাসানী ও মোজাফ্ফর আহমেদ কেনো আরেকটি সাধারণ নির্বাচন না করে দেশের জন্য কোন স্থায়ী সংবিধান রচনার বিরোধীতা করেছিলেন; প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কেনো মাওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন; বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার বিধান থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধানে কিভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ইমপিচ করা দুরে থাক, সাংবিধানিকভাবে তার কাছে সামান্য জবাবদিহীতা চাইবার বা আদায় করবার কোন সুযোগ বা ব্যবস্থা রহিত হলো, জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহারের সুযোগ কিভাবে রহিত করা হলো; রাষ্ট্রিয় কোন চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে বা পরে জনগণের মতামত গ্রহণ কিভাবে অগ্রাহ্য করা হলো; সংবিধানে বিভিন্ন জাতিসত্তার কথা কিভাবে অস্বীকৃত হলো; এমনকি যে ভাষাগত ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ জীবন-মরণ সংগ্রাম করলো, স্বাধীনতার পর কিভাবে দেশের সংবিধানকে সেই ভাষাগত ও জাতিগত নিপীড়ন, বঞ্চনার হাতিয়ার করা হলো; শাসনতন্ত্রের খসড়া হবার পর জনগণের কাছে প্রকাশের আগে কেনো দিল্লী পাঠানো হয়েছিলো; মাওলানা ভাসানী ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নব্য শাসকগোষ্ঠীর কাছে শাসনতন্ত্রের বিষয়ে তখন কী অভিযোগ করেছিলেন- সেই বিষয়ে রেফারেন্সসহ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে পিনাকী ভট্রাচার্য শেখ মুজিবুর রহমানের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে ভরা লেজেগুবরে প্রশাসনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কতটা বেপরোয়া লুটপাট আর সম্পদ সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিলেন; মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিষয়ে অবগত হয়েও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শেখ মুজিব কতটা দ্বিধান্বিত ছিলেন; প্রশাসনিক বিষয়ে শেখ মুজিব কতটা অদক্ষ ছিলেন; তাজ উদ্দিনকে কেনো সন্দেহের চোখে দেখছিলেন; ভারতীয় ব্যাংকে মুজিবনগর সরকারের গচ্ছিত টাকা ইন্দিরা গান্ধী প্রশাসনের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি. এন. হাকসার ফিরিয়ে দিতে চাইলে শেখ মুজিব কিভাবে সেই টাকা নীতিবর্হির্ভূতভাবে তার ব্যক্তিগত খরচের জন্য ট্রাকে করে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। পিনাকী লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবি নিয়ে এলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তাদের ভাব এমন যে, তারা যুদ্ধে জয়ী হয়ে এসেছেন; সুতরাং বিজিতদের সবকিছুতেই তাদের অগ্রাধিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যারা আত্মরক্ষার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা সবাই নিজেদের পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা অনুরূপ পদ বেছে নিলেন। ঠিক তেমনিভাবে শুধু ভারত ঘুরে এসেছেন সেই অধিকারে দু’টো-তিনটে পদ টপকে একেকজন উপরে উঠে বসলেন। ‘শত্রুসম্পত্তি’ এই বাহানা দিয়ে গাড়ি, বাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, দরজা, জানালা লুট করা হলো। যারা এই দুষ্কর্ম করলেন তাদের অনেকেই বেশ পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। গোটা দেশ নিঃশব্দে দু’টি শিবিরে ভাগ হয়ে গেল। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে চলে যায়। এ সময় মওলানা ভাসানী ছাড়া দেশে দৃশ্যত কোনো বিরোধী পক্ষের অস্তিত্ব ছিল না। এ ছাড়া ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নামে অন্য দু’টি রাজনৈতিক দল। ন্যাপ (মো) এবং সিপিবি সরকারকে সমর্থন করেছিল। সরকারের কাছে এই তিনটি দল ছিল ‘দেশপ্রেমিক‘। আইন না মানার যে সংস্কৃতি চালু হয়, তা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়কেও আক্রান্ত করে। একবার কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলের যাত্রীদের টিকিট চেক করে শতাধিক টিকিটবিহীন যাত্রীকে চিহ্নিত ও আটক করা হয়। অবাক হওয়ার মতো কাণ্ড, টিকিটবিহীন যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, তাও আবার সপরিবারে। প্রশাসনের উচ্চ স্তরে পছন্দমাফিক নিয়োগ শুরু হয়। এ সময় পাবলিক সার্ভিস কমিশনও পছন্দমাফিক গড়ে তোলা হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসে প্রথম পিএসসি গড়ে তোলার সময় যাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, সেই ড. এ কিউ এম বজলুল করিম ছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক! গুরুত্বপূর্ণ এই পদটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষককে নিয়োগ দেয়ার একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ছিল, তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদের শিক্ষক। এদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা সশস্ত্র প্রহরীসহ ঘোরাফেরা করতেন। যাকে-তাকে হত্যার হুমকি দিতেন, মারধর করতেন। পিনাকী ভট্রাচার্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের লেখা থেকে কোট করে বলেছেন, ‘এমনকি সেই সময়ের চিফ হুইপ শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন খুব গর্বভরেই লিখেছেন, কীভাবে সচিবালয়ে একজন সচিবকে হত্যার ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করেছিলেন সেই কাহিনী। তিনি সেই সচিবের অসহায় অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন-‘সে পাগলের মতো একবার শিক্ষামন্ত্রী ও একবার আমার পায়ে পড়তে লাগল। বারবার একই কথা বলল, “স্যার এবারের মতো ছেড়ে দেন। আমি আর কোনোদিন আপনাদের কথার অবাধ্য হবো না।’ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বাধ্য করার এই তরিকা ব্যাপকভাবে ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠলো। আরেক ঘটনায় তিনি রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে তিন তলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করেছিলেন! চিফ ইঞ্জিনিয়ার উপায়ান্তর না দেখে শেখ মুজিবের কাছে এর সুরাহার জন্য যান এবং এই অন্যায় ও জরদস্তিমূলক আচরণের প্রতিকার চান। উল্টো শেখ মুজিব তাকে বলেন, ‘মোয়াজ্জেম না হয়ে আমি হলে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে নিচে ফেলে দিতাম। আপনি কোন সাহসে চিফ হুইফের কথা অমান্য করেন! যান, যেভাবে বলেছে, সেভাবে কাজ করুন।’শেখ মুজিবের অনুসারীরা দেশে আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চান এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজনরা প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে যান। বিনিয়োগবিহীন ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বে শেখ কামাল বেশ এগিয়ে ছিলেন। মুজিবের ছোট ভাই বহুসংখ্যক বার্জ ও অন্যান্য নৌযানের মাধ্যমে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়ে যান। শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ মণি ১৯৭০ সালে ২৭৫ টাকা বেতনে সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। কিন্তু ’৭২ সালের মধ্যেই তিনি মতিঝিলে ‘বাংলার বাণী ভবন’সহ অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে যান। যুবলীগের প্রধান হিসেবে তার রাজনৈতিক ক্ষমতাও তুঙ্গে উঠেছিল। আরেক ভাগ্নে শেখ শহীদুল ইসলাম মাত্র ২৫ বছর বয়সে আওয়ামী ছাত্রলীগের প্রধান হিসেবে বাকশালের মন্ত্রী পর্যায়ের ১৫ জনের মধ্যে একজন মনোনীত হন। শেখ মুজিবের ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত নিজে ‘দুর্নীতিমুক্ত বলে সুনাম অর্জন’ করলেও, মন্ত্রী হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ছিলেন না। তিনিও মন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্য এক ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন ’ ১৯৭১ সালে সেকশন অফিসার হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ করছিলেন। ’ ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিন বছরের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন। একমাত্র ভাই শেখ নাসের শেখ মুজিবের নাম ভাঙিয়ে তিন-চার বছরের মধ্যে বিরাট ধনী হয়েছিলেন। শুধু সরকারদলীয় লোকেরাই নয়, শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামালও দুর্বিনীত আচরণ করতেন। ঢাকার মাঠে আবাহনী’র সঙ্গে অন্য একটি টিমের খেলা চলছে। আবাহনী জিতবে। এগিয়েও আছে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতি মন্ত্রী ইউসুফ আলী, চিফ হুইপ শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ কামাল একসঙ্গে বসে বাদাম খাচ্ছিলেন এবং খেলা দেখছিলেন। মধ্যমাঠে আবাহনীর এক খেলোয়াড় ফাউল করলো। রেফারি ননী বসাক, পাকিস্তানের খ্যাতনামা চিত্রনায়িকা শবনমের বাবা, খেলা পরিচালনা করছিলেন। আবাহনীর বিপক্ষে ফাউল দিলেন। কিকও হয়ে গেল। এই ফাউল ধরা ঠিক, না বেঠিক বলা যাবে না। কিন্তু খেলার তাতে কোনো লাভ-ক্ষতি হলো না। শেখ কামাল গর্জে উঠলেন: দেখলেন, ব্যাটা কীভাবে অন্যায় ফাউল দিলো! সবাই চুপ করেই রইলো। খেলা শেষ হলো। মন্ত্রী ও শেখ মুজিবের পুত্রকে দেখে মাঠ থেকে তাদের দিকেই ননী বসাক উঠে এলেন। তিনি হাসিমুখে সবার সাথে হাত মিলাতে এগিয়ে এলেন। কথা নেই, বার্তা নেই, শেখ কামাল ননী বসাককে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে ফেলে দিলেন। তার মুখ থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। শেখ কামাল রাগত স্বরে তখন চিৎকার করে বলছেন- ‘ব্যাটা সব সময় এমনই করে, আবাহনীর বিরুদ্ধে বাঁশি বাজায়। তাকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।’শেখ মণিও তার অপছন্দের কর্মকর্তাদের শায়েস্তা করার জন্য শেখ মুজিবকে দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করতেন। একদিন চিফ হুইপ শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনের উপস্থিতিতে শেখ মণি হন্তদন্ত হয়ে শেখ মুজিবের লিভিং রুমে প্রবেশ করলেন। শেখ মুজিব তখন পোশাক পরছিলেন। বললেন: মামা, কয়েকজন অফিসার বেশি বেড়ে গেছে, তাদের শায়েস্তা করা প্রয়োজন। তিনি কোনো প্রশ্ন না করে বা কিছু জানতে না চেয়ে নির্বিকার চিত্তে বললেন, নামগুলো আমার অফিসে পাঠিয়ে দিস। কারা বেড়ে গেল, কি তাদের অপরাধ, মণির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা কী- কোনো প্রশ্নই তিনি করলেন না! পরদিন সকালে খবরের কাগজে এলো কয়েকজনের চাকরি নেই। পিও নাইন-এ তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শিল্পোন্নয়ন সংস্থার অর্থ পরিচালক, বিক্রমপুরের কাজী রোমান উদ্দীন সাহেবেরও চাকরি নেই। জানা গেল, মণি কোনো অন্যায় অনুরোধ করলে তিনি তা অস্বীকার করায় আরো কয়েকজনের সঙ্গে তারও এই শাস্তি হলো। তদন্ত হলো না। অপরাধের কার্যকরণ কিছুই বিশ্লেষণ করা হলো না। অফিসারদের অতীতের রেকর্ড পরীক্ষা করা হলো না-এমনকি তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ বা কারণ দর্শানোর সময়ও দেয়া হলো না। শেখ ফজলুল হক মণি, ‘মুজিবের শাসন চাই, আইনের শাসন নয়’শ্লোগানটি জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেন। শেখ মণির যুক্তি ছিলো, যেহেতু ১৯৭১ এ মুজিবের কথায় দেশ চলেছে, এখনো সেভাবেই চলতে হবে। রক্ষী বাহিনী নামে আধা সামরিক বাহিনী মুজিব বিরোধীদের দমন করার কাজে প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে কাজ শুরু করে এবং দেশে আরেকবার নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। গুপ্ত হত্যা ছাড়াও এরা মন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও মিছিলের উপর ঠান্ডা মাথায় গুলি করে মিছিলের ১৯ জনকে হত্যা করে। ফলে স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই দেশবাসীর উত্তুঙ্গ আশা-আকাঙ্খায় ভাটা পড়ে যায়। স্বাধীনতা তাদের মনে যে প্রাচুর্যের জায়গা তৈরী করেছিলো তা মিথ্যা হয়ে যায়। বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কেনো শেখ মুজিরে উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন; কেনো তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন; ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় দেশ স্বাধীন করলেও প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারই কেনো স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারতকে নাক সিটকাতে শুরু করেন; যে দেশের মুক্তির জন্য তারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করেছিলেন, সে দেশে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খল শাসন ও হালুয়া-রুটির ভাগাভাগি দেখে তারা কতটা বিরক্ত হয়েছিলেন- সেই সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। নবম অধ্যায়ে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য আর্ন্তজাতিক দাতা সংস্থার বিদেশি সাহায্য সামগ্রী কিভাবে কালোবাজারে আর চোরাচালান হয়ে ভারতে চলে যায় এবং সদ্য স্বাধীন দেশের নেতারা যখন বিদেশে সাহায্যের জন্য হাত পাততে যেতেন, সেই সময় তাদের বিলাস-ব্যাসন অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কতটা বিস্ময় উদ্রেক করতো তার বর্ণনা দিয়েছেন। দশম অধ্যায়ে যুদ্বাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলেছেন। ভুট্রো যা চেয়েছেন তা-ই পেয়েছেন। যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাতিল করিয়েছেন এবং আটকেপড়া পাকিস্তানীদের দায়ভারও এড়িয়েছেন। এগারো অধ্যায়ে ১৯৭৩ সালের সাধারন নির্বাচনে কিভাবে বিরোধী দলের সব গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ও প্রার্থীদের জবরদস্তিমূলকভাবে পরাজিত করা হয়েছিলো; নবীন রাষ্ট্রের কথিত গণতান্ত্রিক যাত্রাপাথের সূচনাতেই কিভাবে নির্বাচনী বর্বরতা-দস্যুতা ও জালিয়াতির অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছিলো; সত্য খবর প্রকাশ করায় দেশের সংবাদপত্রকে কতটা চড়া মূল্য দিতে হয়েছিলো –এসবের উপর আলোকপাত করেছেন। বারো অধ্যায়ে যথাক্রমে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নিপীড়ন; লাল বাহিনীর দৌরাত্ব-হত্যা, খুন; বঙ্গবন্ধু না লিখলে বা না বললে জিহ্বা ছিড়ে ফেলার হুমকি; তেরো অধ্যায়ে দেশের ইতিহাসে প্রথম বিচার বর্হিভূত সিরাজ শিকদার হত্যাকান্ড; চৌদ্দ অধ্যায়ে রক্ষীবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও স্বাধীন দেশের মানুষের উপর কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর নির্মম নির্যাতন; পনেরো অধ্যায়ে ছা্ত্রলীগের ভাঙন ও জাসদের জন্ম; ষোল অধ্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছরের দাসত্বের চুক্তি; সতের অধ্যায়ে বাংলাদেশের মরণফাঁদ ফারাক্কা ব্যারেজ; আঠারো অধ্যায়ে বন্ধুর পার্বত্য চট্রগাম; উনিশ অধ্যায়ে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ; বিশ অধ্যায়ে শেখ মুজিব কর্তৃক তাজ উদ্দিনের অপমাণজনক বিদায় ও একুশ অধ্যায়ে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশাল গঠনের কথা তুলে ধরেছেন। বাইশ অধ্যায়ে শেখ মুজিবের অবৈধ সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা, শেখ মুজিবের দু:খজনক হত্যাকান্ড ও হত্যাকান্ডের পূর্বে ও পরে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লেখক পিনাকী ভট্রাচার্য তার লেখা শেষ করেছেন। মুজিব সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ছিলো খুবই অগোছালো এবং দুর্বল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর আক্রমণ করে ঠিক কী করা হবে সেটা কেউই নিশ্চিত ছিলেন না। অভ্যুত্থানকারীরা নানা পরিকল্পনার মধ্যে প্রথমে ভেবেছিলেন, শেখ মুজিবকে সুকর্নোর মতো গদিচ্যুত করে একটি ‘প্রাসাদে’ আটকে রাখা হবে। মুজিব প্রায়ই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘বেড়াতে’ যেতেন। আর এই ভ্রমণের জন্য তিনি হেলিকপ্টারকেই পছন্দ করতেন। অভ্যুত্থানকারীরা এক সময় শেখ মুজিবকে হেলিকপ্টারে হত্যার পরিকল্পনাও করেছিলেন। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত তখন ফ্লাইট কন্ট্রোল অফিসার। কর্নেল ফারুক লিয়াকতকে অনুরোধ করেছিলেন যে, যখন মুজিবকে নিয়ে হেলিকপ্টার আকাশে উড়বে, তার আগেই পিস্তলসহ ফারুক সঙ্গে থাকবেন। তারপর রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে মুজিবকে গুলি করে মারা হবে এবং মুজিবের মৃতদেহ সুবিধাজনক একটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। তারপর তারা গন্তব্যস্থলের দিকে যেতে থাকবেন যেন কিছুই ঘটেনি। ইতোমধ্যে রশিদ এবং অন্যরা নিচে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কর্নেল ফারুকের মতে, তার ‘ফাইনাল প্ল্যান’ ছিল শেখ মুজিবকে বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে এনে তার বস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সামনে হাজির করা এবং বিচারের ব্যবস্থা করা। কর্নেল রশিদ বলেছিলেন, তাকে ধরে এনে রেসকোর্স ময়দানে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে প্রাণদণ্ড প্রদান করে সঙ্গে সঙ্গেই তা ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে কার্যকর করার কথা। অভ্যুত্থানকারীদের সাথে শেখ মুজিবের সংক্ষিপ্ত বাদানুবাদের বাক্যগুলো পর্যালোচনা করলেও বুঝা যায় অভ্যুত্থানকারীরা শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। আক্রমণকারী অফিসারদের অধিনায়ক মেজর মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বলছিলেন- স্যার, আপনি আমাদের সাথে আসুন। শেখ মুজিব তাকে চড়া কন্ঠে ধমকে বলে উঠেন- তোরা কী চাস, তোরা কী করতে চাস? দৃশ্যপটে মেজর বজলুল হুদা এসে হাজির হন। তিনি কড়া কন্ঠে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন এবং শেখ মুজিবকে নিচে নেমে আসতে বাধ্য করেন। তিনি বারান্দার মুখে এসে দাঁড়ান। ঠিক এই সময়েই উদ্যত স্টেনগান হাতে সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সর্বহারা পার্টির গোপন সদস্য মেজর নুর চৌধুরী হাজির হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তিনি সরাসরি শেখ মুজিবের বুকে গুলি চালান এবং পরে বলেন, আমার নেতা সিরাজ শিকদারকে হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছি। এভাবেই অপারেশন শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন গ্রুপের অফিসাররা নিজেরাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং কোনো নির্দেশের অপেক্ষা না করে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন তারা নিজেরাই। অভ্যুত্থান পরিকল্পনা এতোই দুর্বল ছিলো যে পুরো প্রশাসন, শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভা, আন্তর্জাতিক শক্তি, সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে সমর্থন জানালেও তারা তিন মাসও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। শুধু তাই-ই নয়, বীরের তকমা পাওয়া অভ্যুত্থানকারী অফিসারদের সদলে দেশত্যাগ করতে হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের ভয়াবহ স্বৈরশাসনে দেশ এমনই নিষ্পেষিত ছিলো যে, মুজিব সরকার উৎখাতের সংবাদে সারা দেশে নানা জায়গায় আনন্দ মিছিল হয়েছিলো, মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিলো। শেখ মুজিবের পতন শুধু সময়ের ব্যাপার ছিলো। ঘটনাচক্রে পতন হয়েছিলো সামরিক অভ্যুত্থানে, নইলে গণ অভ্যুত্থানেই শেখ মুজিবের পতন হতো। স্বাধীনতার সংগ্রাম যেই নেতাকে ইতিহাসের মহানায়ক বানিয়েছিলো, সেই মহানায়কের প্রবল পরাক্রান্ত নিপীড়ক স্বৈরাচার হয়ে ওঠা দেখাটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। লেখক ও গবেষক লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য তার ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ ৪৭৩ পৃষ্ঠা বইয়ের ৪৫৭ জুড়ে ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে গল্প বলার মত করে ধারা বিবরণী দিয়েছেন। একটা কথাও তিনি বানিয়ে বলেননি বা লিখেননি। প্রত্যেক লাইনে লাইনে তিনি রেফারেন্স দিয়েছেন। লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য গল্পচ্ছলে পাঠককে সেই সময়ে নিয়ে গেছেন। ঘটনাগুলো যেনো চোখের সামনেই ঘটছে-পাঠককে তিনি এই অনুভব দিয়েছেন। রামচন্দ্র গুহের ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধি’ যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই পিনাকী ভট্টাচার্যের ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ লেখার স্টাইলটা ধরতে পেরেছেন।
প্রতিক্রিয়াঃ বাংলাদেশের টেক্সটে গ্রন্থকার হিসেবে পিনাকী ভট্টাচার্য নিজেকে ব্যতিক্রমী একজন হিসেবে চিহ্নিত করাতে সক্ষম হয়েছেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের গ্রন্থবাজারে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছেন। পিনাকী ভট্টাচার্যের বই মানেই মার মার কাট কাট। উনি লিখলেই তার বই বেস্ট সেলার হয়ে যায়। তার লেখায় অনেক না জানা বিষয় পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি খুলে যায়। পিনাকীর সাম্প্রতিক বইগুলোর মতো এই বইটিও পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছবে। বইটি বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আলোড়ন তুলেছে, ফটোকপি করেও বাংলাদেশে অনেকে তার এই বইটি বিক্রি করছে। বইটি ভবিষ্যতে আরও বেশি আলোড়ন তুলবে- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। শেখ হাসিনা আর তার আওয়ামী লীগ শেখ মুজিব আমলকে যেভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেন তার প্রায় সবটাই মিথ্যা। ইতিহাস কেবল সংঘটিত ঘটনার বিবরণ নয়। তথ্য ও সত্যই তার ভিত্তি। পিনাকী ভট্টাচার্য অনেক খেটে, অনেক ঘেটে ইতিহাসের অনেক মহার্ঘ উপাদান জড়ো করেছেন, মুজিব শাসনামলের ইতিহাসকে খুব সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ বইয়ে। পিনাকী ভট্টাচার্যের ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’ পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন কী কারণে আজকে বাংলাদেশের এই অবস্থা হয়েছে। এটা কি ধারাবাহিক ব্যর্থতা না ষড়যন্ত্রের ফলে হয়েছে। পাঠক জানতে পারবেন, যুদ্ধোত্তর দেশে মানুষ যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বাধীনতার আস্বাদ নিতে চেয়েছিল, অচিরেই কেনো তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলো। পাঠক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী বহু ভিত্তিহীন দাবিকে নস্যাৎ করে ইতিহাসের প্রমাণ্য দলিলসহ সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য পাবেন এই বইতে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ – এই সময়টা যারা বুঝতে চান তাদের জন্য এটি চমৎকার একটি বই, অপরিহার্য একটি বই। পাতায় পাতায় রুদ্ধশ্বাস বাস্তবতায় ভরা খুবই সুন্দর সাবলীল এবং সুখপাঠ্য একটি বই। পিনাকী ভট্টাচার্য ৭২-৭৫ সালের অনেক ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন এবং নির্ভীকভাবে উপযুক্ত তথ্যাদির সাহায্যে সেই ঘটনাগুলির অনেকগুলোকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করেছেন। এখানে লেখকের নিজের মতামত আছে খুবই কম। প্রায় পুরোটাই সে সময়কার পত্রিকা আর সমসাময়িক ঘটনাবলির উপর ভর করে লেখা প্রচুর রেফারেন্সযুক্ত বই। লেখক ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থেকে বস্তুনিষ্ঠ থাকবার চেষ্টা করেছেন একশত ভাগ। বইটি পড়লে পলিটিকাল লিটারেচারে পিনাকী ভট্রাচার্যের নিজস্ব দক্ষতা আর সৃজনশীলতা পাঠক আরও একবার আগ্রহ ও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করবেন। বইয়ের কিছু দুর্বল দিকের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলবো, বইটি পড়তে গিয়ে আমার কাছে ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতার কিছুটা অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় এক ঘটনার সাথে আরেক ঘটনার ছবি প্রিন্ট হওয়ায় কিছুটা বেখাপ্পা লেগেছে। কোন কোন জায়গায় এক অধ্যায়ের লেখা আরেক অধ্যায়ে চলে গেছে। আশাকরি পরবর্তী সংস্করণে লেখক ও প্রকাশক এই বিষয়গুলোতে একটু দৃষ্টি দিবেন। লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানী কেন উপস্থিত থাকলেন না তার সামান্য একটু ইঙ্গিত দিয়েছেন। এরকম কিছু কিছু ঘটনা আরও একটু বিস্তারিত লিখে বইয়ে আরও দুই-একটি প্যারাগ্রাফ যোগ করলে ভালো করতেন। অবশ্য এটার অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বইয়ের দাম বেড়ে যেতে পারে ভেবে এটা সচেতনভাবেও করা হতে পারে। যাই হোক, যেটুকু করেছেন এবং যেভাবে করেছেন- বইটির লেখক ও প্রকাশক দু‘জনকেই এই সময়ে এই উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সরকারের আমল নিয়ে মার্কাস ফ্রান্ডারের “বাংলাদেশ দি ফার্স্ট ডিকেড” এর মত পিনাকী ভট্টাচার্যের ” স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ” বইটাও বাংলাদেশে টিকে থাকার জন্য এসেছে। পিনাকী ভট্টাচার্যের সুলিখিত এই বইটি বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠের একটি মূল্যবান সংযোজন হিসাবে টিকে থাকবে। অনেক অনেক রেফারেন্সযুক্ত ঘটনার বই হলেও ভবিষ্যতে এই বইটি নিজেই একটা রেফারেন্স বই হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ বিশেষ করে ইতিহাসের ছাত্র শিক্ষক ও ভবিষ্যতের গবেষকদের এই বইটি অবশ্য অবশ্যই পড়া উচিত এবং সংগ্রহে রাখা উচিত।
ডিসক্লেইমারঃ পড়ার জন্য লেখক বা প্রকাশকের কাছে কেউ ফ্রি বই বা পিডিএফ চেয়ে লজ্জা দিবেন না। বই ফ্রি বিলানোর জন্য লেখা বা প্রকাশ করা হয় না। যদি বইটি পড়তে আগ্রহী হন এবং সংগ্রহে রাখতে চান তাহলে মুদ্রিত বই আপনাকে কিনতে হবে। দাম বেশি মনে হলে এক সাথে কয়েকজন মিলেও কিনতে পারেন। শেয়ার করে পড়তে পারেন। পিনাকী ভট্টাচার্যের ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ ‘ বইটি যারা কিনে পড়তে চান এবং সংগ্রহে রাখতে চান তারা প্রকাশকের ওয়েবসাইটের লিঙ্কটিতে ক্লিক করে অর্ডার করতে পারেন। https://www.horoppabooks.com/