।। মাহাবুবুর রহমান ।।
২০২৫ সালটি ব্রিটেনে অভিবাসন নীতিতে এক বড় মাইলফলক হিসেবে ধরা হচ্ছে। লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসায় অভিবাসীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হলেও গত এক বছরে যত নতুন অভিবাসন নীতি সংশোধন করা হয়েছে, তাতে বহু অভিবাসীর স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। স্বয়ং লেবার পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমারের কঠোর ঘোষণাই এর প্রমান। তিনি বারবার বলে যাচ্ছেন, “নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ ফিরে আনা, অবৈধ প্রবেশ বন্ধ এবং দক্ষ অভিবাসীদের উচ্চতর অবস্থানে আনাই” হলো লেবার সরকারের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারা গত মে মাসে একটি হোয়াইট পেপার প্রকাশ করে।
Restoring Control over the Immigration System White Paper (১২ মে ২০২৫) — যেখানে এই সরকারের অভিবাসন নীতির একটি রূপরেখা দেওয়া হয়। এই রূপরেখা মূলত গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠোরতর অভিভাসন নীতির আভাস দেয়। এর পরে কয়েকটি “Statement of Changes to the Immigration Rules” (আইন পরিবর্তন সূচিকা) প্রকাশ করা হয়, যা আইনগতভাবে কার্যকর হয়েছে।
এই পরিবর্তনগুলো শুধু নতুন রুট বা ভিসা চালু করার বিষয় নয় — পূর্বের নিয়ম ফের যাচাই, শর্ত কঠোর করা, নির্দিষ্ট রুট বন্ধ বা সীমিত করা, ওয়ার্ক পারমিটের ভিসা সংকোচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দক্ষতা ও বেতনের পরিবর্তন: “Skilled Worker” রুটে যোগ্যতার মান (skill level) আগের তুলনায় অনেকটা বাড়ানো হয়েছে — রেফারেন্স হিসাবে “RQF 6 বা তার উপরে” (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের) শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
“Social Care” বা বৃদ্ধ ও অপরাপর দেখভালের কাজে বিদেশি কর্মী স্পন্সর করার রুট বিদেশ-ভিত্তিক নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
“টেম্পোরারি শর্টেজ লিস্ট” (Temporary Shortage List) চালু করার কথা বলা হয়েছে — যেসব পেশায় দীর্ঘমেয়াদে কর্মী ঘাটতি রয়েছে, সীমিত সময়ের জন্য রিক্রুটমেন্ট দেওয়া হবে। তবে এসব পদে ডেপেন্ডেন্ট বন্ধ করা হয়েছে।
ছাত্র (Student) ও গ্র্যাজুয়েট রুটে পরিবর্তন: “Graduate Route” (অর্থাৎ একাডেমিক শিক্ষা শেষে কাজ বা বসবাসের সুযোগ)-র মেয়াদ কমানো হচ্ছে। এটা দুই বছর থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এটি ২০২৭ সালের জানুয়ারী মাস থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে।
শিক্ষার্থী ভিসা নিয়ন্ত্রণ (sponsor compliance) কঠোর করা হবে — অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা সংস্থা বিদেশি ছাত্রদের জন্য স্পন্সর করার ক্ষেত্রে আরও বেশি দায়বদ্ধতা বাড়ানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে জেনুইন স্টুডেন্ট রিকৃুট করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন অভিভাসন নীতিতে।
ইংরেজি ভাষার মান ও অন্যান্য যোগ্যতা: ভবিষ্যতে “B1” (ভাষা-মাধ্যমিক পর্যায়) থেকে “B2” পর্যায়ে ইংরেজি ভাষার মান বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে “Skilled Worker”, “High Potential Individual” ও “Scale-up” রুটে আবেদনকারীদের জন্য। এই নতুন B2 ইংলিশ শর্ত আগামী ৮ জানুয়ারী থেকে বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে।
আবেদনকারীদের ভালো ইংরেজি দক্ষতা, নির্দিষ্ট সময় দেশীয় কর্মসংস্থানে অবদান, পরিচ্ছন্ন রেকর্ড ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আসবে।
স্থায়ী বসবাস (ILR) এবং নাগরিকত্ব: আগামী দিনে স্থায়ী বসবাস বা নাগরিকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় আবেদনের সময়সীমা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে — উদাহরণস্বরূপ, ৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছরের নিয়ম বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এটাকে অর্জিত সেটেলমেন্ট বলা হচ্ছে। এর মানে হলো – একজন অভিবাসীকে নির্দিষ্ট পয়েন্ট পেতে হবে সেটেলমেন্টের জন্য। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট চাকুরি শেষে সেটেলমেন্টের আবেদন করলে তা গ্রান্ট হবে না। এজন্য চ্যারিটি কাজ এবং কমিউনিটির জন্য তার ভুমিকা রাখার উদাহরণ থাকতে হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আইন হয়তো হোম অফিস ঘোষণা করবে।
ফ্যামিলি রিইউনিয়ন স্থগিত: রিফিউজিদের জন্য সহজতর ফ্যামিলি রিইউনিয়ন আইনটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এটি স্থগিত রয়েছে। এই আইনের অধিনে একজন রিফিউজি কোনো প্রকাশ ফি এবং ইংরেজী পরীক্ষা ছাড়াই তার স্পাউস এবং ১৮ বছরের নিচের সন্তানদের ইউকেতে নিয়ে আসতে পারতো। এখন এ সংক্রান্ত আইন স্থগিত করে আগামী এপ্রিলে সরকার নতুন নীতিমালা / সিস্টেম ঘোষণা করবে। এই সময়ের মধ্যে সাধারণ ফ্যামিলি বা স্পাউস ভিসার মতো করে রিফিউজিরা তাদের পরিবারের সদস্যদের আনতে আবেদন করতে পারবেন। এটি রিফিউজিদের জন্য অত্যন্ত কঠোরতা বলে মনে করেন অভিবাসী আইনজীবীরা।
২০২৫ সালে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতিতে যে কঠোরতার ছাপ দেখা যাচ্ছে, তা শুধুই আইন পরিবর্তন নয় — এটি একটি রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ। এতে মূল ভাবনা হলো মিসইউজ করছে, তাদের রুখে দেয়া। তবে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিও রয়েছে, বিশেষ করে আবেদনকারী, নিয়োগদাতা, শিক্ষার্থী এবং ফ্যামিলি রিইউনিয়নের ক্ষেত্রে।
লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী।





